দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা’আলা যখন আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন, তখন তিনি তাঁর ফেরেশতাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন-আমি পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি তৈরি করতে যাচ্ছি। (সুরা বাকারা : ৩০)
পৃথিবীপৃষ্ঠে আল্লাহর প্রথম খলিফা ছিলেন মানবজাতির আদি পিতা আদম (আ.)। তিনি একইসাথে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত প্রথম নবী ছিলেন। তাঁর হাত ধরে শুরু হওয়া নবুয়্যাতের মোবারক সিলসিলা সমাপ্ত হয়েছে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী সায়্যিদুনা মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মাধ্যমে। সর্বপ্রথম ও সর্বশেষ নবীদ্বয়ের মধ্যখানে একলক্ষ চব্বিশ হাজার নবী-রাসুলদের আগমন ঘটেছিল, যাদের বৃহদাংশ ছিলেন বনি ইসরাইল তথা ইবরাহিম (আ.)-এর বংশধর থেকে। বনি ইসরাইলের নেতৃত্বের সিলসিলা ছিল এরূপ যে, একজন নবী পৃথিবী থেকে বিদায় নিলে আরেকজন নবী তাঁর খেলাফত গ্রহন করতেন এবং পৃথিবীতে আল্লাহর দ্বীন প্রচার ও বাস্তবায়ন এবং তদ্বীয় উম্মতের শাসনভার হাতে নিতেন। সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাতে নবুয়্যাতের মোবারক সিলসিলা সমাপ্ত হওয়ার পর প্রথমবার এ পৃথিবীতে আল্লাহর দ্বীন প্রচার ও বাস্তবায়ন এবং উম্মতের শাসনভার অর্পিত হয় এমন মানুষদের হাতে, যারা নবী নন। নবী নন, অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনিত নন; বরং উম্মতের ঐক্যমতের ভিত্তিতে নির্বাচিত। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- বনি ইসরাইলের নবীরা তাঁদের উম্মতকে শাসন করতেন। যখন একজন নবী মারা যেতেন, আরেকজন নবী তাঁর স্থলাভিষিক্ত হতেন। আর আমার পরে কোন নবী নেই। তবে অনেক খলিফা হবেন। (সহীহ বুখারী : কিতাবু আহাদীছিল আম্বিয়া, ৩২৬৮)
যদিও মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাত ধরে নবুয়্যাতের সিলসিলা সমাপ্ত হয়েছিল, তথাপি কিছু মিথ্যাবাদী যুগেযুগে নিজেদেরকে নবী বলে দাবী করে এক মহা বিশৃঙ্খলতার জন্ম দিয়েছিল। এ ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে সতর্ক করে গিয়েছিলেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- কিয়ামত সংঘটিত হবেনা, যতদিন না ত্রিশজনের মতো মিথ্যাবাদী দাজ্জাল বের হবে। প্রত্যেকে দাবী করবে, সে আল্লাহর রাসুল। (মুত্তাফাক আলাইহি, জামে তিরমিযি : আবওয়াবুল ফিতান, ২২১৮)
মিথ্যাবাদী নবীদের ফিতনার মূলোৎপাটন করতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা›আলা সুস্পষ্ট বাক্যের দ্বারা সায়্যিদুনা মুহাম্মদ (সা.)-কে শেষ নবী বলে আখ্যায়িত করেছেন। কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করা হয়েছে- মুহাম্মদ তোমাদের কোন পরুষের পিতা নন; বরং তিনি আল্লাহর রাসুল ও শেষ নবী। আর আল্লাহ সর্ববিষয়ে জ্ঞাত। (সুরা আহযাব : ৪০)
রাসুল (সা.) দ্ব্যর্থহীন ও খোলাখুলিভাবে নবীদের মিথ্যা দাবীর মূলোৎপাটন করে, নিজের প্রকৃত পরিচয় আমাদের সামনে উন্মুচিত করে গেছেন। জুবায়ের ইবনে মুত্বইম (রা.) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- আমি মুহাম্মদ (পরম প্রশংসিত), আমি আহমদ (প্রশংসাকারী), আমি মাহী (বিলুপ্তকারী) এমন ব্যক্তি যে, আমার মাধ্যমে কুফরকে মুছে দেয়া হবে। আমি হাশির (একত্রকারী) এমন ব্যক্তি যে, আমার পেছনে লোকদেরকে একত্রিত করা হবে। আমি আকিব। আকিব ঐ ব্যক্তি যার পরে কোন নবী নেই। (সহীহ মুসলিম : কিতাবুল ফাদ্বায়িল, ২৩৫৪)
অন্যান্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) এরচেয়ে সুস্পষ্ট বাক্যের দ্বারা তাঁর খাতমে নবুয়্যাত তথা নবুয়্যাতের সমাপ্তির ঘোষণা দিয়েছেন। ছাওবান (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- আর, আমি নবীদের মধ্যে সর্বশেষ নবী। আমার পরে আর কোন নবী নেই। (জামে তিরমিযি : আবওয়াবুল ফিতান, ২২১৯)
সুতরাং যে ব্যক্তি সায়্যিদুনা মুহাম্মদ (সা.)-কে সর্বশেষ নবীরূপে স্বীকার করবেনা, সে সরাসরি ইসলামের সীমা থেকে নিজেকে বহিষ্কার করে নেবে। ইসলামি আকীদার মৌলিক ভিত্তিসমূহের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মুহাম্মদ (সা.)-কে সর্বশেষ নবী ও রাসুল বলে বিশ্বাস করা এবং স্বীকৃতি দেয়া। এ স্বীকৃতি ব্যতীত কোন ব্যক্তি ঈমানদার বলে গণ্য হবেনা।
যে মুসলিম ব্যক্তি ঈমানের সাথে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে দেখেছেন এবং সেই ঈমানের উপর মৃত্যুরণ করেছেন, ইসলামি পরিভাষায় তাঁকে সাহাবি বলে আখ্যায়িত করা হয়। নবী-রাসুলদের পর ‘সাহাবি’ পরিভাষাটি ধর্মীয় পরিমন্ডলে সবচেয়ে সম্মানজনক পদবী। সাহাবির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী বলেছেন- সাহাবি তিনি, যিনি ঈমানের সাথে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাক্ষাৎ লাভ করেছেন এবং ইসলামের উপর মৃত্যুবরণ করেছেন। (আল-ইসাবাহ ফি তামঈযিস সাহাবা : ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী)
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা›আলা সাহাবিদের পরিচয় দিয়েছেন এভাবে- মুহাম্মদ আল্লাহর রাসুল এবং তাঁর সহচরগণ অবিশ্বাসীদের প্রতি কঠোর, নিজেদের মধ্যে পরস্পর সহানুভূতিশীল। আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় আপনি তাদেরকে রুকু ও সেজদারত দেখবেন। তাদের মুখমন্ডলে রয়েছে সেজদার চিহ্ন। (সুরা ফাতহ : ২৯)
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা’আলা সাহাবিদেরকে সালাম দিয়েছেন। কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করা হয়েছে- বলুন, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য এবং তাঁর নির্বাচিত বান্দাদের উপর সালাম।(সুরা নমল : ৫৯)
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, এখানে নির্বাচিত বান্দা দ্বারা সাহাবিদেরকে বুঝানো হয়েছে। (তাফসিরে আহকামিল কুরআন : ইমাম কুরতুবী)
সাহাবায়ে কেরাম এ উম্মতের সর্বোত্তম মানুষ। ইমরান ইবনে হোসাইন (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত হচ্ছে আমার যুগের উম্মত, এরপর তৎপরবর্তী যুগ, এরপর তৎপরবর্তী যুগ। (সহীহ বুখারী : কিতাবু ফাদ্বায়িলুস সাহাবা, ৩৪৫০)
সাহাবিরা জাহান্নাম থেকে মুক্ত। জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- সে মুসলিমকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবেনা যে আমাকে দেখেছে। অথবা যারা আমাকে দেখেছে, তাদেরকে দেখেছে। (জামে তিরমিযি : আবওয়াবুল মানাকিব, ৩৮৫৮)
আল্লাহর নবী (সা.)-এর সাহাবিদেরকে গালি দেয়া পাপাচারিতা ও ধর্মদ্রোহিতার শামিল। আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- আমাদের সাহাবিকে গালি দিওনা। কসম সেই সত্ত্বার যার হাতে আমার প্রাণ, তোমাদের মধ্যে কেউ যদি উহুদ পাহাড়ের সমপরিমাণ স্বর্ণ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করো, তথাপি আমার আমার সাহাবিদের একমুষ্টি দানের সমপরিমাণ হবেনা। এমনকি আধামুষ্টিও নয়। (সুনানে আবু দাউদ : কিতাবুস সুন্নাহ, ৪৬৫৮) (চলবে)
লেখক : ইসলামি চিন্তাবিদ, অধ্যয়ণরত- (মাস্টার্স) রিলিজিয়াস স্টাডিজের অধীনস্থ ইসলামিক স্টাডিজ,
এয়ারফোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়, জার্মানী
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।