পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
শফিউল আলম : আরাকান (রাখাইন) প্রদেশজুড়ে মিয়ানমার শাসকগোষ্ঠীর মদদপুষ্ট হরেক বাহিনীর ‘যৌথ অভিযানে’র নামে নিরস্ত্র-নিরীহ রোহিঙ্গা মুসলমান নাগরিকদের উপর ভয়াল সব অত্যাচার-নির্যাতন দিন দিন বেড়েই চলেছে। রোহিঙ্গাদের দেশছাড়া করাই এহেন বর্বর অভিযানের মূল টার্গেট। সেনাবাহিনী, সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিজিপি), পুলিশ, মগদস্যু, স্থানীয় সরকারের সন্ত্রাসীদের যৌথ হত্যা, গুম, নারীদের ধর্ষণ ও শিশুদের বলাৎকার, রাহাজানি, অগ্নিসংযোগ এবং বিতাড়নের মতো যাবতীয় তা-বলীলা আরও জোরালো আকার ধারণ করেছে। এহেন ভয়াবহতা নির্যাতনে রোহিঙ্গা মুসলমানরা চরমভাবেই দিশেহারা হয়ে পড়েছে। তাদের জীবন ও ইজ্জত-আব্রুটুকু বাঁচাতে সহায়-সম্বল পেছনে ফেলে বাড়িঘর ছেড়ে বাধ্য হয়ে হাজার হাজার নর-নারী শিশু এ মুহূর্তে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরে ভাসছে চরম ঝুঁকি নিয়ে। অজানা গন্তব্যের উদ্দেশে ছুটে চলেছে ভাগ্যাহত রোহিঙ্গারা। কেউ সপরিবারে, কেউ বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্তভাবে। লাখো মানুষ আরাকানের পাহাড়-জঙ্গলে, গুহায়, সমুদ্র উপকূলে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের ফেলে আসা সহায়-সম্পদ বেপরোয়া লুটপাট করছে বৌদ্ধ-মগদস্যুরা।
এদিকে আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলমান জাতিগোষ্ঠীর উপর চলমান বর্বরোচিত ও অমানবিক নির্যাতন বন্ধের কৌশল নির্ধারনের লক্ষ্যে উচ্চপর্যায়ের কমিশনের প্রধান জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান মিয়ানমার সফরে রয়েছেন। তিনি আগামীকাল (শুক্রবার) আরাকানের (রাখাইন) মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল মংডু সফরে আসার কথা রয়েছে। শত বাধা পেরিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে, রোগে-শোকে জর্জরিত হয়ে এ যাবত বেসরকারি হিসাবে অন্তত ২০-২২ হাজার রোহিঙ্গা পার্বত্য জেলা বান্দরবান, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের স্থলভাগ দিয়ে কিংবা নাফ নদীর সীমান্ত পেরিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। রোহিঙ্গারা বেশিরভাগই গভীর রাতের আঁধারে এপারে এসে পৌঁছতে সক্ষম হয়। পালিয়ে আসা অনেকেই চোখের সামনে দেখেছেন, কি পাশবিক কায়দায় মিয়ানমারের বাহিনীগুলো পিতা, দাদা, ভাই, নিকটাত্মীয় পরিজনকে গুলি করে, কেটে কেটে টুকরো অথবা জবাই করে আর পিঠিয়ে হত্যা করতে। আরও দেখেছেন, মা-বোন স্ত্রী-কন্যাকে ধর্ষিত হতে এবং ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণের পৈশাচিক বর্বরতা। তারা অসহায়ভাবেই অবলোকন করেছেন, শত বছরের মসজিদ, মাদরাসা-মক্তবসহ ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতিষ্ঠানগুলো পেট্রোল-কেরোসিন ঢেলে জ্বালিয়ে দিয়ে বর্বর বাহিনীকে উল্লাসে মেতে উঠতে।
আরাকানে যৌথবাহিনীর চরম নির্মমতার মাধ্যমে মুসলমানদের খুন, ধর্ষণ, নিপীড়ন এবং রোহিঙ্গা খেদাও তথা বিতাড়নের এই বর্বর ‘অভিযান অভিযান’ খেলা বন্ধ হওয়ার আপাতত কোন আলামত দেখা যাচ্ছে না। বরং পরিস্থিতির দিন দিন আরও অবনতি ঘটছে। প্রতিনিয়তই অত্যাচার নির্যাতনের স্টিম রোলার চালাচ্ছে বর্মী অসভ্য-বর্বর বাহিনী। ইতোমধ্যে আরাকানের মংডু, বুচিদংসহ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকার গ্রাম-মহল্লা-পাড়াগুলোর বাড়িঘর প্রায় পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। আর মহিলা ও শিশুরা সারাক্ষণ চরম আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতায় দিন গুজরান করছে। অবশিষ্ট রোহিঙ্গারা শত নির্যাতনের মুখে মাটি কামড়ে স্বদেশে পড়ে থাকলেও তারা কাজ-কর্ম আয়-রোজগারহীন অবস্থায় চরম দুঃখ-যন্ত্রণায় দিন কাটাচ্ছে। অসংখ্যা রোহিঙ্গা পুরুষকে বাড়িঘর থেকে তুলে নিয়ে সেনাবাহিনী, বিজিপি ও পুলিশি ব্যারাক ও ফাঁড়ি নির্মাণের কাজে খাটাচ্ছে দিনে-রাতে। তাদেরকে মজুরি দূরে থাক, ঠিকমতো খাবারও দেয়া হচ্ছে না। এ ধরনের ‘শ্রম শিবিরে’ বন্দি রোহিঙ্গাদের প্রতিটি পরিবারে বিরাজ করছে হাহাকার, চরম অনিশ্চয়তা। এভাবে রোহিঙ্গারা নিজদেশে পরবাসী হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদেরকে ‘পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা দলিত ও ভাগ্যাহত জাতিগোষ্ঠী’ হিসেবে আখ্যায়িত করলেও নিরীহ রোহিঙ্গা জাতির উপর অঘোষিত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া অং সান সুচি’র সরকারের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক কার্যকর চাপ এমনকি অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের জন্য বিশ্বজুড়ে মানুষের মাঝে দাবি উঠলেও তা করা হচ্ছে না।
এদিকে গত ৫০ বছর ধরে ধরে মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর জান্তা সরকারের নির্যাতন-নিপীড়ন চলে আসছে। এরমধ্যে বিগত ১৯৭৮ সালে এবং ১৯৯১-৯৪ সালে ও তার আগে-পরে ধারাবাহিকভাবে রোহিঙ্গাদের পৈত্রিক মাতৃভূমি থেকে সমূলে উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে ধারাবাহিকভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে বিভিন্ন নামে আর বেনামে ‘অভিযান’। তবে বিগত মার্চ মাসে কথিত ‘শান্তির রানী’ অং সান সুচি’র নেতৃত্বে ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) নির্বাচনে জয়ী হয়ে ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার কায়েম করার পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘদিনে নিপীড়নের যাঁতাকল থেকে রোহিঙ্গারা এবার মুক্তি পাবেনÑ এটাই ছিল সবার প্রত্যাশিত। তাছাড়া সুচি গত ক’মাসে দেশ-জাতির সম্প্রীতি ও শান্তির পরিবেশ জোরালো করবেন মর্মে বেশ কয়েক দফায় সুন্দর সুন্দর ভাষণও শুনিয়েছেন দেশটিতে এবং বহির্বিশ্বে।
কিন্তু সুচি সরকারের ‘গণতান্ত্রিক’ নামের বাতাবরণে শাসনক্ষমতায় আরোহণের রেশ না কাটতেই সেদেশের সেনা, বিজিপি, পুলিশ, মগবৌদ্ধরা একজোট হয়ে আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলমানদের কচু কাটা করে হত্যা ও নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে স্বদেশ থেকে বিতাড়নের জন্য। চলমান নির্যাতনের মাত্রা দিনদিন বাড়ছেই। গত ৯ অক্টোবর বর্মী সীমান্তের চৌকিতে দুষ্কৃতকারীদের আচমকা হামলায় দেশটির ৯ পুলিশের মৃত্যুর পর এ ঘটনায় বিনা তদন্তে রোহিঙ্গাদের ‘সন্ত্রাসী’ সাব্যস্ত করেই তাদের উপর সর্বাত্মক যুদ্ধ চালাচ্ছে মিয়ানমার শাসকগোষ্ঠির সাথে তাদের মদতপুষ্ট বৌদ্ধমগরা। একের পর হামলার সাথে সাথে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করা হচ্ছে। নারী-শিশুসহ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে পালাতে থাকা শত শত রোহিঙ্গাকে হেলিকপ্টার থেকে গানশিপ দিয়ে গুলি করে এবং নির্মম কায়দায় কুপিয়ে হত্যা করে নাফ নদীতে লাশ ভাসিয়ে দেয়া হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম ও পর্যবেক্ষকরা আরাকানে গত দু’সপ্তাহে কয়েকশ’ নারীকে সংঘবদ্ধভাবে অর্থাৎ গণধর্ষণের অভিযোগ তুলেছে বর্মী সেনা-বিজিপি-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে। এখনও তা ভয়াবহভাবেই অব্যাহত রয়েছে।
অতিসম্প্রতি আরাকার থেকে টেকনাফের শরণার্থী শিবিরে পালিয়ে আসা ১৯ বছর বয়সি রোহিঙ্গা তরুণ মোহাম্মদ তৌহিদ বিদেশি মিডিয়াকে জানায়, বর্মী (মিয়ানমার) সেনাবাহিনী আমার চোখের সামনেই আমার বোনকে গুলি করে হত্যা করেছে। হামলা চালানোর সময় আমি গোবরের স্তূপের তলায় লুকিয়ে ছিলাম। রাত অনেক গভীর হওয়ার পরই আমি সেখান থেকে বেরিয়ে সীমান্তে পালিয়ে আসি। আমি আমার মাকে বাড়িতে একা ফেলে এসেছি। তিনি বেঁচে আছেন নাকি তাকেও মেরে ফেলা হয়েছে আমি জানি না। সেনারা রোহিঙ্গাদের শত শত বসতঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। টেকনাফ শরণার্থী শিবিরে পালিয়ে আসা আরেক রোহিঙ্গা শরণার্থী বিদেশি মিডিয়াকে বলেন, সেনাবাহিনী গ্রামে ঘরে ঘরে হামলা চালালোর কারণে পুরুষরা বাধ্য হয়ে ঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়। আর যে নারীরা পালাতে পারেনি তাদেরকে সেনাসদস্যরা গণধর্ষণ করে। রোহিঙ্গা মুসলমানদের উচ্ছেদে স্থানীয় রাখাইন তথা মগবৌদ্ধদেরও ব্যবহার করছে সেনারা। রোহিঙ্গাদের যেসব জায়গা থেকে উচ্ছেদ করা হয় সেখানে পুনর্বাসন করার জন্য আরেক জায়গা থেকে আনা রাখাইন বৌদ্ধদের। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের দেশটির নাগরিক বলেই স্বীকার করে না। এটিই আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অজুহাত। অথচ ইতিহাসই বলছে আরাকানীরা প্রাচীন রাজধানী ইয়াঙ্গুন (রেঙ্গুন) এবং সিটুই (আকিয়াব) সহ সমগ্র আরাকান রাজ্যের হাজার বছরের নাগরিক। তাদের রয়েছে হাজারো বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।