হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
জামালউদ্দিন বারী : প্রায় পাঁচ বছর ধরে চলমান সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে গত অক্টোবরে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের পর পতনের দ্বারপ্রান্তে থাকা প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের অনুগত বাহিনী এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে। রুশ বিমান হামলার সহায়তা নিয়ে তারা ইতোমধ্যে বিদ্রোহীদের কাছ থেকে কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শহর আলেপ্পোর উপর নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে আইএসের দখলে থাকা রাকা অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে। দুই বছরের বেশি সময় ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনী সিরিয়া ও ইরাকে আইএস দমনে জোটগতভাবে সামরিক হামলা অব্যাহত রাখলেও আইএসের অগ্রযাত্রা প্রতিহত করা যাচ্ছিল না। এ সময়েও আইএস নতুন নতুন শহর এবং এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপের পর সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল আসাদ আবারো তার অনমনীয় ভূমিকায় ফিরে এসেছেন। তিনি এখন বিদ্রোহী ও আইএস হটিয়ে পুরো সিরিয়ায় নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিচ্ছেন। সিরিয়ার শাসক হিসেবে সিরিয়াকে একটি অখ- রাষ্ট্র হিসেবে টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে তার এই ঘোষণা অস্বাভাবিক বা অনাকাক্সিক্ষত নয়। তবে মধ্যপ্রাচ্যের চলমান জটিল বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য করারও কোন উপায় নেই। এই বাস্তবতায় নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক বাশার আল আসাদের শাসনক্ষমতা অব্যাহত রাখার কোন সুযোগ নেই। মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়া, ইরাক, তুরস্ক, সৌদি আরব, ইরানসহ বিভিন্ন দেশের পরস্পরের মধ্যে যে জটিল ভূ-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সমীকরণ রয়েছে তারই প্রেক্ষাপটে পক্ষগুলো প্রেসিডেন্ট বাসারের লিগ্যাসি, বিদ্রোহী, আইএস এবং শিয়া-সুন্নী মতভেদ নিরসনে যার যার অবস্থানে অনড় থাকায় ৫ বছরের রক্ষক্ষয়ী সংঘাতে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে এবং প্রায় ৫০ লাখ মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে। কার্যত সিরিয়া ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এরপরও সমাধানের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। রাশিয়ার হস্তক্ষেপের পর বিদ্রোহীরা অনেকটা কাবু হয়ে পড়ায় শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় বাশারের প্রস্থান এবং সিরিয়ায় একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সবপক্ষকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসা অনেকটা সহজ হয়ে যায়। দীর্ঘ প্রত্যাশিত সেই আলোচনা ও সমঝোতার উদ্যোগটিও অবশেষে বাস্তবতার কাছাকাছি এসে ধরা দেয় জার্মানির মিউনিখে। মিউনিখে সবপক্ষকে এক টেবিলে উপস্থিত করা বিশ্ব সম্প্রদায়ের একটি বড় অর্জন হিসেবেই গণ্য হতে পারে। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ অবসানে যখন পক্ষগুলো প্রাথমিকভাবে একটি শান্তিপূর্ণ উদ্যোগের কাছাকাছি অবস্থান করছিল, ঠিক তখনই তুরস্ক সীমান্ত থেকে নতুন উত্তেজনা ও যুদ্ধের নতুন উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। বাশারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ইতোমধ্যেই সৌদি আরব শত শত যুদ্ধ বিমান, ট্যাঙ্ক এবং সৈন্য পাঠাতে শুরু করেছে। বিদ্রোহীদের সহায়তায় ন্যাটো, সৌদি আরব, তুরস্কের এ ধরনের যে কোন উদ্যোগের বিরুদ্ধে রাশিয়া আগেই কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিল। এ ধরনের পদক্ষেপ একটি বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করতে পারে বলেও রাশিয়াসহ কোন কোন পক্ষ আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। একদিকে শান্তি আলোচনা, অন্যদিকে নতুন রণদামামা এই দ্বৈত বাস্তবতায় পরাশক্তিগুলো আরেকটি মহাযুদ্ধের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে রিজাইম চেঞ্জসহ আবারো ভাগ-বাটোয়ারার পুরনো নীল নকশার বাস্তবায়ন ঘটাতে চলেছে বলে আশঙ্কা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
সিরিয়ায় একটি যুদ্ধবিরতির আন্তর্জাতিক উদ্যোগ কাজ করবে না বলে ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোশে ইয়ালন মত দিয়েছেন। মিউনিখে সিরিয়া বিষয়ক শান্তি আলোচনা চলাকালে অনাহুতভাবে ইসরাইলি মন্ত্রী সেখানে উপস্থিত হয়ে জর্দানের বাদশা এবং ইউরোপীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে গণমাধ্যমের কাছে প্রদত্ত বিবৃতিতে ইসরাইলি মন্ত্রীর বক্তব্যে একটি ভিন্নতর ও স্পষ্ট মেসেজ পাওয়া গেছে। তা হচ্ছে, ইসরাইল মনে করছে, আন্তর্জাতিক যুদ্ধবিরতির উদ্যোগ কোন কাজে আসবে না, সিরিয়াকে গোষ্ঠীগতভাবে বিভক্ত করাই হবে সঠিক সিদ্ধান্ত। আমরা স্মরণ করতে পারি, প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর পশ্চিমা ঔপনিবেশিক সা¤্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো মধ্যপ্রাচ্য ও জার্মানীতে এই কাজটিই করেছিল। যুদ্ধের পটভূমি মূলত ইউরোপ হলেও যুদ্ধের আগে ও পরের মূল লক্ষ্যবস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছিল তুরস্কের উসমানীয় সালতানাত এবং মধ্যপ্রাচ্যকে বহুধা বিভক্ত করে সেখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ও পশ্চিমা প্রটেকটরেট সৃষ্টি করা। আর এই বিভক্তি রেখা সৃষ্টির পেছনে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ফায়দা হাসিলের সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ছিল। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বালফোর তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইহুদি কমিউনিটি নেতা ওয়াল্টার রথচাইল্ডের কাছে কয়েক লাইনের চিঠিতে লেখা অঙ্গিকারপত্রটিই ঐতিহাসিকভাবে বালফোর ডিক্লারেশন হিসেবে খ্যাত। এই ডিক্লারেশনের ভিত্তিতেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৮ সালে ইঙ্গ-মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতায় ফিলিস্তিনের আরব ভূমিতে জবরদস্তিমূলকভাবে ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ইহুদি রাষ্ট্র সৃষ্টিতে ইঙ্গ-মার্কিনীদের পরিকল্পনায় রাশিয়া মদদ যোগায় প্রথমেই ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়ে অরাজনৈতিক ও অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ইসরাইল রাষ্ট্রের সৃষ্টির পর থেকে ইসরাইলকে টিকিয়ে রাখা, স্বীকৃতি এবং আধিপত্য বজায় রাখার প্রতি পশ্চিমাদের মধ্যপ্রাচ্যনীতি আবর্তিত হচ্ছে। পশ্চিমাদের এই নীতি গত সাত দশক ধরে বিশ্বশান্তির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। আরব মুসলমানদের জমি দখল এবং বুলডোজার দিয়ে বাড়িঘর, মসজিদ-মাদরাসা ও খামারগুলো গুঁড়িয়ে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে আরবরা কখনো রাষ্ট্র হিসেবে ইসরাইলকে মেনে নিতে পারেনি। উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনিরা তাদের জমিজমা ও বাড়িঘর ফিরে পাওয়ার জন্য আমরণ জিহাদ চালিয়ে যেতে সবসময়ই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল, এখনো আছে। তবে ফিলিস্তিনিদের সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতেই ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ইসরাইল নতুন করে সিরিয়া, মিশর ও জর্দানের কাছ থেকে বিশাল ভূমি দখল করে নেয়, যা ইসরাইলের ১৯৪৮ সালের আয়তনের চেয়েও অনেক বেশি। ইঙ্গ-মার্কিন সামরিক সহায়তা নিয়ে গোলান মালভূমিসহ অধিকৃত ভূ-ভাগ দখলে রাখার পাশাপাশি এসব জমি ফেরত পাওয়ার শর্ত হিসেবে ইসরাইলের সাথে মিশর, সিরিয়া ও জর্ডানের শাসকদের শান্তিচুক্তিতে উপনীত হতে বাধ্য করা হয়। এভাবেই আরব শাসকরা ইহুদিদের দখলদারিত্ব থেকে বাইতুল মোকাদ্দাস পুনরুদ্ধার এবং ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামের কথা ভুলে গিয়ে নিজেদের স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে পশ্চিমাদের সমর্থন লাভের শর্ত হিসেবে ইসরাইলের সাথে আপস ও গোপন সমঝোতায় উপনীত হতে বাধ্য হয়।
যেহেতু পশ্চিমাবিশ্ব এখনো মধ্যপ্রাচ্যের তেল সম্পদের উপর নির্ভরশীল, এ কারণে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ চিরস্থায়ী করতে ইসরাইলকে মধ্যপ্রাচ্যের ডি-ফ্যাক্টো শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রাখার পাশাপাশি আরবদের নানাভাবে বিভক্ত ও পারস্পরিক হানাহানিতে লিপ্ত রাখার নীতি বাস্তবায়ন করেছে পশ্চিমারা। নানা ইস্যুতে আমেরিকা-রাশিয়া-চীন-ব্রিটেনসহ ইউরোপ এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলো একক প্লাটফর্মে দাঁড়াতে পারলেও ভাষাগত ও ধর্মীয় ভ্রাতৃত্বের অটুট সাংস্কৃতিক বন্ধনে আবদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের শাসকরা জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার প্রশ্নে কখনো ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। ওআইসি বা আরবলীগের মতো সংস্থাগুলো কখনোই পশ্চিমাদের ইচ্ছার বাইরে পরিচালিত হতে পারেনি। গাজায় ইসরাইলের গণহত্যা, ইরাক বা আফগানিস্তানে সা¤্রাজ্যবাদী সামরিক আগ্রাসনেও এসব সংস্থাকে কখনো জোরালো ভূমিকা রাখতে দেখা যায়নি। তবে গত দশকে লিবীয় নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আরবলীগ ও আফ্রিকান ইউনিয়নকে একটি শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনায় অনেকটা সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিলেন। পশ্চিমাদের পৃষ্ঠপোষকতায় কথিত বিদ্রোহে মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে হত্যা এবং লিবিয়াকে একটি অকার্যকর খ--বিখ- রাষ্ট্রে পরিণত করার পেছনে সম্ভবত যে বিষয়টি ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তা হচ্ছে আরব জাতীয়তাবাদ ও আফ্রিকান ঐক্যপ্রক্রিয়ায় গাদ্দাফির ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের সাফল্য পশ্চিমা পুঁজিবাদী স্বার্থের জন্য হুমকি হিসেবে গণ্য হচ্ছিল। লিবিয়ায় বিদ্রোহ এবং গৃহযুদ্ধের শুরুতেই আফ্রিকান ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় একটি সমঝোতা ও শান্তিচুক্তিতে উপনীত হওয়ার যে সম্ভাবনা ২০১১ সালে দেখা দিয়েছিল, বিমান হামলার মাধ্যমে ন্যাটো বাহিনী তা নস্যাৎ করে দেয়। আফ্রিকার ৫টি দেশের নেতাদের নিয়ে গঠিত সমঝোতা উদ্যোগকে সফল করতে এসব নেতাদেরকে গাদ্দাফি ও বিদ্রোহীদের সাথে বৈঠক ও সমঝোতার উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে যায়। ন্যাটো ও ফরাসী বিমান হামলার মধ্য দিয়ে যেভাবে লিবিয়ায় গাদ্দাফির পতন ও বিদ্রোহীদের বিজয় নিশ্চিত করা হয়েছিল, ঠিক একইভাবে সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের সবধরনের মদত দিয়ে লাখ লাখ মানুষ হত্যা করেও প্রেসিডেন্ট বাশারের পতন ত্বরান্বিত করা সম্ভব হয়নি।
সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের রক্ষা করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনীর বিমান হামলা অথবা স্থলসেনার উপস্থিতি সেখানে দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে একটি বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা ক্রমে ঘনীভূত হয়ে চলেছে। মিউনিখে শান্তি আলোচনায় পশ্চিমাদের লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্লান বি’ দ্বিতীয় পরিকল্পনা অনুসারে সেখানে আরো কঠোর সামরিক হস্তক্ষেপ ও স্থলসেনা প্রেরণের কথা জানা যায় মিডিয়ায় প্রকাশিত রিপোর্টে। এ ধরনের যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত পারমাণবিক সংঘাতে পরিণত হলে বিশ্বের জন্য তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চেয়েও অনেক ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। রাশিয়া এবং ন্যাটোসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সা¤্রাজ্যবাদী মর্যাদার লড়াইয়ের মূল প্রতিপক্ষ হলেও এই যুদ্ধের ময়দানটি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বিস্তৃত হওয়ায় মুসলমানদের হত্যা এবং মুসলিম দেশগুলোকে দখল এবং ভাগ-বাটোয়ারা করার মধ্য দিয়েই এই যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারিত হতে পারে। এ কথা সকলেরই জানা যে, একমাত্র ইসরাইল ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের আর কোন দেশের হাতে পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র নেই। ইসরাইল ও পশ্চিমা বশংবদ রাজশক্তির বাইরে মধ্যপ্রাচ্যে বড় কোন স্বাধীনচেতা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শক্তির অস্তিত্ব থাকা ইসরাইলের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত হয়। এ ধরনের যেকোন আশঙ্কা সমূলে ধ্বংস করা পশ্চিমাদের একটি স্থায়ী নীতি হিসেবে গৃহীত। ইতোমধ্যে সিরিয়ায় পাঁচ লাখের বেশি মানুষ যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে, প্রায় ২০ লাখ মানুষ আহত হয়েছে, ৫০ লাখের বেশি মানুষ গৃহহীন হয়েছে। এই মুহূর্তে ইউরোপের বিভিন্ন সীমান্তে, সমুদ্রে এবং সিরিয়ার অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে আটকে থাকা কয়েকলাখ মানুষ যুদ্ধের বিভীষিকা, খাদ্যাভাবসহ নানাভাবে মৃত্যুর ঝুঁকিতে বসবাস করছে। ইউরোপের বিভিন্ন রিফিউজি ক্যাম্প থেকে ১০ হাজারের বেশি সিরীয় শিশুর কোন হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানী ও অধিকৃত দেশগুলোর ইহুদি জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগের চিত্রকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। এর আগে ন্যাটোর সামরিক আগ্রাসনে ইরাকে এবং আফগানিস্তানে ২০ লাখের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, এখনো তা অব্যাহত আছে। সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন, সুদানসহ মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বিরতিহীনভাবেই মুসলমানের রক্তপাত চলছে। এই মুহূর্তে ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া, সুদান ও ফিলিস্তিনসহ বিভিন্ন দেশের লাখ লাখ শিশু একদিকে যেমন সরাসরি সামরিক হামলার শিকার হচ্ছে, অন্যদিকে ক্ষুধা, অপুষ্টি, রোগ-ব্যাধিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সীমান্তে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অভিবাসন প্রচেষ্টায় জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদীরা ক্ষুধা-দারিদ্র্য ও মৃত্যু ঝুঁকির সম্মুখীন মানুষদের রক্ষায় কোন উদ্যোগ না নিলেও প্রতি বছর ইসরাইলের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি ও আধিপত্য নিশ্চিত রাখতে কয়েশ’ কোটি ডলার ব্যয় করছে। ইসরাইলের জন্য দেয়া সামরিক সহায়তার শতকরা একভাগ অর্থ দরিদ্র, উদ্বাস্তু ও ভাগ্যাহত মুসলমান শিশুদের নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে ব্যয়িত হলে আগামী বিশ্ব আরো সুন্দর হতে পারতো। কিন্তু মুসলমানদের সন্তানরা সুশিক্ষা ও সুস্বাস্থ্য নিয়ে নিরাপদে বেড়ে উঠলে ইসরাইল ও পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী চক্রের কোন স্বার্থ রক্ষা হয় না।
সিরিয়া ও ইরাকে আইএস দমনের কথা বলা হলেও মধ্যপ্রাচ্যে ন্যাটো এবং রাজাদের সামরিক তৎপরতার লক্ষ্য যার যার মত ভিন্ন ভিন্ন। তবে ইসরাইলের লক্ষ্য হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যের বড় এবং শক্তিশালী দেশগুলোকে ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে পরিণত করা এবং সেখানে পশ্চিমা ও ইসরাইলের বশংবদ শাসক বা নতুন ডায়নেস্টি সৃষ্টি করা। আইএস হুমকি মোকাবেলার প্রশ্নে এখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ন্যাটো, সিরিয়া, সৌদি আরব, ইরান বা তুরস্কের মধ্যে তেমন কোন প্রকাশ্য মতভেদ দেখা যায়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যেভাবে হিটলার-মুসোলিনির ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে চরম বৈরীশক্তি রাশিয়া-আমেরিকার ঐক্য গড়ে উঠেছিল, এখন ন্যাটোর অভিযান সত্ত্বেও সিরিয়া ও ইরাকে আইএসের ক্রমবিস্তৃতির প্রেক্ষাপটে আইএস দমনে রুশ-মার্কিন ঐক্যই ছিল অনিবার্য বাস্তবতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত মিত্রশক্তি হিসেবে রাশিয়ার পাশাপাশি হিটলারের বাহিনীকে মোকাবেলায় এগিয়ে আসার ফলেই মিত্রশক্তির বিজয় নিশ্চিত হয়। এর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্য জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা মেরে মানবেতিহাসের এক ভয়ঙ্কর গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত করতে হয়েছিল। ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত চলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ বছরটি ছিল সবচেয়ে নাটকীয়, ভয়ঙ্কর, ধ্বংসাত্মক। আগস্টের ৬ ও ৯ তারিখে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে এটম বোমা ফেলার মধ্য দিয়ে যুদ্ধের শেষ অঙ্কের পরিসমাপ্তি ঘটলেও মূলত রুশ-মার্কিন ঐক্যের মধ্য দিয়েই সেই যুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। মধ্যপ্রাচ্যে ১২ বছর ধরে চলা ন্যাটোর সামরিক আগ্রাসন ও রিজাইম চেঞ্জ পরিকল্পনার কথা বাদ দিলেও সিরিয়ায় পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট বিদ্রোহীদের গৃহযুদ্ধ ইতোমধ্যে ৫ বছরে পর্দাপণ করেছে। আগেও উল্লেখ করা হয়েছে, গত অক্টোবরে রাশিয়ার বিমান হামলার মধ্য দিয়ে সিরিয়ায় যুদ্ধের ফলাফল ১৯০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের অনুগত বাহিনী বিদ্রোহীদের কাছ থেকে আলেপ্পো পুনর্দখলের পর এখন আইএসের নিয়ন্ত্রণাধীন রাকা দখলের প্রস্তুতি চালাচ্ছে বলে জানা যায়। সমগ্র বিশ্বের সর্বাধুনিক ও সর্বোচ্চ সমরশক্তির সামনেও আইএস যোদ্ধাদের অগ্রযাত্রা ছিল বিষ্ময়কর। রাকা হচ্ছে আইএস র ঘোষিত রাজধানী ও সামরিক হেডকোয়ার্টার। রাকায় তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে আইএস সর্বোচ্চ শক্তি ও কৌশল গ্রহণ করবে, এটা প্রায় নিশ্চিত। এহেন বাস্তবতাকে সামনে রেখে আইএস নির্মূলে সিরীয় সরকারি বাহিনীর পাশাপাশি রুশ-মার্কিন সামরিক ঐক্য বিশ্বের কাছে আরেকটি ইতিবাচক ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারত। লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু এবং হাজার বছরের ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার সিরিয়ার সমৃদ্ধ জনপদগুলোকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়ার জন্য দায়ী বাশার আল আসাদ ক্ষমতায় থাকবে কি থাকবে না, সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে সে দেশের জনগণ। বিশ্বসম্প্রদায় ও জাতিসংঘ শুধু বাশারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত একটি অবাধ-নিরপেক্ষ গণভোটের ব্যবস্থা করবে। তার আগে সেখানে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং সিরিয়ার অখ-তা ফিরিয়ে আনতে হলে প্রথমেই বিদ্রোহী এবং আইএস গেরিলাদের নিরস্ত্র করতে হবে।
মধ্যপ্রাচ্যের রিজাইম চেঞ্জসহ পুরো মানচিত্রটি বদলে ফেলার পুরনো নীলনকশা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি বড় আকারের বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত করার বিকল্প পন্থা হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানীকে বিভক্ত করার মতো সিরিয়াকে দুই-তিন ভাগে বিভক্ত করার ইসরাইলি পরিকল্পনার বাস্তবায়ন দেখা গেলেও বিষ্ময়ের কিছু থাকবে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক পর্যায়ে ১৯৪৫ সালের এপ্রিলে ফ্যাসিবাদবিরোধী দুই শক্তি রাশিয়া এবং মার্কিন বাহিনীর দুইটি ইনফেনন্ট্রি ডিভিশন দুই দিক থেকে পরিচালিত সমরাভিযানের শেষ পর্যায়ে ২৫ এপ্রিল জার্মানীর এলবি নদীর তীরে এসে মিলিত হয়। এলবি দিবসে রাশিয়ান সেনা কমান্ডার মার্শাল গ্রেগরী ঝুকভ এবং মার্কিন সেনা কমান্ডার ডিউইড ডি. আইসেন হাওয়ারের আলিঙ্গনের সেই ছবিটি আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের স্মারক। রুশ-মার্কিন ধারায় বিভক্ত জার্মানী ইতোমধ্যে তাদের দেয়াল ভেঙে দিয়ে এক হয়ে গেছে। ইউফ্রেটিস বা দজলা ফোরাতের পানিতে রক্তাক্ত ও বারুদে ঝলসানো লাশ যেন অনিঃশেষ। রুশ-মার্কিনীরা এবার সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, ইরান, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যকে নিজেদের মতো করে বিভক্ত করার নতুন খেলায় মেতে উঠলে বহুধা বিভক্ত আরব নেতাদের হয়তো কিছুই করার থাকবে না। এলবি নদীর তীরে সত্তর বছর আগে সা¤্রাজ্যবাদী স্বার্থে যে বিভক্তির দেয়াল গড়ে উঠেছিল তা অর্ধ শতাব্দীর বেশি টেকেনি। ইউফ্রেটিসের তীরে রাকা, আলেপ্পো, বসরা বা মসুলে তেমন কিছু ঘটলেও আরব জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধের মুখে একদিন তা ব্যর্থ হবেই।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।