Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাক্সার জঙ্গলে কি সত্যিই বাঘ আছে? মন্ত্রীর দাবিতে সন্দেহ

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১ আগস্ট, ২০২২, ১০:০৬ পিএম

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বাক্সা নামে একটি সংরক্ষিত অরণ্যে কম করে হলেও ১১টি বাঘ থাকার প্রমাণ মিলেছে, রাজ্য সরকারের বনমন্ত্রী এই দাবি করার পর তা নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে উঠেছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বিরোধীদলীয় নেতারা বলছেন, বাক্সা অরণ্যে 'মনগড়া বাঘ' সাজিয়ে জঙ্গলের ভেতরের জনবসতিগুলো উচ্ছেদ করাই সরকারের আসল লক্ষ্য।

ওই অঞ্চলের বাসিন্দা ও ট্যুর অপারেটররাও জানাচ্ছেন, বাক্সায় বাঘ আছে বলেও কোনও প্রমাণ মেলেনি - অথচ বাঘ দেখতে এসে দলে দলে পর্যটক নিরাশ হয়ে ফিরছেন। বস্তুত আশির দশকের গোড়া থেকেই বাক্সা ভারতের একটি টাইগার রিজার্ভ হিসেবে স্বীকৃত, কিন্তু রেকর্ড অনুযায়ী ওই জঙ্গলে শেষবার বাঘ দেখা গিয়েছিল চব্বিশ বছরেরও বেশি আগে।

বাক্সা থেকে বাঘ একরকম হারিয়েই গেছে - এমন ধারণার মধ্যেই গত ২৯ জুলাই আন্তর্জাতিক ব্যাঘ্র দিবসে পশ্চিমবঙ্গের বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক এক সাংবাদিক সম্মেলন করে ঘোষণা করেন, বাক্সায় তারা অন্তত ১১টি বাঘ থাকার প্রমাণ পেয়েছেন। সেদিনই বাক্সা ঘুরে এসে মন্ত্রী বলেন, "বাক্সা একটা ব্যাঘ্র প্রকল্প, ওর ভেতরে বাঘ আছে। অনেকেই বলতেন বাক্সায় আর বাঘ নেই, বাক্সা থেকে বাঘ নাকি সরে গেছে - কিন্তু সেটা ঠিক নয়।"

"গত চার মাসে আমরা বাক্সাতে বাঘের অনেক ছবি পেয়েছি। (বাঘের ছবি তুলতে) আমরা দু-চারটে ড্রোনও ব্যবহার করেছিলাম, তাতেও বাঘ থাকার প্রমাণ মিলেছে।" বাক্সাতে ক'টা বাঘ আছে, সাংবাদিকদের এই নির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী জানান, "আছে প্রচুর। আমরাই তো ১১টা বাঘের প্রমাণ পেয়েছি - ইলেভেন। তার মানে আসলে এর চেয়েও অনেক বেশি আছে।"

বনমন্ত্রী মল্লিক সেই সঙ্গেই জানান, বাক্সার ভেতরে এখন যে পনেরোটি গ্রাম বা 'বন-বস্তি' আছে, বাঘের হাত থেকে সেই গ্রামবাসীদের বাঁচাতে তারা ওই লোকেদের তুলে অন্য জায়গায় বসাতে চান। তিনি বলেন, "এরা তো ঠিকমতো জীবনযাপন করতে পারছে না। বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে পারছে না, বাজারহাট করতে পারছে না। তাই এদের আমরা তুলতে চাই।"

কিন্তু বাক্সার সবচেয়ে কাছের শহর আলিপুরদুয়ারের বিধায়ক ও বিজেপি নেতা সুমন কাঞ্জিলাল বিবিসিকে বলছেন, বাঘের সংখ্যা নিয়ে মন্ত্রীর এই দাবি সম্পূর্ণ অবাস্তব। কাঞ্জিলাল বলছিলেন, "বাক্সার ভেতরে এতগুলো বন-বস্তি, ট্যুরিস্ট স্পট, হোমস্টে ইত্যাদি আছে, আর সেখানে শত শত দেশি-বিদেশি ট্যুরিস্টও আসেন। তারা কেউ কোনওদিন একটা বাঘও কিন্তু সেখানে দেখেননি।" "এই পরিস্থিতিতে মন্ত্রী যেখানে বলে দেন বাক্সায় এগারোটা বাঘ আছে, মানুষ কিন্তু হতচকিত। এতগুলো বাঘ থাকল, অথচ কেউ সশরীরে একটা বাঘও দেখল না বা ফিজিক্যাল আইডেন্টিফিকেশন হল না - এটা কি ভাবা যায়?"

সুমন কাঞ্জিলালের মতে, বাক্সায় বাঘ আছে বাঘ আছে এই ধরনের জিগির কেন বারবার তোলা হচ্ছে বা বাঘের 'গল্প' কেন বানানো হচ্ছে সেটাও মানুষকে ভাবাচ্ছে। তিনি বিবিসিকে আরও বলছিলেন, "মনগড়া বাঘের একটা সংখ্যা বলেই তারপর এক নি:শ্বাসে যেভাবে বনবস্তি উচ্ছেদ করার কথা বলা হচ্ছে, তাতে সন্দেহ দানা বাঁধতে বাধ্য।" কাঞ্জিলালের বক্তব্য - আদমা, চুনাভাটি, লালবাংলো, তাসিগাঁও-সহ বাক্সায় যে বনবস্তিগুলো আছে, সেগুলোর উচ্ছেদ ও পুনর্বাসনের নামে বিশ্ব ব্যাঙ্ক ও কেন্দ্রের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা আদায় করতেই এই কাল্পনিক বাঘের কাহিনী সাজানো হচ্ছে।

বাক্সার ভেতরেই আছে জয়ন্তী নামে একটি ছোট জনপদ - সেখানে স্থায়ীভাবে থাকেন বেশ কয়েকশো মানুষ। এই বাঘ-বিতর্কে এখন তারাও রীতিমতো আলোড়িত। স্থানীয় বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ সন্দীপ চক্রবর্তী বিবিসিকে বলছিলেন, বাক্সায় বাঘের অস্তিত্ত্বের কোনও প্রমাণ তারা কিন্তু বহুকালের মধ্যে পাননি।

চক্রবর্তীর কথায়, "ডাইরেক্ট সাইটিং ছেড়ে দিন, বাক্সায় বাঘ থাকার কোনও ইনডাইরেক্ট এভিডেন্স বা পরোক্ষ প্রমাণও কিন্তু আমরা পাই না।" "যেমন ধরুন রোরিং বা বাঘের গর্জন আমরা কখনো শুনিনা। জঙ্গলে এত গরু-ছাগল চরে বেড়ায়, কখনো বাঘ তাদের শিকার করেছে বলেও জানা নেই।" তবে বাক্সায় কিছু লেপার্ড বা ব্ল্যাক প্যান্থার বরাবরই ছিল, এখনও তারা বিলুপ্ত হয়নি বলেও তিনি জানাচ্ছেন।

জঙ্গলে বাঘ সাধারণত নিজের এলাকা বা 'টেরিটরি' মার্ক করে রাখে মূত্রত্যাগ করে বা গাছে আঁচড় কেটে রেখে। সন্দীপ চক্রবর্তী বলছিলেন, "সেরকম ইউরিন স্প্রে, গাছে স্ক্র্যাচও কখনো আমরা দেখিনি। চোখে পড়েনি বাঘের বিষ্ঠা বা থাবার ছাপও।" ফলে যেহেতু বহু বছরের মধ্যে বাঘের অস্তিত্ত্বের কোনও প্রমাণ মেলেনি, তাই বাক্সায় যখন 'বাঘ আছে' বলে দাবি করা হয় সেটা আসলে 'প্লান্ট করা' বলেই তার মতো বিশেষজ্ঞদের সন্দেহ।

এর মধ্যেই গত বছরের ডিসেম্বরে রাজ্যের বন দফতর আচমকা জানিয়েছিল, বাক্সাতে তাদের গোপন 'ট্র্যাপ ক্যামেরা'য় একটি বিশাল ও প্রাপ্তবয়স্ক রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের ছবি ধরা পড়েছে। এরপরই বাক্সাতে নামে পর্যটকের ঢল। বাক্সায় জঙ্গলের কিনারায় সব গেস্ট হাউস-হোটেল বুকড হয়ে যায়, সাফারিতে জায়গা পাওয়াই হয়ে ওঠে মুশকিল। কিন্তু স্থানীয় ট্যুর অপারেটর শুভজ্যোতি বসু বলছিলেন, দূরদূরান্ত থেকে আসা এই ট্যুরিস্টদের সবাইকে নিরাশ হয়েই ফিরতে হচ্ছে।

ঘটনা হল, বাক্সায় কথিত এগারোটি বাঘের অস্তিত্ত্ব এখনও পর্যন্ত রয়ে গেছে শুধু মন্ত্রীর দাবিতেই। সরকার যেহেতু ট্র্যাপ ক্যামেরা বা ড্রোনের ছবি বা ওই জাতীয় কোনও প্রমাণও পেশ করেনি, তাই বাঘ সেখানে আদৌ আছে কিনা - আপাতত সে বিতর্কেই মেতে আছে বাক্সা। সূত্র: বিবিসি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ