Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

খোঁড়াখুঁড়ি ভোগান্তিতে নগরবাসী

| প্রকাশের সময় : ১ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সায়ীদ আবদুল মালিক : রাজধানীজুড়ে চলছে খোঁড়াখুঁড়ির মহোৎসব। নগরীর পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ প্রান্ত এমন কোনো সড়ক বা অলিগলি নেই, যেখানে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে না। এরমধ্যে দুয়েকটি সড়ক দিয়ে কোন রকম চলাফেরা করা গেলেও অনেক রাস্তাই এখন চলাচলের অনুপযুক্ত। সিটি কর্পোরেশন, মেট্টোরেল স্থাপনের কাজের জন্য, ওয়াসা, তিতাস, ডেসকোসহ সবাই মিলে প্রতিদিনই কোনো না কোনো সড়ক, অলিগলি খুঁড়ছে। আজ এই প্রতিষ্ঠান কাটছে তো কাল কাটছে আরেক প্রতিষ্ঠান। কাজ শেষ করে চলে যাওয়ার পর আরেক প্রতিষ্ঠান এসে নতুন করে খনন করছে রাস্তা। প্রতিদিন রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণে নগরজুড়ে উড়ছে ধুলোবালি। এর প্রভাবে নগরবাসী নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। সব মিলিয়ে এখন রাস্তায় চলাচল করা নগরবাসীর জন্য সবচেয়ে বড় দুর্ভোগ।
এ দুর্ভোগ সারাতে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কোনো রকম তৎপরতাই চোখে পড়ছে না। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর ঢাকার ভিতর দুই সিটি কর্পোরেশনের আওতায় রয়েছে প্রায় ২২০০ কিলোমিটার সড়ক। এর মধ্যে কমপক্ষে ৫০ ভাগ সড়কে চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। এর মধ্যে ৮০ ভাগ সড়কেই উন্নয়ন কাজ করছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। এই উন্নয়ন কাজের মধ্যে সড়ক নতুন করে উন্নয়ন, ফুটপাথের উন্নয়ন এবং নর্দমা ও খালের উন্নয়ন হচ্ছে অন্যতম। আর এই উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়েই কয়েক মাস ধরে রাজধানীর রাস্তাঘাট হয়ে পড়েছে বিপন্ন। আর এই উন্নয়ন কর্মকা-ের খপ্পরে নগরবাসী পড়েছেন মহাবিপাকে। শুধুমাত্র শুষ্ক মৌসুমেই এসব উন্নয়ন কাজ পরিচালনা করার নিয়ম থাকলেও কেউ মানছে না নিয়মনীতি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান ইনকিলাবকে বলেন, উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য বিভিন্ন সেবা সংস্থা থেকে সিটি কর্পোরেশনের কাছে অনুমতি চাওয়া হলে, বেশকিছু নিয়মনীতির মধ্যে তাদেরকে অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু দেখা যায় তারা অনেক ক্ষেত্রে শর্তমত কাজ করে না। এতেই সমস্যা হয়। তিনি বলেন, আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি যাতে নগরবাসীর ভোগান্তি কিছুটা কমানো যায়।
সরেজমিন গত কয়েকদিন ধরে রাজধানীর মিরপুর, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, মিরপুর-১০, ১, ২, সাড়ে ১১, মোহাম্মদপুর, জাকির হোসেন রোড, জহুরি মহল্লা, বিজরি মহল্লা, লালমাটিয়া, ধানমন্ডি, পুরান ঢাকার কবি নজরুল ইসলাম কলেজ থেকে লক্ষ্মীবাজার, সোহরাওয়ার্দী কলেজ মোড়, টিকাটুলি, হাটখোলাসহ বিভিন্ন এলাকা, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, মালিবাগ, খিলগাঁও, বাসাবো, মতিঝিল, আরামবাগ, মৌচাক, সেগুনবাগিচা, পল্টন, কমলাপুর, রামপুরা, হাজীপাড়া, বাড্ডা, গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরার বিভিন্ন সেক্টরের সড়কগুলো ঘুরে দেখা গেছে, এসব এলাকার রাস্তাগুলো কেটে একাকার করে দেওয়া হয়েছে।
মেট্রোরেলের জন্য মিরপুর গোল চত্বর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত রাস্তার খনন কাজ চলছে। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণে মিরপুর-১০ থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত যেতে অতিরিক্ত সময় লাগছে প্রায় এক ঘণ্টা। সরেজমিনে দেখা যায়, মূল সড়কের মাঝখান দিয়ে একটি লেনের মতো করে সোজা রাস্তা বরাবর খনন কাজ চলছে। রাস্তার মাঝে কাটা-ছেঁড়া হলেও সড়কের দু’পাশ দিয়ে গাড়ি চলছে। মূল সড়ক ছোট হয়ে যাওয়ায় বেঁধেছে তীব্র যানজট। এছাড়া রাস্তা পার হতে পথচারীদের বেগ পেত হচ্ছে। রাস্তা ছোট হওয়ায় ধীরগতিতে গাড়ি চলছে আবার কখনো থেমে আছে। এতে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। ১০ মিনিটের রাস্তায় সময় লাগছে প্রায় একঘণ্টা।
মেট্রোরেল নির্মাণের কাজ করছিলেন কর্মী মোহাম্মদ রাসেল। তিনি বলেন, মিরপুর-১০ থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত খনন কাজ চলছে। সেপ্টেম্বর থেকে এই কাজ শুরু হয়েছে। আরও দু’মাস ধরে চলবে।
সামান্য বৃষ্টিতে পানিবদ্ধতা, দুর্বল নির্মাণ ও সংস্কারকাজ, পরিকল্পনাহীন রাস্তার উন্নয়নকাজ ও সঠিকভাবে পরিদর্শনের অভাবে রাজধানীর অর্ধেকের বেশি রাস্তা ভাঙ্গাচোরা হয়ে পড়ে আছে। যা প্রায় সারাবছরই নগরবাসীর দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সুনির্দিষ্ট ভিআইপি সড়ক ছাড়া রাজধানীর প্রায় সব সড়কেরই একই হাল। ভিআইপি সড়ক হওয়ার কারণে ওই সড়কগুলোতে নিয়মিতই সংস্কারকাজ করা হয়। এর বাইরের মূল রাস্তা ও তার আশপাশের অলিগলির অনেক রাস্তাই ভাঙ্গাচোরা। প্রায় প্রতিটি সড়কেই ছোট-বড় অসংখ্য গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। অবশ্য দুই সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষেরই দাবি, তারা এসব ভাঙ্গা রাস্তা অতিদ্রুতই সংস্কারে বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করেছে, যা চলমান রয়েছে। তবে নতুন সকল রাস্তা সংস্কার করা হলে রাস্তার বর্তমান চেহারাই পাল্টে যাবে। একবার সংস্কারের পর কয়েক বছরেও আর এসব রাস্তা ভাঙবে না। তবে কবে নাগাদ এসব রাস্তায় চলাচলে নাগরিক দুর্ভোগ লাঘব হবে তা কেউ বলতে পারেন না।
মূলত নিয়মিত সংস্কার না করায় এসব গর্ত থেকে প্রতিনিয়তই বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হচ্ছে। এসব গর্তে পড়ে রাস্তায় চলাচলকারীদের সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। দিনে-রাতে ঘটছে প্রতিনিয়ত নানা দুর্ঘটনা। এছাড়া সামান্য বৃষ্টিতে রাস্তায় পানি জমে যাওয়ার কারণে পুরনো গর্তগুলো বোঝার কোন উপায় না থাকায় রিকশা, ভ্যান, সিএনজি অটোরিকশাসহ মিনিবাসগুলোকে রাস্তায় আটকে থাকতে ও নানা দুর্ঘটনায় পড়তে দেখা যায়, যার শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা। যদিও সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে দাবি করা হচ্ছে, পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ না থাকায় ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার সমস্যার কারণে সামান্য বৃষ্টিতে সৃষ্ট পানিবদ্ধতার কারণে বিটুমিন আর পিচের সমন্বয়ে তৈরি এসব রাস্তা নিয়মিত সংস্কার করা হলেও তা টিকছে না। এজন্য পিচ ঢালাইয়ের পরিবর্তে সিটি কর্পোরেশন এবার কংক্রিটের ঢালাইয়ের রাস্তা তৈরিতে মনযোগ দিয়েছে। তাদের মতে, এসব রাস্তা তৈরির পর একটানা কয়েক বছরেও কোন প্রকার সংস্কার করার প্রয়োজন হবে না।
রাজধানীর সড়কের বেহালদশা মিডিয়ায় তুলে ধরলেই কেবল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। এর বাইরে নিজ উদ্যোগে এসব রাস্তার সংস্কারকাজের প্রয়োজনীয়তা খুবই কম অনুভব করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সড়ক মেরামতে বা সংস্কারে প্রতি বছর বিপুল অর্থ বরাদ্দ থাকলেও সঠিকভাবে এসব অর্থের ব্যবহার না করায় সড়কগুলো সংস্কারের কিছুদিনের মধ্যেই ভেঙ্গে পুরনো অবস্থায় ফিরে যায়। ফলে সৃষ্টি হয় আবার গর্ত। আর এসব গর্তে পানি জমে প্রতিনিয়তই গর্তগুলো বড় আকার ধারণ করে। রাজধানীর এমন কিছু সড়ক রয়েছে যেসব সড়কে অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে যান চলাচল করতে হয়।
ঢাকা ইন্টিগ্রেটেড ট্রান্সপোর্ট স্টাডির তথ্যানুযায়ী, সব মিলিয়ে ঢাকায় সড়কের দৈর্ঘ্য তিন হাজার কিলোমিটার। এর মধ্যে প্রাইমারি সড়ক রয়েছে ২০০ কিলোমিটার। এর বাইরে সেকেন্ডারি সড়ক রয়েছে ১১০ কিলোমিটার, ফিডার (শাখা) সড়ক ১৫০ কিলোমিটার ও সঙ্কীর্ণ রাস্তা দুই হাজার ৫৪০ কিলোমিটার। রাজধানীর সড়ক মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছে একাধিক সংস্থা। এর মধ্যে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), সড়ক ও জনপথ বিভাগ ও ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন রয়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ কুদরাতুল্লাহ বলেন, বিশেষ প্রয়োজনে সড়ক খননের অনুমোদন দেয় ওয়ানস্টপ সেল থেকে। তবে সেল থেকে এই দিকনির্দেশনাও দেয়া হয়, খননের কারণে যেন জনদুর্ভোগ সৃষ্টি না হয়।
জানা গেছে, রাজধানীতে একযোগে প্রায় ৭০০ সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি করা হচ্ছে। এসব সড়কের কিছু অংশের কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। আবার কিছু সড়কে এখনও খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। অনেক সড়কের অর্ধেক কাজ করে ফেলে রাখা হয়েছে। অনেক সড়কে আবার কোন কাজই করা হয়নি। ফলে অধিকাংশ সড়কের অবস্থাই নাজুক। নাগরিক ভোগান্তি কমাতে রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশনের সকল রাস্তা ও আশপাশের নতুন যুক্ত হওয়া ১৬টি ইউনিয়নের সকল রাস্তার সংস্কার করা নাগরিকদের প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়েছে। পাশপাশি সকল রাস্তার সংস্কারের সময় এর স্থায়িত্ব ও গুণগতমান নির্ণয়ে দুই সিটির মেয়রদের বিশেষ গুরুত্ব দেয়া উচিত।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনিসুল হক তার সীমানায় বেশকিছু ভাঙ্গা রাস্তার কথা স্বীকার করে বলেন, নাগরিক দুর্ভোগ লাঘবে আমরা এসব ভাঙ্গা সড়ক সংস্কারে বিশেষ উদ্যোগ হাতে নিয়েছি। প্রকৃতপক্ষে আমরা নতুন রাস্তা তৈরি করি না, তবে পুরনো রাস্তাই সংস্কার করি। তবে যেসব রাস্তা ভাঙ্গা রয়েছে সেগুলো পরিপূর্ণভাবে সংস্কার করার জন্য ইতোমধ্যেই আমরা প্রায় ৬০০ কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি, যা গত অর্থবছরের রাস্তা সংস্কারের বাজেটের প্রায় দ্বিগুণ। এসব রাস্তার সংস্কারকাজ আগামী দুই বছরের মধ্যেই সম্পন্ন করা হবে।


















































 







 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নগরবাসী


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ