Inqilab Logo

বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ০১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৬ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

মিশরে হিজাব পরায় যেভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন নারীরা

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২৭ আগস্ট, ২০২২, ৯:২৩ পিএম

মিশরে যে নারীরা হিজাব পরেন, তারা নানা ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এই প্রবণতা মিশরের সংবিধান লঙ্ঘনের শামিল, যেখানে ধর্ম, লিঙ্গ, বর্ণ বা সামাজিক অবস্থান দেখে কোনরকম বৈষম্য করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিবিসি নিউজ অ্যারাবিকের একটি অনুসন্ধানে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

মিশরের অনেক নারী ২০১৫ সাল থেকে সামাজিক মাধ্যমে অভিযোগ করছেন যে, হিজাব পরার কারণে তারা এইরকম বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এরকম একজন কায়রোর একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ২৫ বছর বয়সী নির্বাহী কর্মকর্তা মায়ার ওমর। তিনি বলছেন, বেশ কয়েকটি দামী রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়ে তিনি এরকম সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন। ''আপনি হয়তো কোন অনুষ্ঠানে গেলেন, কিন্তু কেউ আপনাকে কোন গুরুত্ব দিচ্ছে না, তখন আপনার একাকী মনে হবে। অথবা আপনার হয়তো মনে হতে শুরু করবে যে, আপনি বন্ধু বা অন্যদের সমস্যায় ফেলেছেন,'' তিনি বলছেন।

সামাজিক মাধ্যমে হিজাব বিষয়ক একটি গ্রুপের মাধ্যমে বিবিসি অ্যারাবিক দেখতে পেয়েছে, হিজাব পরার কারণে মিশরের নারীরা সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন, এমন প্রবণতা বাড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে শুধুমাত্র হিজাব পরার কারণে তাদের অনেক স্থানে ঢুকতে দেয়া হয়নি। ''অনেক ক্ষেত্রে মূল কারণটি হলো, শ্রেণি বিভাজন করে ফেলা,'' বলছেন আইনজীবী এবং নারী অধিকার কর্মী নাদা নাশাত। ''যেসব অনুষ্ঠানস্থলে হিজাবি নারীদের প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি, তারা নিজেদের উচ্চ মধ্যবিত্ত বা উচ্চ বিত্ত হিসাবে উপস্থাপন করতে চায়। তবে হিজাব পরে না, এমন নিম্নবিত্ত নারীদের ক্ষেত্রেও বৈষম্য করতে দেখেছি।''

কায়রোয় যেসব কেন্দ্রের বিরুদ্ধে হিজাব পরা নারীদের প্রতি বৈষম্যের অভিযোগ উঠেছে, এরকম ১৫টি কেন্দ্রে বুকিং দেয়ার চেষ্টা করেছিল বিবিসি অ্যারাবিক। বেশিরভাগ কেন্দ্র থেকে অতিথিদের সামাজিক মাধ্যম প্রোফাইলের তথ্য চাওয়া হয়েছে। ১১টি প্রতিষ্ঠান থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, মাথা ঢেকে কাউকে সেখানে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না। বিবিসি অ্যারাবিকের পক্ষ থেকে এক দম্পতিতে গোপনে এসব কেন্দ্রে পাঠানো হয়। ওই নারী হিজাব পরেছিলেন।

যামালেক এলাকায় এল'অবারজিন নামে এক রেস্তোরাঁর রক্ষী ঢোকার মুখেই সাফ জানিয়ে দেন, মাথায় হিজাব পরে সেখানে প্রবেশ করা যাবে না। কারণ ভেতরে একটি মদের দোকান রয়েছে, ফলে হিজাব পরা কোন নারীকে সেখানে যেতে দেয়া হয় না। এমনকি ম্যানেজার এসে জানিয়ে দেন, এখানে মাথায় কাপড় দেয়া নিষিদ্ধ। পরবর্তীতে এসব আলাপের রেকর্ডিং যখন তাদের শুনানো হয়, এল'অবারজিন দাবি করে, ''এটি পুরোপুরি সত্য না।'' এবং হিজাব পরা নারীদের প্রবেশ করতে না দেয়ার কোন নীতি তাদের প্রতিষ্ঠানের নেই। তবে তারা বলেছে, ''আমরা এটিকে নিরুৎসাহিত করি।''

প্রতিষ্ঠানটি বিবিসিকে বলেছে,''আমাদের প্রতিষ্ঠানের নীতি সম্পর্কে কর্মীদের ভালোভাবে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতে কোন বিভ্রান্তি তৈরি না হয়।'' ওই এলাকার আরেকটি রেস্তোরাঁ কাজানেও প্রবেশ করতে গেলে ওই দম্পতিকে আটকে দেয় দ্বাররক্ষী। তিনি সরাসরি বলে দেন, ''সমস্যা হলো আপনার মাথার কাপড়''। "কেন?" জানতে চাওয়া হলে তার উত্তর আসে, ''এটাই আমাদের প্রতিষ্ঠানের নীতি।''

হেলিওপোলিসের একটি রেস্তোরাঁ, আন্দিয়ামোয় প্রথমে এই দম্পতিকে ভেতরে প্রবেশে বাধা দেয়া হয়। পরবর্তীতে ম্যানেজারের সঙ্গে এ নিয়ে কথা হলে, তিনি শর্ত দিয়ে বলেন, তারা ভেতরে প্রবেশ করতে পারে, তবে একটি কোনায় তাদের বসে থাকতে হবে। ''এটা পর্যটন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা। তারা যদি বার এলাকায় কোন হিজাবি নারীকে দেখতে পায়, তাহলে আমাদের জরিমানা করবে,'' তিনি বলেন। তবে এই বিষয়ে বিবিসির পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে কাজান বা আন্দিয়ামো কর্তৃপক্ষ কোন মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

মিশরের পর্যটন ও রেস্তোরাঁ সমিতির চেয়ারম্যান আদেল আল মাসরির কাছে এসব তথ্য প্রমাণ দেখিয়েছিল বিবিসি অ্যারাবিক। ''পর্যটন মন্ত্রণালয়ে কোন সময়েই বোরকা বা হিজাব পরা নারীদের (অবকাশ কেন্দ্রে) প্রবেশ নিষিদ্ধ করার মতো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। যেকোনো ধরনের বৈষম্য অগ্রহণযোগ্য, এগুলো তো সব জনগণের জায়গাই,'' তিনি বলেছেন।

অনুসন্ধানে বিবিসি অ্যারাবিক আরও জানতে পেরেছে যে, হিজাব পরা নারীদের কাছে অবকাশকালীন অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করে না সেদেশের একটি বড় আবাসন কোম্পানি লা ভিস্তা। কায়রো এবং উপকূলীয় বেশ কয়েকটি শহরে এই কোম্পানির প্রকল্প রয়েছে। অতীতে যদিও তারা হিজাবি নারীদের কাছে অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করেছে। কিন্তু বিবিসি দেখতে পেয়েছে, সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই লা ভিস্তাকে তাদের নীতি বদলানোর আহ্বান জানাচ্ছে। বহুজাতিক একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করা একজন নারী নির্বাহী বিবিসি অ্যারাবিককে বলেছেন, লা ভিস্তায় একটি অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে বেশ কয়েকটি মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু তারা বলেছে, হিজাব পরা কারোর লা ভিস্তায় অ্যাপার্টমেন্ট কেনা বেশ কঠিন।

একজন ক্রেতা সেজে বিবিসি অ্যারাবিক ছয়টি মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে, যাতে তারা লা ভিস্তার একটি উপকূলীয় প্রজেক্টে অ্যাপার্টমেন্ট কিনে দিতে পারে। এই ক্রেতার স্ত্রী একজন হিজাব পরা নারী, এভাবে তাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু সবগুলো প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, লা ভিস্তায় অ্যাপার্টমেন্ট কেনা সম্ভব নয়। একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বিবিসির ছদ্মবেশী প্রতিবেদককে বলেছেন, ''আপনাকে খোলাখুলিভাবে বলছি, আপনাদের বিকল্প কিছু দেখা উচিত।'' আরেকজন বলেছেন, ''উত্তর উপকূল আর সোকনার প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে, তারা বেশ বৈষম্য করে থাকে।''

একজন মধ্যস্থতাকারী পুরো প্রক্রিয়াটি ব্যাখ্যা করেছেন। ''তারা বলবে না যে, এই প্রকল্প আপনার কাছে বিক্রি করা হবে না। তারা বলবে, আপনি যে প্রকল্পে অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে চাইছেন, সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। যখন সেটা আবার চালু হবে, আমরা আপনাকে ফোন করবো। আর সেটা কখনোই ঘটবে না।'' যখন বিবিসির ছদ্মবেশী সংবাদদাতা লা ভিস্তায় ফোন করেন এবং জানান যে, তার স্ত্রী নিয়মিত হিজাব পরেন, তখন তাকে বলা হয় যে, কোন প্রকল্পে অ্যাপার্টমেন্ট খালি নেই, তাকে অপেক্ষমাণ তালিকায় রাখা হচ্ছে।

এর বেশ কয়েক সপ্তাহ পরে বিবিসির সংবাদদাতা লা ভিস্তা কার্যালয়ে যান। এবার তিনি স্ত্রীর হিজাব পরার বিষয়ে কিছু বলেননি। তাকে সাথে সাথেই জানানো হয় যে, বিক্রির জন্য তাদের অ্যাপার্টমেন্ট ইউনিট খালি আছে। সেখানে কী ধরনের মানুষ বসবাস করেন, জানতে চাওয়া হলে কোম্পানির এজেন্ট বলেন, ''আমাদের ইচ্ছা হলো, সেখানে বসবাসকারী সবাই বেশভূষায় যেন একই রকমের হন।'' তিনি আরও বলেন, ''লা ভিস্তার কোন প্রকল্পেই বোরকা পরা কোন নারী থাকেন না।''

এরপর বিবিসির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে লা ভিস্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও এখনো তাদের কোন জবাব পাওয়া যায়নি। নারী অধিকার নিয়ে কাজ করেন, মিশরীয় সংসদ সদস্য আমিরা সাবের বলেছেন, মিশরের সংবিধানে পরিষ্কার করে বলে দেয়া আছে, এরকম বৈষম্য কারও সাথে করা যাবে না। ''আমার পার্লামেন্টারি ক্ষমতা ব্যবহার করে সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে আমি জানতে চাইবো, কীভাবে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা বন্ধ করা যায়। এরপরও যদি তা ঘটে, তাহলে অবশ্যই দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনার ব্যবস্থা করা হবে,'' তিনি বলেছেন। সূত্র: বিবিসি।



 

Show all comments
  • jack ali ২৭ আগস্ট, ২০২২, ১০:২০ পিএম says : 0
    ও আল্লাহ মিশরের সিসি তাগুত সরকারকে আল্লাহ তুমি ওকে ধ্বংস করে দাও ওর উপরে গজব নাজিল করো আমাদের সামনে ওকে শাস্তি দাও তাহলে আমরা একটু শান্তি পাব মিশরে তুমি আল্লাহ কোরআনের আইন দিয়ে দেশ শাসন করো তাহলে মানুষরা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারবে
    Total Reply(0) Reply
  • Dinislam ২৮ আগস্ট, ২০২২, ৯:৫০ এএম says : 0
    বর্তমান সময়ে ইসলামিক স্কলার বলে আমরা যাদেরকে চিনি জানি সবাই নিজ ধান্ধায়
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ