বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
বিশ্ব জগৎ সৃষ্টি এবং কুল-মাখলুকাতের খলীফা হিসেবে মানুষ সৃষ্টির মধ্যে মহান আল্লাহ পাকের নিজের কোনো স্বার্থ এবং লাভ নেই। কারণ, তিনি সমস্ত লাভ- লোকসান ও স্বার্থ থেকে মুক্ত ও পবিত্র। বরং মানবকুল ও বিশ্ব জগৎ সৃষ্টি আল্লাহ পাকের তাওহীদ বা একত্ববাদেরই দানশীলতার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। ফলে তিনি স্বীয় কুদরতে কামেলার ইশারায় অযাচিতভাবে সৃষ্টি জগৎকে মনোহর অস্তিত্বের নেয়ামতে বিভূষিত করছেন। মহান আল্লাহ পাক হযরত আদম (আ.)-কে পৃথিবীতে খলীফা নিযুক্ত করার পর সর্বপ্রথম যে নেয়ামতে সমৃদ্ধ করেছেন, তা হলো এলেম বা জ্ঞান।
এতদ প্রসঙ্গে আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে : আর আল্লাহ তায়ালা আদমকে সমস্ত বস্তু সামগ্রীর নাম শেখালেন। (সূরা বাকারাহ : ৩১)। এই শিক্ষাই মানুষকে অন্যান্য জীব-জন্তু, জিন ও ফেরেশতা থেকে স্বতন্ত্র এবং সৃষ্টির সেরারূপে চিহ্নিত করেছে। এই জ্ঞান ও এলেমের কারণেই মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত, সৃষ্টির সেরা হিসেবে বরিত ও নন্দিত হয়েছে।
শিক্ষাদান ও জ্ঞানদানের বিষয়টি সাধারণত দু’ভাগে বিভক্ত করে বিশ্লেষণ করা যায়। যথাÑ (এক) মৌখিক শিক্ষাদান এবং (দুই) কলম ও লেখার মাধ্যমে শিক্ষাদান। আল কুরআনে এই উভয়বিধ শিক্ষাদানের পদ্ধতির কথা প্রথম ওহীর মাধ্যমেই সর্বজ্ঞানী আল্লাহপাক তুলে ধরেছেন। মৌখিক শিক্ষাদানের বিষয়টি এভাবে বিবৃত হয়েছে : পাঠ করুন আপনার পালন কর্তার নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। (সূরা আলাক : আয়াত-১-২)।
পিয়ারা নবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) যদিও প্রাথমিক অবস্থায় উম্মী ছিলেন। প্রচলিত লেখাপড়ার ধারা তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। কিন্তু মহান আল্লাহ পাক এই উম্মী ব্যক্তিকে উচ্চতর শিক্ষা, বাকনৈপুণ্য, বিশুদ্ধ ভাষাজ্ঞান, প্রাঞ্জল বর্ণনাশৈলী ও ভাব ব্যঞ্জনার অপূর্ব কৌশল শিক্ষাদান করেন যার সামনে দুনিয়ার সমস্ত বড় বড় পণ্ডিত ব্যক্তিও নিজেদের অক্ষমতার কথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। মহান আল্লাহ পাকই রাসূলূল্লাহ (সা.)-এর শিক্ষাদানের কাজটি পরিপূর্ণ রূপে আঞ্জাম দিয়েছেন। তাই সৃষ্টি জগৎতের কেউই তাঁর শিক্ষক হওয়ার ব্যাপারে ধৃষ্টতা প্রদর্শনের সুযোগ লাভ করেনি।
আর কলম ও লেখনীর সাহায্যে শিক্ষাদানের বিষয়ে আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে : পাঠ করুন, আপনার পালনকর্তা মহা দয়ালু। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা নিয়েছেন। মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা তিনি জানতেন না।
(সূরা আলাক : আয়াত-৩-৫)। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : মহান আল্লাহ পাক আদিকালে যখন সবকিছু সৃষ্টি করেন, তখন আরশে আজীমে তাঁর কাছে রক্ষিত কিতাবে একথা লিপিবদ্ধ করেন যে, আমার রহমত ‘আমার ক্রোধের ওপর প্রবল থাকবে।’ (মোসনাদে আহমাদ)। হাদিস শরীফে আরো বলা হয়েছে : আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করেন এবং লেখার নির্দেশ দেন। সে মতে কলম কেয়ামত পর্যন্ত যা কিছু হবে, সব লিখে ফেলে এ কিতাব আরশে আজীমে আল্লাহর কাছে রক্ষিত আছে। (তাফসীরে কুরতুবী)।
বস্তুত প্রকৃত শিক্ষাদাতা হলেন আল্লাহতায়ালা। তাঁর শিক্ষাদানের মাধ্যম অসংখ্য ও অগণিত। শুধু কলমের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ নয়। তাই বলা হয়েছে যে, ‘আল্লাহ তায়ালা মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে পূর্বে জানত না।’ এই আয়াতে কলম অথবা অন্য কোনো উপায়ের কথা উল্লেখ না করার মধ্যে এই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, আল্লাহ তায়ালার শিক্ষাদানের এই ব্যবস্থা মানুষের জন্মলগ্ন থেকেই অব্যাহত রয়েছে এবং থাকবে। এর কোনো পরিবর্তন হবে না।
স্মরণ রাখা দরকার যে, পূর্ববর্তী ও পরবর্তী যুগের অধিকাংশ আলেম একমত যে, সূরা আলাক (আল কুরআনের ৯৬ নং সূরা) থেকেই ওহীর সূচনা হয়েছে এবং এ সূরার প্রথম পাঁচটি আয়াত সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হয়েছে। কেউ কেউ সূরা মুদ্দাসসিরকে প্রথম সূরা এবং কেউ কেউ সূরা ফাতেহাকে সর্বপ্রথম সূরা বলে অভিহিত করেছেন। তবে জানা থাকা ভালো যে, সূরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত নাযিলের বহুদিন পর পর্যন্ত ওহী নাযিল বন্ধ ছিল। তারপর সূরা মুদ্দাসসিরের কয়েকটি আয়াত নাযিল হয়েছে বিধায় একে প্রথম সূরা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর সূরা ফাতেহা সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ সূরা হিসেবে নাযিল হওয়ায় একে প্রথম সূরা বলা হয়ে থাকে। এতে করে সূরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত প্রথম ওহী হওয়ার ক্ষেত্রে ব্যত্যয় সৃষ্টি হওয়ার কোনো ও সুযোগ নেই।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।