Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাক্ষাতকারে তালেবানকে নিয়ে যা বললেন সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১৫ আগস্ট, ২০২২, ৯:০৪ পিএম

সাবেক আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই সম্প্রতি জার্মানির বার্তা সংস্থা ডয়চে ভেলেকে একটি এক্সক্লুসিভ সাক্ষাতকার দিয়েছেন। সেখানে তিনি আফগনিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি ও ক্ষমতাসীন তালেবানদের নিয়ে কখা বলেন।

হামিদ কারজাই ডিডাব্লিউকে বলেন, এক বছর আগে তালেবানরা ক্ষমতা দখল করার পর কেন তিনি দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও যাননি। তার কথায়, ‘‘ওরা চলে যাবে, আমরা আবার ফিরে আসব।’’

ডয়চে ভেলে: আপনাকে আপাতদৃষ্টিতে বিদেশ ভ্রমণের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। মিস্টার কারজাই, আপনি কি তালেবানের হাতে বন্দি?

হামিদ কারজাই: না। ঠিক তা নয়। তবে বিদেশভ্রমণ সম্ভব নয়, তারা আমাকে এটা বলেছে। কাবুলের ভিতরে কোথাও গেলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিকঠাক কি না আমরা তাদের জিজ্ঞাসা করি। তাদের জানিয়ে দেয়া হয়, আমি কোনো জায়গায় যাচ্ছি এবং তারা আমাদের একটি এসকর্ট বা পাহারার ব্যবস্থা করে দেয়। এসকর্ট আমাকে সেখানে নিয়ে যায়।

ডয়চে ভেলে: এটা কি কাবুলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নাকি আপনাকে শহরের সীমানা অতিক্রম করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে?

হামিদ কারজাই: আমি এখনো সেটা করিনি। তাই আমি জানি না। আমি এখনও তাদের বলিনি যে আমি প্রদেশগুলি পরিদর্শন করতে যাচ্ছি। আমি মনে করি শীঘ্রই যাওয়া উচিত, শরৎ তো এসে গেল। তারপর আমরা জানতে পারব।

ডয়চে ভেলে: গত বছর তালেবান যখন ক্ষমতায় আসে তখন ইসলামিক রিপাবলিকের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধিদের মতো আপনি কেন দেশ ছেড়ে যাননি?

হামিদ কারজাই: ব্যস, এটা আমাদের দেশ। এটা আমাদের বাড়ি। যখন পরিস্থিতি কঠিন হয়ে যায় তখন আপনি আপনার বাড়ি ছেড়ে যাবেন না।আপনি আপনার বাড়িতে থেকে পরিস্থিতি ঠিক করুন। বিষয়টা এমনই সহজ।

ডয়চে ভেলে: তাহলে এখন যদি সুযোগ পান, আপনি বাইরে যাবেন না?

হামিদ কারজাই: কখনো না। কখনোই না।

ডয়চে ভেলে: আপনার তিনটি ছোট মেয়ে আছে। আফগানিস্তানে তাদের জন্য আপনি ভবিষ্যৎ দেখতে পান? কী ধরনের ভবিষ্যৎ?

হামিদ কারজাই: আমি চাই তাদের ভবিষ্যৎ পৃথিবীর অন্য যেকোনো শিশুর মতোই সুন্দর হোক। এটি আমাদের ভবিষ্যতের জন্য,আমাদের সন্তানদের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আমার মেয়েরা এখানে কাবুলে পড়াশোনা করছে। বড় মেয়ে মালালার বয়স ১০, ও সে ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শ্রেণিতে উঠবে। পরিস্থিতি এখন যেমন দাঁড়িয়েছে, তার মানে সে তার শিক্ষা চালিয়ে যেতে পারবে না।

ডয়চে ভেলে: তাহলে আপনি কী করবেন? তালেবান নিষেধাজ্ঞা জারির ফলে সে যদি স্কুলে যেতে না পারে, তাহলে আপনি কি তাকে বিদেশে পাঠাবেন?

হামিদ কারজাই: আমার সামনে এবং অন্যান্য কয়েক হাজার আফগান পরিবার এবং পিতামাতার সামনে ঠিক এটাই প্রশ্ন। আমাদের মেয়েরা যখন মাধ্যমিক বা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার বয়সে পৌঁছাবে তখন আমরা কী করবো? দেশত্যাগ করা মানে দেশ ছেড়ে যাওয়া সুতরাং, আমাদের সন্তানদের বা আমাদের কন্যাদের শিক্ষার অধিকারের জন্য আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। হাল ছাড়লে চলবে না।

ডয়চে ভেলে: কিন্তু শিক্ষার এত ইচ্ছা থাকলে তালেবান কেন তা করছে না?

হামিদ কারজাই: এটি এমন একটি প্রশ্ন যার তাদের উত্তর তাদের খুব শীঘ্রই দিতে হবে। অবশ্যই মেয়েদের স্কুলে যেতে দিতে হবে। সেখানে কোনো আপস নেই। আমি তাদের এটি খুব স্পষ্টভাবে বলেছি। আমরা আফগান মেয়েদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতে দেব না। কোনোভাবেই না।

অতএব, এটি পরিবর্তন করার জন্য আমাদের আফগানিস্তানের সকলকে, দেশের বাকি অংশ হিসাবে এবং তালেবানকেও একত্রিত হতে হবে। এটা তালেবানের অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত হোক বা বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত হোক, আমাদের এটা পরিবর্তন করতে হবে।

ডয়চে ভেলে: আপনি ‘বাইরে থেকে আরোপিত' বলতে কী বোঝাতে চাইলেন?

হামিদ কারজাই: দেখুন, পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ইসলামাবাদে ইসলামী বিশ্বের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলতে শুনেছেন আপনি। সেখানে উনি বলছেন, আফগান মেয়েরা স্কুলে যায় না, উনি আফগান ঐতিহ্যের উপর দোষারোপ করার চেষ্টা করছেন। যা ভুল, সম্পূর্ণ ভুল।

ডয়চে ভেলে: কিন্তু আফগানিস্তানে মেয়েদের স্কুলে নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে পাকিস্তানের আগ্রহ কেন?

হামিদ কারজাই: একটি দুর্বল আফগানিস্তান, যে আফগানিস্তান যা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না, যে আফগানিস্তান যা দারিদ্র্যের মধ্যে রয়েছে, সেটাই চায় তারা। আর অভাব মানেই দারিদ্র্য। মেয়েদের শিক্ষার অভাব মানে সামর্থের অভাব।মেয়েদের শিক্ষার অভাব মানে সমাজের অর্ধেক, সমাজের অন্তত অর্ধেক মানুষ আসলে শিক্ষিত নন। তাই সমাজের অন্তত অর্ধেক সংখ্য মানুষ উৎপাদনে অংশগ্রহণ করতে পারছেন না।এটা যথেষ্ট দুর্বল এবং বঞ্চিত আফগানিস্তান। তাই পাকিস্তানের কাছে এ ছাড়া আর অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে না।

ডয়চে ভেলে: প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মতে, কাবুলের কেন্দ্রস্থলে একটি ড্রোন হামলায় আল কায়েদা নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরিকে হত্যা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রচুর তালেবান প্রতিনিধির বসবাস এমন একটি এলাকা তাদের টার্গেটে রয়েছে। আফগানিস্তান কি আবার বিশ্ব সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষক হয়ে উঠছে?

হামিদ কারজাই: আফগানিস্তান কখনোই বৈশ্বিক সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষক ছিল না। আফগানিস্তান বিশ্ব সন্ত্রাসের শিকার ছিল। আফগান জনগণ সন্ত্রাসবাদের সবচেয়ে বড় শিকার। আফগান জনগণ বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদের শিকার হওয়া প্রতিটি মানুষের প্রতি অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে সমবেদনা জানায় কারণ আমরা আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। আফগান জনগণ ১১ সেপ্টেম্বরে হামলায় নিহতদের প্রতি সমবেদনা জানায় কারণ আমরাই তো প্রথমে হামলার শিকার হয়েছি। আফগানরা সন্ত্রাসের শিকার এবং দুর্ভাগ্যবশত, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শিকার। তাই আমরা এর কিছুই চাই না। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তারা জাওয়াহিরিকে হত্যা করেছে। তালেবান বলেছে যে তারা জাওয়াহিরির উপস্থিতি বা কাবুলে অবস্থান সম্পর্কে অবগত নয় এবং তারা তদন্ত করবে। তাই তদন্ত হোক।

ডয়চে ভেলে: আপনি যদি চোখ বন্ধ করেন নিজেকে গত বছরের সেই সময়ে নিয়ে যান।আন্তর্জাতিক সৈন্যরা বিদ্যুতের গতিতে দেশ ছাড়ছে। কাবুলে তালেবানের অতর্কিত হানা। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি, পালিয়ে যাচ্ছেন, আফগান সেনা যুদ্ধ করছে না, তরুণ আফগানেরা বিমানে আঁকড়ে ধরে দেশ ছেড়ে পালাতে চাইছে, তারপর সেখান থেকে পড়ে যাচ্ছে। কে দায়ী এ জন্য?

হামিদ কারজাই: খুবই দুঃখজনক। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে সেনা প্রত্যাহার করেছে তা ছিল লজ্জাজনক। আমাদের জন্য অপমানজনক এবং আমেরিকান জনগণের জন্যও ক্ষতিকর।

ডয়চে ভেলে: আপনি যখন রাষ্ট্রপতির প্রাসাদে তালেবানের পতাকা দেখেন, যা আপনার বাসভবন থেকে খুব বেশি দূরে নয়, তখন আপনার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় এমনটা বলা যেতে পারে?

হামিদ কারজাই: এটা তালেবানের পতাকা। তারাই এখন আফগানিস্তানের ক্ষমতায় রয়েছেন। আমাদের জাতীয় পতাকা হল কালো, লাল এবং সবুজ পতাকা, যা আফগানিস্তানের ঐতিহাসিক পতাকা, যা ১৯২০ সাল থেকে সেখানে রয়েছে।

ডয়চে ভেলে: আফগানিস্তানে এখনকার পরিস্থিতির দিকে তাকালে দেখা যায়, অর্থনীতির সবটাই ভেঙে পড়েছে। প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা, অর্থাৎ দুই কোটি মানুষ উচ্চ মাত্রার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন।আমি দেখেছি বাচ্চারা বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করছে, এমনকি কাবুলের হাসপাতালগুলোতেও সাহায্য পৌঁছে যাচ্ছে। কীভাবে এই পরিস্থিতি থেকে বেরোবে এ দেশ?

হামিদ কারজাই: একটা উপায় হল আফগানদের মধ্যে ঐক্য জোরদার করা, দেশ পরিচালনার কাজে আফগান জনগণকে সংযুক্ত করা। আমি তালেবান ভাইদের অন্য সব আফগানদের ভাই-বোন বিবেচনা করার আহ্বান জানাচ্ছি। এমনকি যারা তাদের বিরুদ্ধে, যারা তালেবানকে প্রতিরোধ করার কথা ভাবে, তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে হবে। একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়, একটি জাতীয় সংলাপে ফিরিয়ে আনতে হবে যাতে আমরা আফগানরা ঐক্যবদ্ধভাবে জনগণের কথা মেনে একটি উন্নত ভবিষ্যতের দিকে একটি পথ নির্ধারণ করতে পারি।আমি বারবার তালেবানকে এই অনুরোধ করেছি।

ডয়চে ভেলে: আফগানিস্তান কি ‘লস্ট কান্ট্রি'?

হামিদ কারজাই: না। এটা ‘লস্ট কান্ট্রি' নয়। বিশ্বের এই অংশে প্রাচীনতম দেশ এবং সভ্যতার মধ্যে আমরা একটি। আমরা ভালো থাকব। এটি আমাদের ইতিহাসের সহস্রাব্দের একটি সামান্য অংশ। এটি দূর হবে। আমরা নিজেদের পায়ে ভর দিয়ে শক্তিশালী হয়ে আবার ফিরে আসব।

ডয়চে ভেলে: আফগানিস্তানে কি নারীদের জায়গা রইল না?

হামিদ কারজাই: এই পরিস্থিতি সাময়িক। আফগানিস্তান যদি নারীদের উপযুক্ত দেশ না হয়, তার মানে আফগানিস্তান নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। এটা আমরা কখনো হতে দেব না। আফগান নারীরা শিক্ষিত হবে, তারা স্কুলে যাবে। তারা ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, সাংবাদিক হবে, সংসদে থাকবে, সবার ভালো করবে। সময় আসবে এবং আপনারা এটি দেখতে পাবেন। সূত্র: ডয়চে ভেলে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ