Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গণহত্যার প্রমাণ গোপনে গণকবরে মাটি চাপা

| প্রকাশের সময় : ৩ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

শামসুল হক শাকে, কক্সবাজার অফিস : আরাকান রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন ক্লিন’ নামে রোহিঙ্গা নির্মূল অভিযান আরো তীব্র হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। গত ১০ অক্টোবর থেকে রোহিঙ্গা নির্মূলে সেনা-পুলিশ ও রাখাইন-বুডিষ্ট দস্যুদের এই যৌথ অভিযান শুরু হয়। এতদিন মংডু টাউনশীপের উত্তর দিকে উত্তর আরাকানে (প্রায় দু’মাস ধরে) চলছিল জঘন্যতম নিষ্ঠুর এই অভিযান। গত বৃহস্পতিবার থেকে মংডুর দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের দিকে রোহিঙ্গা মুসলমানদের গ্রামগুলোতে যৌথবাহিনী অভিযান জোরদার করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বিশ্ব সোচ্ছার হওয়ায় গণহত্যার প্রমাণ গোপন করতে যৌথবাহিনী রোহিঙ্গাদের গণকবরে মাটি চাপা দিচ্ছে বলে জানা গেছে।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে মংডুর দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে রোহিঙ্গা বুড়াসিকদার পাড়ার পাশ্বে ‘কিউনংটং’ নামের আশপাশ মুসলিম জনবসতিতে তা-ব চালিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে যৌথবাহিনী। সেখানেও সেনাবহিনী সামরিক হেলিকপ্টার থেকে রোহিঙ্গা পল্লীতে মর্টারশেল নিক্ষেপ ও মেশিনগানসহ ভারী অস্ত্র দিয়ে গুলি করেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সূত্রগুলো। জা¡লিয়ে দেয়া হয় রোহিঙ্গাদের সহায় সম্বল। এতে মিয়ানমারের আরকান রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় পরিস্থিতির দিন দিন আরও অবনতি ঘটছে। ইতোমধ্যে আরাকানের মংডু, বুচিদং আকিয়াবসহ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকার গ্রাম-মহল্লা-পাড়াগুলোর বাড়িঘর প্রায় মানুষ পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে বলেও জানায় ওই সূত্র।
পালিয়ে আশ্রয় নেয়া প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, মিয়ানমারের বর্বর বাহিনী রোহিঙ্গা পুরুষদের পাশবিক কায়দায় নির্বিচারে হত্যা করে। ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে কেটে টুকরো করে, জবাই করে হত্যা করে শিশুদের। আর রোহিঙ্গা নারীদের উপর চলানো হয় পৈশাচিক কায়দায় নির্যাতন ও গণধর্ষণ। সেনা পুলিশ ও সন্ত্রাসীদের ত্রিমুখী নৃশংসায় প্রাণ বাঁচাতে জীবনের সহায়-সম্বল ফেলে যে যেভাবে পারে নাফনদী, সাগর ও পাহাড় পাড়ি দিয়ে পালিয়ে আসছে বাংলাদেশে। এর পরে তাদের ফেলে আসা সহায়-সম্পদ বেপরোয়া লুটপাট করছে সেনা-পুলিশ ও মগদস্যুরা।
এদিকে গত দু’দিনে টেকনাফ উপজেলার চারটি পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা বোঝাই ২১টি নৌকায় আসা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকালে বাধা প্রদান করেছে বিজিবি সদস্যরা। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক মেজর আবু রাসেল ছিদ্দিকী। তবে তিনি জানান, বৃহস্পতিবার ১ ডিসেম্বর ভোরে নাফ নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকালে রোহিঙ্গা বোঝাই ১১টি রোহিঙ্গা নৌকাকে বাধা প্রদান করা হয়েছে। এতে তারা বাংলাদেশে ঢুকতে না পেরে মিয়ানমারে ফেরত যায়। যেসব পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা বেশি প্রবেশের চেষ্টা করছে সেসব পয়েন্টে বিজিবির সর্বোচ্চ নজরদারি আছে। পাশপাশি সীমান্তজুড়ে কঠোর নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে।
স্থানীয় একাধিক সূত্র মতে বুধবার সকাল থেকে মিয়ানমারের আরকান রাজ্যের মংডু এলাকার সানচি প্রাং (হাতি পাড়া) আকাশে টহল দিচ্ছিল সেবাহিনীর হেলিকপ্টার। হেলিকপ্টার থেকে মর্টার সেল নিক্ষেপ করে এবং অন্যদিকে সাজোয়া যান নিয়ে সেনাবাহিনীর সদস্যরা গ্রামটি ঘিরে রেখেছে। এতে দক্ষিণ আরকানের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে এখন আতংক ছড়িয়ে পড়ে। এর আগে উক্ত এলাকায় গত সপ্তাহের বৃহস্পতিবার, শুক্রবারও শনিবার সেনাবহিনীর নৃশংসতায় অসংখ্য রোহিঙ্গা হতাহত হয়েছিল। এই সময় মংডুর আশপাশ এলাকা থেকে রোহিঙ্গা পুরুষদেরকে গণহারে ধরে নিয়ে যায়। অনেক নারীকেও তুলে নিয়ে যায় তারা। এসব নারীরা সেবাবাহিনীর পাবশিকতার শিকার হয়ে সম্ভ্রম হারিয়ে কেউ নিহত হয় বা কাউতে ছেড়ে দেয়া হয় মুমূর্ষু অবস্থায়। সূত্র মতে অভিযানে নিহত শত শত রোহিঙ্গা নারী পুরুষকে যৌথবাহিনী কণকবরে মাটি চাপা দিয়ে কোন প্রমাণ রাখতে চাচ্ছে না।
অন্যদিকে মিয়ানমার বাহিনীর নির্যাতনে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পড়তে হচ্ছে আরো কঠিন সমস্যায়। গত মঙ্গলবার ভোরে টেকনাফের হ্নীলাস্থ নাফনদীর দিয়ে অনুপ্রবেশ করার সময় ৩টি রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকাকে নদীর মাঝপথ থেকে মিয়ানমারের দিকে ঠেলে দেয়। এতে ওপারে নাফনদীতে ওৎপেতে থাকা বর্ডার গার্ড পুলিশ রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকাকে লক্ষ্য করে বেপরোয়া গুলি ছুড়ে। ঘটনাস্থলে একটি রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকা ডুবে যায়। উক্ত রোহিঙ্গা বোঝাই হতভাগ্যদের কি ঘটেছে জানা যায়নি। ডুবে যাওয়াদের মধ্যে অধিকাংশ ছিল নারী ও শিশু। অপর রোহিঙ্গা বোঝাই ২টি নৌকাকে ধাওয়া করে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাদেরকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে নাকফুরা সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে হস্তান্তর করে। উক্ত মিয়ানমারের ক্যাম্পে তাদেরকে নারীদেরকে উলঙ্গ করে পাবশিক অত্যাচার ও পুরুষদেরকে চোখ ও হাত-পা বেঁধে অমানুষিক নির্যাতনের অভিযোগ করেছে পালিয়ে আসা অপর রোহিঙ্গার।
এদিকে আরাকানে মুসলিম নির্যাতনের প্রতিবাদে হেফজতে ইসলাম কক্সবাজারে মিছিল সমাবেশ প্রতিবাদ সমাবেশ করার পূর্ব ঘোষণা থাকলেও প্রশাসনের অনুমতি না পাওয়ায় তারা এই কর্মসূচী প্রত্যাহার করে। তবে বৃহস্পতিবার কক্সবাজারে এক সংবাদ সম্মেলনে সরকার তাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচীতে বাধা দেয়ায় হেফাজত নেতৃবৃন্দ ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পাশাপাশি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের প্রতি আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ, জাতিসঙ্ঘ বাহিনী মোতায়েন করে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা দেয়া ও নির্যাতিত ও বাস্তুচ্ছুৎ রোহিঙ্গা নারী পুরুষ ও শিশুদের আশ্রয় দিয়ে মানবিক সহযোগিতার দাবী জানান। সরকার অনুমতি দিলে বিশে^র মুসলমানরা রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসবে বলেও মন্তব্য করেন হেফাজত নেতৃবৃন্দ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রোহিঙ্গা

১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ