Inqilab Logo

সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ক্ষুধা-দারিদ্র্যেও চর ছাড়ে না মানুষ

ওরা মুক্তি চায় চরগ্রাসী লাঠিয়াল বাহিনীর কবল থেকে

মহসিন রাজু/টি এম কামাল | প্রকাশের সময় : ২৯ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বর্ষা ও শরতের পর হেমন্তে এসে উত্তরের প্রধাণ প্রধান নদ-নদীর মধ্যে যমুনা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্রে দেখা দিয়েছে পানি প্রবাহের অভাব। হেমন্তে এই নদীগুলোর চেহারা দেখে মনে হয় না, এইখানে একদিন প্রবল স্রোতস্বিনী উত্তাল নদী ছিল। উত্তরের এই এই নদীগুলোর পাড় আর নদীর চরে বাস করে এক কোটিরও বেশি মানুষ। এই এক কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত নদীর সাথে লড়াই করছে। লড়াই করছে নদীর নিষ্ঠুর ভাঙনের সাথে। লড়াই করছে অভাবের সাথে। বিশাল পদ্মা, যমুনা, তিস্তা, ধরলা ব্রহ্মপুত্রের চরসহ নদী পাড়ে বসত করা এসব মানুষ নদীর গতি প্রকৃতির সাথে পাল্লা দিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। সেই সাথে অভাব অনটন, ক্ষুধার যন্ত্রণা থাকলেও কিন্তু চরে বসবাসকারীরা চর ছাড়তে নারাজ।
নদীর টানেই চরের মানুষ আশায় বুক বেঁধে পড়ে থাকে ভাঙা জীর্ণ কাশে ছাওয়া ঘরে। বুক ভরা আশা, যে নদী দিনের পর দিন তাদের সর্বস্ব গ্রাস করেছে। সে নদীই একদিন ফিরিয়ে দেবে বাপ-দাদার জমি জিরাত। বুক ভরা আশা, যদি হারিয়ে যাওয়া জোত জমি আবার জেগে ওঠে। এই আশা নিয়ে মৌসুমে মৌসুমে নদী আর প্রকৃতির সাথে লড়াই করছে চরের মানুষ। শত দুঃখ-যন্ত্রণা নিয়ে অভাব-অনটন নিয়ে চরের মাটিকেই আঁকড়ে ধরে আছে। তাদের মনে বদ্ধমূল ধারণা, ভাঙা গড়াই নদীর খেলা। নদী পাড়ের চরবাসী মনে করে, জোত জমি গেছে, গেছে ঘরবাড়ী ভিটে মাটি তাতে দুঃখ নেই। রাক্ষুসী নদী সব কেড়ে নিয়েছে। নদীর সাথে তারা যুদ্ধ করছে। নদীতেই তারা মরণ চায়। তাদের প্রত্যাশা তবুও নদী বেঁচে থাক। আগের মত উত্তাল হয়ে উঠুক। বর্ষাকালে উত্তাল নদীর স্রোতধারার সাথে নদীবক্ষে বয়ে আনবে উর্ব্ব পলি। শুষ্ক মৌসুমে জেগে ওঠা সেই নরম পলিতে ফসল ফলাবে।
পদ্মা, যমুনা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, ধরলা নদী পাড়ের বগুড়া, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী জেলায় ছোট-বড় চার সহস্রাধিক চরে প্রায় এক কোটিরও বেশি মানুষের বাস। ঋতু বদলের সাথে নদীর রূপও বদলে যায়। সেই সাথে বদলে যায় চরের মানুষের পেশা। তারা কখনও কৃষক, কখনও জেলে, কখনও নৌকার মাঝি, কখনও ঘাটের কুলি। বর্ষাকালে উত্তাল নদীতে নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। অনেকে শুধু মাছ ধরে। আবার একদিন ছিল যেদিন ঘাটের কুলি মজুরের কাজ করে জীবন কাটিয়েছে। বিশাল পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা নদী এক সময় স্রোতধারা হারিয়ে যায়। চরে এসে মানুষ বসতি গড়ে তোলে। জেগে ওঠা এসব চরের বিভিন্ন নামকরণ করা হয়। চরের নাম ডাকাতমারা, কাউয়াহাগা, চিলমারী, মানুষমারা, চোরমারা, ইন্দুরমারা, ছোনপচা, আটারচর, ভাঙ্গারচর, কাওয়াখোলা, মহিষাবান, শিয়ালমারী, বান কি মুন ইত্যাদি। বগুড়ার সারিয়াকান্দি, ধুনট, সোনাতলা, সিরাজগঞ্জের কাজিপুর, সিরাজগঞ্জ সদর, বেলকুচি, চৌহালী, রংপুরের কাউনিয়া, গঙ্গাচড়া, পীরগাছা, গাইবান্ধার ফুলছড়ি, সাঘাটা, সুন্দরগঞ্জ, কুড়িগ্রামের চিলমারী, রৌমারী, রাজিবপুর, নীলফামারীর ডোমার, ডিমলা উপজেলার প্রায় সবটাই চর হিসাবে গণ্য। এসব দুর্গম চরের মানুষ ঋতু পরিবর্তনের সাথে পেশা পরিবর্তন করে জীবিকা নির্বাহ করে।
নদী যখন প্রবল, পানির গতি ছিল তখনই নদীর পাড়ে একদিন গড়ে উঠেছিল ছোট-বড় ৩ শতাধিক নদী বন্দর। কালের বিবর্তনে নদীর গতিপথ হারিয়ে যায়ার সাথে সাথে নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা বন্দরও হারিয়ে গেছে। এ সব নদী বন্দরে একদিন ছিল শত শত কুলি মজুরের হাকডাক। কর্মমুখর এ সব নদী বন্দর এখন প্রবীণদের নিকট স্বপ্নের মতে মনে হয়। কত জাহাজ, বার্জ আর বিশাল পালতোলা মহাজনি নৌকা বন্দরে নোঙ্গর করেছে। মালামাল ওঠা-নামা করেছে। বিখ্যাত সেই নদী বন্দরের মধ্যে চিলমারী, ফুলছড়ি, সারিয়াকান্দি, সিরাজগঞ্জ, নগরবাড়ি, বেড়া, নাকালিয়া নদী বন্দরের এখন আর অস্তিত্ব নেই। নদীর অপ্রতিরোধ ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। এসব নদী বন্দরে এখন আর জাহাজ ভিড়ে না। ভিড়ে না মহাজনী নৌকা। পাল তোলা নৌকার বদলে স্থান করে নিয়েছে ইঞ্জিন চালিত নৌকা।
চরের প্রায় ৩০ লাখ মানুষ কাজ পেলে পেট ভরে খেতে পায়। কাজ না থাকলে খাবার জোটে না। বর্ষাকালে নৌকা চালিয়ে আর নদীতে মাছ ধরে জীবন চালায়। শুষ্ক মৌসুমে জেগে ওঠা নদীর বালির চরে মরিচ, ধান, পাট, চিনা, কাউন, বাদাম, তিল, তিশি চাষ করে। চরের মানুষ জেগে ওঠা চরের জমির অধিকার পায় না। চরবাসী দস্যুরা তাদের লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে জেগে ওঠা চর দখলে নেয়। চরের মানুষ সে জমি বর্গা চাষ করে। লাঠিয়াল বাহিনী তাদের চাষ করা জমির সব ফসল কেটে নিয়ে যায়। কাজিপুর উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক বকুল সরকার, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান সুলতানা হক ও চরের মনসুর নগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক ওরফে রাজমহর জানান, শুষ্ক মৌসুমে চর থেকে চরে যাতায়াতের মাধ্যম পায়ে হেঁটে, বাইসাইকেল এবং কোন কোন ক্ষেত্রে চরের বালিতে চলছে ঘোড়ার গাড়ি ও ভ্যান। চরের মানুষ মরিচ, সবজি, পাট, ধান চাষ করে। তাদের জরিপে আরো জানা যায়, এসব চরের সাথে উপজেলা সদরের কোন ভাল যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই। মনসুরনগর থেকে কাজিপুরে সদরে আসতে একমাত্র সহায় ইঞ্জিনচালিত নৌকা। সকালে একবার মনসুরনগর থেকে ছেড়ে যায়। আবার বিকালে ফিরে আসে। যাতায়াতে সময় লাগে দুই ঘণ্টা। বর্ষ মৌসুমে সময় লাগে একটু কম। প্রতিদিনই এ শ্যালোইঞ্জিন চালিত নৌকা সার্ভিস চলে। বান কি মুন চর, পীরগাছা, রঘুনাথপুর, চরগিরিশ, রূপসা, খাসরাজবাড়ী, চরছিন্না, নাটুয়ারপাড়া, সানবান্ধা চরের স্থায়ী বাসিন্দা ওমর আলী, আফজাল হোসেন, আব্দুল কাদের, কামরুল, হাসান, কামাল হোসেন, বেলাল হোসেন, নুরুল ইসলাম, আনোয়ার হোসেন, যমুনা নদীর ভাঙা-গড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে বেঁচে আছে। নদীর ভাঙনে বসতবাড়ি জমি-জমা হারিয়েও চর ছাড়ে না তারা।
তাদের একটিই কথা, নদীর টানেই তারা পড়ে থাকে চর থেকে চরে। নদী যেমন দুঃখ দেয়, কেড়ে নেয় ঘর-বাড়ি, জোতজমি। তেমনি নদীই তাদের সৌভাগ্য বয়ে আনে। ঋতু পরিবর্তনের সাথে তারা পেশা বদল করে। এক সময় জেলে। কোন সময় নৌকার মাঝি। আবার এক সময় কৃষক। সময়ে ঘাটের ঘাটে কুলি-মজুরের কাজ করে। চরবাসির দাবি চরের জেগে ওঠা জমির সুষ্ঠু বণ্টন বা ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা অপরিহার্য। চরগ্রাসীদের কবল মুক্ত করা হলে চরের মানুষের দুঃখ থাকবে না। মৌসুমে একটা সময় আসে যখন হাতে কাজ থাকে না। সে সময় চরাঞ্চলে কাজের সুযোগ সৃষ্টি করলে মঙ্গা স্পর্শ করতে পারবে না।



 

Show all comments
  • ২৯ নভেম্বর, ২০১৬, ১০:০৩ এএম says : 0
    নদি ভাংগন দেশের দারিদ্রর প্রধান কারন
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নদী

২৬ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ