Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইয়াবা ব্যবসায় পুলিশ ছাত্রলীগ নেতা

রাজধানীর উত্তরখান থানা

ইয়াছিন রানা | প্রকাশের সময় : ১৭ জুলাই, ২০২২, ১২:০১ এএম

মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলের ভিতর বা বাহির কাউকেই ছাড় দেয়া হচ্ছে না। মাদকের সঙ্গে জড়িত কাউকে দলীয় পদ দেয়াও নিষিদ্ধ। প্রশাসনও মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে। কিন্তু এতকিছুর পরও মাদকের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা দলের পদ পাচ্ছেন। পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও মাদক সেবন ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন।

উত্তরখান থানা ছাত্রলীগের নব নির্বাচিত সভাপতি শাহাদাত হোসেন সাব্বিরের বিরুদ্ধে ইয়াবা সেবন ও ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে দক্ষিণ খানে একটি চালের আড়তে হামলা ও লুটপাটের অভিযোগে মামলা দায়ের হয়েছিল। সাব্বিরের ইয়াবা সেবনের একটি ভিডিও ইনকিলাবের হাতে এসেছে।

এদিকে রাজধানীর উত্তরখান থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) নাজমুল হাসানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি নিজে এবং সোর্স দিয়ে ইয়াবা বিক্রি করেন। আসামী ধরার সময় যত সংখ্যক ইয়াবা পাওয়া যায় তার চেয়ে অনেক কম সংখ্যক ইয়াবা রিকোভারি দেখিয়ে বাকি সংখ্যক ইয়াবা বিক্রি করে দেন এই এএসআই। বিষয়টি জানেন থানার ওসি এবং তার অন্যান্য সহকর্মীরাও। এই এএসআই’র কিছু অডিও ও ভিডিও ইনকিলাবের হাতে রয়েছে।

উত্তর খান থানা ছাত্রলীগের নতুন কমিটি ঘোষণা হয় গত জুন মাসে। সাব্বির ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান হৃদয়ের অনুসারি। উত্তর খান ছাত্রলীগে তার প্রতিদ্বন্দ্বি ছিলেন এমন একজন নেতা জানান, বিগত কয়েক বছর ধরে সাব্বির ইয়াবা সেবন ও ব্যবসার সাথে জড়িত। এটা সবাই মোটামুটি জানে। ইয়াবা সেবনের বিষয়ে জানতে চাইলে শাহাদাত হোসেন সাব্বির কোন উত্তর দিতে পারেননি। তিনি বলেন, পরে দেখা করবেন। নিউজ না করতেও অনুরোধ করেন তিনি।

ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান হৃদয় ইনকিলাবকে বলেন, এটি একটি ষড়যন্ত্র। কি ষড়যন্ত্র জানতে চাইলে তিনি বলেন, যিনি আপনার কাছে ভিডিও দিয়েছেন তিনি তো আমার কাছে ভিডিও দিতে পারতেন। কেন দেননি? কমিটি হবার পর কেন ভিডিও সাংবাদিকের কাছে গেল? এটি হল ষড়যন্ত্র। অনেক যাচাই বাছাই করে কমিটি করি। সেই কমিটি বাতিল করা আমাদের জন্য সম্মানজনক নয়।
ঢাকা উত্তর ছাত্রলীগের সভাপতি ইব্রাহিম হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, আমারা যাচাই বাছাই করে কমিটি দেই। এরপর যদি এ ধরণের কিছু প্রমাণ পাই তাহলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এদিকে উত্তরখান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল মজিদের সাথে থানার এএসআই নাজমুল হাসানের কথোপকথনের একটি রেকর্ডে এএসআইয়ের ইয়াবা ব্যবসার বিষয়টি উঠে এসেছে। এছাড়া নাজমুলের সাথে তার সোর্সের কথোপকথনেও ইয়াবা ব্যবসার বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে।
অডিওতে শোনা যায়, ওসি আব্দুল মজিদ এএসআই নাজমুলকে বলেন, তুমি আকাম করছো। মাল বেচো তুমি ঘুইরা ঘুইরা। তুমি কার কাছে বেচো আমি জানি। পাঁচ, ছয় হাজার, নয় হাজার সব বেইচ্যা কিইন্যা শেষ করছো। মান সম্মান সব গেছে, আল্লাহ বাচাইছে। কাল দরখাস্ত দিয়া এখান থেকে চলে যাবা। তোমারে এখানে রাইখ্যা আমি ওসিগিরি হারামু?। দীর্ঘ দিন ধরে তুমি আকাম করতাছো। একশো পিচ, দশ পিচ করে তুমি বিক্রি করো। পুরো দক্ষিণ খান থানা জানে। প্রত্যেকের কানে কানে তোমার নাম।

ওসি আব্দুল মজিদ এবং এএসআই নাজমুলের অডিও ও ভিডিও রেকর্ডে কথোপকথন তুলে ধরা হল : নাজমুল বলেন, আমি ওই জিনিসটা একটু তরজমা করলাম স্যার, কথাটা কই থাইক্যা বিষয়টা আসলো। ওসি আব্দুল মজিদ: তুমি আর কথা বইলো না, ফালতু লোক। নাজমুল: দক্ষিণ খান থানায় আমার একশোর নিচে কোন মামলা নাই। ওসি: একশো পিচ ? কমায়া দিলেই তো পারো। নাজমুল: বাড়াইয়ো নাই, কমাইয়ো নাই। একটা একশো পিচ, আরেকটা একান্ন পিচ। ওসি: ধুরো কমায়া তো আমরাও দেই, বাড়ায়াও দেই। নাজমুল: ষড়যন্ত্র হইতাছে স্যার। ওসি: ষড়যন্ত্র! ভালা কথা কইলে ষড়যন্ত্র। নাজমুল: যার কাছে বেচছি ডাকেন তারে। ওসি: ওরে ডাকলে তো তুমি ক্লোস হয়া যাও। নাজমুল: আমি যাদের সাথে চলি, যারা আমার সোর্স, একটা লোকও তো ধরা খায় নাই। তাহলে কথাটা কে বললো। ওসি: যারে মাল দিসো, সে ধরা খাইছে। সে এখন জেলে। আমি কী ভুল শুনছি? আল্লাহ রহমত করছে ওইদিন। নাজমুল: আমার পরিচিতরা কেউ ধরা খায় নাই। ওসি: তুই কী মালের ব্যবসা করার জন্য আইসোস নাকি? নাজমুল: আমি তো কোন ক্লু পাইতাছি না। ওসি: ক্লুর দরকার কি ? তুমি আকাম করছো শেষ। মাল বেচো তুমি ঘুইরা ঘুইরা। নাজমুল: না স্যার মিথ্যা কথা। এটা নিয়া তো প্রটেস্ট না করলেও কইবো হ হাচাই মনে হয়। যারে মাল দিসি ধরা খাইছে এমন ক্লু তো নাই। ওসি: মান সম্মান সব গেছে, আল্লাহ বাচাইছে। যে মাসে এসআইটা দুইটা ধরা খাইছে পরের মাসে ওসি ক্লোস হইছে। শামীম স্যার ক্লোস হইছে। বুঝে না সবাই। তুমি কার কাছে বেচো আমি জানি। পাঁচ, ছয় হাজার, নয় হাজার সব বেইচ্যা কিইন্যা শেষ করছো। প্রমাণ দিলে তো তোমারে এরেস্ট করতো, এছাড়া অন্য পথ নাই। নাজমুল: প্রমাণ দিতে পারবো না দেইখ্যাই তো কিছু বলে না। ওসি: তাইলে ডিসি স্যার কে বলি সে তো চ্যালেঞ্জ করছে। নাজমুল: আমি একশো পারসেন্ট চ্যালেঞ্জ। ওসি: ফাইজলামি করার জায়গা পাও না। কাল দরখাস্ত দিয়া এখান থেকে চলে যাবা। দ্রুত চলে যাবা এই থানা থেকে। ভাল হবে। আমার লগে ভাল আছো, তুমি বাইরে যায়া করো। তোমারে তো পাপে .... নাই তো, তোমারে এখানে রাইখ্যা আমি ওসিগিরি হারামু। চ্যালেঞ্জ করার জন্য আমার কাছে চলে আইছে। নাজমুল: আসলে এমন কিছু ঘটে নাই। ওসি: আবার চ্যালেঞ্জ করার জন্য আসছে। দীর্ঘ দিন ধরে তুমি আকাম করতাছো। একশো পিচ, দশ পিচ করে তুমি বিক্রি করো। পুরো দক্ষিণ খান থানা জানে। প্রত্যেকের কানে কানে তোমার নাম। ওই থানায় যায় জিজ্ঞেস করো কয় পিচ? ইবলিশে কামরায় নাকি তোমারে ওই থানায় গেছো? ফাইজলামির জায়গা পাও না, আমি ধামা চাপা দেই, আবার সে চ্যালেঞ্জ করে। আবার কয় ষড়যন্ত্র। বাহবা কত দামি লোক! তারে নিয়া ষড়যন্ত্র করতাছে। উত্তরখান থানায় কেউ আইতাছে তার প্রতিদ্বন্দ্বি। ফাইজলামির আর জায়গা পাও না। নাজমুল: মাফ কইরা দেয়া যায় না স্যার?

আরেকটি রেকর্ডে শোনা যায়, এএসআই নাজমুলকে তার সোর্স মাদক ব্যবসায়ী বিষু বলেন, স্যার আপনি মনে কইরেন না যে আপনি মাল দেন দেইখ্যা আপনার সাথে সম্পর্ক। আমি চাইলে অন্য জায়গা থাইক্যা মাল আনতে পারি। আমি একটা নীতি নিয়া চলি। নীতি নাই মানে আমার ব্যবসা নাই। এ সময় নাজমুল বলেন, যে যত কথাই বলুক আমারে কেউ বের করতে পারবে আমি যে মাল বেঁচি? আমারে সিনিয়র অফিসারের কাছে নিয়া যাক, আমি যদি কাউরে মাল না দিয়া থাকি তাহলে কেউ কী বলতে পারবে আমি তারে দিসি ? আমারে বলতে পারবো আপনি দিসেন? মাইরা লামু না। বিষু নাজমুল কে বলেন, জ্বি স্যার একদম ঠিক। স্যার আপনার ডোরে সবাই রাত দুইটারর পর থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত মাল বেঁচে। স্বপ্নেও আপনারে দেখে। বিষু আরো বলেন, ১৫-২০ বছর ধরে পুলিশের সাথে চলি, আমার একটা অভিজ্ঞতা তো আছে, কারো সাথে ফোনে কথা বলবেন না। সোর্স শহীদুল খিলক্ষেতের মনসুর স্যারকে মাল দেয়। শহীদুলের মেসেঞ্জারে শত শত মেসেজ মনসুর স্যারের। স্যার তো তারছিড়া। লেখে কয় পিচ আনছোন। আমি কসাইবাড়ি। বিষু নাজমুলকে আরো বলেন, আপনি মোবাইলে কিছু কইরেন না স্যার। সরাসরি করবেন। মাল সাইডে সুইডে রাখবেন আর দেখায়া দিবেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এএসআই নাজমুল হাসান ইনকিলাবকে বলেন, এই রেকর্ডটি বেশ কিছুদিন আগের। ওসি স্যার আমাকে শাসন করেছেন। তিনি আমাকে শাসন করতেই পারেন। এখন কে বা কারা আপনাকে রেকর্ডটি দিয়েছে তা আমি জানি। আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। ইয়াবা বিক্রির বিষয়টি মিথ্যা বলে দাবি করেন তিনি। তিনি আরো বলেন, কনস্ট্যাবল থাকা অবস্থায় তথ্যমন্ত্রণালয়ে ডিউটি করতেন তিনি। সে সময় তিনি সাংবাদিকদের লাইসেন্স দিতেন। তবে কিসের লাইসেন্স দিতেন প্রশ্ন করলে কোন সদুত্তোর দিতে পারেননি।
এ বিষয়ে উত্তরখান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল মজিদ ইনকিলাবকে বলেন, এএসআই নাজমুলের বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্তে দোষী প্রমাণ হলে ব্যবস্থা নিব। সে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত এবং আপনি তাকে থানা থেকে দরখাস্ত দিয়ে অন্য কোথাও চলে যেতে বলেছেন বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আমি বলছি কিনা সঠিক জানিনা। তবে খারাপের জন্য তদবির আমি করি না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইয়াবা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ