Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সুচির মুখোশ খসে পড়েছে

মালয়েশিয়ার কঠোর প্রতিবাদ

| প্রকাশের সময় : ৪ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোবায়েদুর রহমান : শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার ধারিণী অশান্তির দেবী অং সান সুচি অবশেষে অশ্বডিম্ব প্রসব করেছেন। রোহিঙ্গা মুসলমানদের বীভৎস গণহত্যা সম্পর্কে দীর্ঘ দেড় মাস রহস্যময় নীরবতা অবলম্বনের পর অবশেষে তিনি মুখ খুলেছেন এবং এবার তিনি তার শান্তির নেকাব ছুড়ে ফেলে দিয়ে ঘাতকের ভয়াল চেহারা উন্মোচন করেছেন। গত শুক্রবার সিঙ্গাপুরভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম চ্যানেল নিউজ এশিয়াকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন ‘আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছি এবং শান্ত করেছি’। তিনি আরও বলেন, ‘আমি খুব খুশি হব যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সব সময় বড় ধরনের অসন্তোষ ছড়ানোর কারণ তৈরি না করে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ভালো সম্পর্ক গড়ার জন্য অগ্রগতি আনতে এবং শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় আমাদের সহযোগিতা করে’।
সুচি মূল সমস্যাকে এড়িয়ে ভাসা ভাসাভাবে মিয়ানমারের পরিস্থিতি আলোচনা করেন যেখানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের গণহত্যা এবং বর্মী হানাদার বাহিনী এবং রাখাইন বৌদ্ধগণ কর্তৃক মুসলিম গণহত্যার বিষয়টি তিনি সম্পূর্ণ এড়িয়ে যান। তৎপরিবর্তে তিনি বলেন, ‘প্রত্যেকে যদি শুধু পরিস্থিতির নেতিবাচক দিকের প্রতি মনোযোগ দেয় তাহলে তা কোনো কাজে আসবে না।’
এর মধ্যে গত শুক্রবার রোহিঙ্গা নিধন সম্পর্কে সরেজমিন পর্যবেক্ষণের জন্য জাতিসংঘের প্রাক্তন মহাসচিব কফি আনান ৬ জনের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে মিয়ানমার পৌঁছেন। সেখান থেকে তিনি আরাকান বা রাখাইন প্রদেশের রাজধানী সিটুয়েতে যান। সেখানে গিয়ে কট্টর বৌদ্ধদের বিক্ষোভের মুখে পড়েন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান। তার নেতৃত্বে একটি আন্তর্জাতিক কমিশন গতকাল এ পরিদর্শনে যায়। বিমানবন্দরের বাইরে এ সময় কফি আনানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেন শ’খানেক বৌদ্ধ। তাদের হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘কফি আনান কমিশন নিষিদ্ধ করো’ ‘আমরা কফি আনান কমিশন চাই না’ ইত্যাদি। এ সময় কফি আনানের সামনে চিৎকার করে এক বিক্ষোভকারী বলেন, ‘রাখাইন রাজ্যে যা ঘটছে সেটা আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এখানে আমরা বিদেশিদের হস্তক্ষেপ চাই না।’ এর পরেই মুখ খুললেন সুচি।
এই সংকট এবং রোহিঙ্গাদের ওপর মধ্যযুগীয় নির্যাতনের ঘটনা এবং পটভূমি সুচির নখদর্পণে। তিনি মুখ খোলার ১২ ঘণ্টা আগে নাফ নদীতে ভাসমান, পলায়নরত নিরস্ত্র রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলি বর্ষণ করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এই গুলি বর্ষণের ফলে ৩৫ জন মুসলমান নৌকার মধ্যেই আহত হন এবং পরে তাদের মৃত্যু হয়। এত বড় নৃসংশতা, এমন ভয়াল পৈশাচিক হত্যাকা-ের পর নোবেল ধারিণী সুচি বিশ্ব সম্প্রদায়কে দূরে থাকার জন্য যে নসিহত করলেন সেটি নোবেল পুরস্কার প্রদানের সাথে এক নির্মম রসিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
কিন্তু সারা বিশ্বের বিবেকবান মানুষের কাছে আজ একটিই প্রশ্ন : পরিস্থিতির আর কতদূর অবনতি হলে রোহিঙ্গাদের ওপর বর্মী বর্বরতার অবসান হবে? আর কত মানুষ মারা গেলে বিশ্ব বিবেক জাগ্রত হবে? আর কত মা-বোন ধর্ষিত হলে বিশ্ব শক্তিরা জেগে উঠবে? আমারতো মনে হচ্ছে যে ২৫ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানদের মধ্যে যে ১৩ লাখ এখনো বার্মার রাখাইন প্রদেশে রয়েছে তারা সকলে একেবারে মাটির সাথে মিশে গেলে তখনই মানবাধিকারের ফেরিওয়ালারা জেগে উঠবে। এতদিন আমরা জবাই করে হত্যা করা অথবা বন্দুক রাইফেলের গুলিতে নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে হত্যার কথা শুনেছি। কিন্তু সেই নিরীহ নিরস্ত্র মানুষগুলোকে হেলিকপ্টার গানশীপ থেকে অর্থাৎ আকাশ থেকে গুলি করে হত্যার খবর কি আপনারা শুনেছেন? কাদের বিরুদ্ধে আকাশে হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হচ্ছে? যাদের হাতে রাইফেল-পিস্তল তো দূরের কথা, একটি লাঠিসোটা বা পিস্তল পর্যন্ত নাই? এতদিন আমরা বিভিন্ন দেশে গণহত্যার খবর দেখেছি। কিন্তু যাদেরকে খুন করা হচ্ছে তাদের গলিত লাশ থেকে পচা দুর্গন্ধ বের হওয়ার খবর কি আপনারা শুনেছেন? কোথায় যাবে এই বেচারা রোহিঙ্গারা? সীমান্তের ঐ পারে বর্মী সেনা গুলি করে তাড়িয়ে দিচ্ছে। ওরা নৌকা করে পালিয়ে প্রাণ বাঁচানোর আশায় নাফ নদী দিয়ে যখন এধারে আসছে তখন বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বা বর্ডার গার্ড ওদেরকে জোর করে ফিরিয়ে দিচ্ছে। শুক্রবারের পত্রপত্রিকায় কয়েকটি অত্যন্ত ডিস্টার্বিং খবর বেরিয়েছে। আরাকান রাজ্যের মংডুর আরও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের দিকে ধাবিত হচ্ছে মিয়ানমারের সাঁজোয়া বাহিনী। প্রতিদিনই রোহিঙ্গা মুসলিম নির্মূলে পরিচালিত কিয়ারেন্স অপারেশনে সৈন্য সমাবেশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। একই সাথে বাড়ছে গণধর্ষণ।
সাঁজোয়া বহরে নতুন করে যুক্ত হয়েছে হেলিকপ্টার গানশিপ, মর্টারশেলবাহী কামান ও মেশিনগান। এসব ভারি অস্ত্র নিয়ে অসহায় গ্রামবাসীর ওপর সৈন্যরা হামলে পড়ছে। ইতোমধ্যে বর্মী বাহিনীর ধ্বংস করে দেয়া গ্রামগুলো থেকে বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে লাশ পচা গন্ধ। এরই মধ্যে ২২টি গ্রাম পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। হেলিকপ্টার গানশিপ থেকে রোহিঙ্গা পল্লীতে গুলি করা হয়েছে। মংডুর উত্তরাঞ্চলে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী নাফ নদী সরু থাকায় যেসব রোহিঙ্গা প্রাণে বেঁচে গেছে তারা নতুন আশ্রয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। এতে পালিয়ে আসা নারী-পুরুষদের প্রাণ রক্ষা হলেও এবারের অভিযানে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কারো আর পালিয়ে যাওয়ারও সুযোগ নেই। কারণ সেনাবাহিনী দক্ষিণে অগ্রসর হয়ে রোহিঙ্গাদের কোণঠাসা করে ফেলছে। এখন তাদের পালানোর একমাত্র জায়গা সমুদ্র। আর প্রাণ বাঁচাতে সাগরে ঝাঁপ দিয়েও কোনো লাভ নেই। কেননা সাগর পাড়ি দেয়া কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।
দুনিয়াবাসীর সামনে এখন একথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, বাংলাদেশ যদি তাদেরকে আশ্রয় না দেয় তাহলে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলমানের করুণভাবে মৃত্যুবরণ করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে কড়া ভাষায় মিয়ানমারের সমালোচনা করেছে মুসলিমপ্রধান দেশ মালয়েশিয়া। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ‘জাতিগত নির্মূল’ অভিযান চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে দেশটি। শুক্রবার মিয়ানমারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে মালয়েশিয়ার বিবৃতি তাদের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করছে যা এসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনস (আশিয়ান)-এর নীতির পরিপন্থী। এমন মন্তব্যের প্রেক্ষিতে মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, একটি নির্দিষ্ট জাতির ওপর দমন-পীড়ন চালিয়ে তাদের অন্যত্র স্থানান্তরের অপর নাম ‘জাতিগত নির্মূল’ অভিযান। দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও সমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনার জন্য এ ধরনের চর্চা এখনও বন্ধ করা উচিত। তিনি আরো বলেন, রোহিঙ্গা বিষয়টি এখন মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। কেননা মালয়েশিয়া ও মিয়ানমার সীমান্তবর্তী অন্যান্য দেশে যেভাবে রোহিঙ্গা শরণার্থীর পরিমাণ বাড়ছে, তাতে এটি আন্তর্জাতিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।



 

Show all comments
  • রিফাত ৪ ডিসেম্বর, ২০১৬, ২:৫৭ এএম says : 0
    তার নোবেল ফিরিয়ে নেয়া হোক।
    Total Reply(0) Reply
  • রাজিব ৪ ডিসেম্বর, ২০১৬, ২:৫৮ এএম says : 0
    বিশ্ববাসী চুপ কেন এখনও এটাই আমার বুঝে আসে না।
    Total Reply(0) Reply
  • সৈয়দ আবদুল মতিন ৪ ডিসেম্বর, ২০১৬, ৮:৫০ এএম says : 0
    রোহিংগারা মুসলমান না হয়ে অন্য ধর্মের হলে বিশ্ব সম্প্রদায়নঅনেক আগেই ব্যবস্থা গ্রহন করত।
    Total Reply(0) Reply
  • MD. DILWAR HUSSAIN ৪ ডিসেম্বর, ২০১৬, ৯:২৬ এএম says : 0
    বিশ্ববাসী আর চুপ থেকোনা প্লীজ রোহিঙ্গাদের বাচাতে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিন।দেয়ালে পিঠ আটকে গেলে রোহিঙ্গা মমুসলিমদের প্রতিবাদ জানানোর ভাষাকে জংগী বলার জন্যই কি বিশ্ব বিবেক নিরব ভুমিকা পালন করছে?
    Total Reply(0) Reply
  • Kasem ৪ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০৫ পিএম says : 0
    সুচী কোন মুখোশ পরে নাই । সুচী কখনোই মুসলমানের পক্ষে টু শব্দটি করে নাই । সুচী সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের নিয়ে ক্ষমতা যাওয়ার চেষ্টা করেছে এবং ক্ষমতা পেয়েছে ।
    Total Reply(0) Reply
  • Hasan Mohammad Akram ৪ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০৬ পিএম says : 0
    .......... সুচি
    Total Reply(0) Reply
  • Mezbah Uzzaman Anik ৪ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০৭ পিএম says : 0
    rule out her nobel prize
    Total Reply(0) Reply
  • Akhtar Raquib Hamid ৪ ডিসেম্বর, ২০১৬, ৮:১৯ পিএম says : 0
    Why not we 57 Muslim Countries make a joint Military strike inside Myanmar and Stop the criminal agration against Myanmar muslim community ?! Therefore Rohingyas can establish their legality .
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রোহিঙ্গা

১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ