Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে রানিল বিক্রেমাসিংহে

মাহিন্দা ও বাসিলের দেশত্যাগে আদালতের নিষেধাজ্ঞা

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১৭ জুলাই, ২০২২, ১২:০২ এএম

অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সঙ্কটে চরম অস্থির শ্রীলঙ্কায় অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী রানিল বিক্রেমাসিংহে। মাত্র গত বৃহস্পতিবার সিঙ্গাপুরে পালিয়ে যাওয়া প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকশে পদত্যাগ করার পর তার জায়গায় প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিলেন রানিল বিক্রেমাসিংহে। শ্রীলঙ্কা গত কয়েক সপ্তাহ ধরে অভূতপূর্ব সরকার বিরোধী বিক্ষোভে অচল হয়ে আছে। বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ পর্যন্ত দখল করে নিয়েছিল এবং প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে আগুন দিয়েছিল। বৃহস্পতিবার রাতে যখন প্রেসিডেন্ট রাজাপাকশের পদত্যাগের খবর প্রকাশ পায়, তখন কলম্বোতে কারফিউ উপেক্ষা করে জনতা রাস্তায় নেমে উল্লাস করে। শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজপাকশের পলায়নের পর তার বড় ভাই মাহিন্দা রাজাপাকশে ও ছোট ভাই বাসিল রাজাপাকশের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। গতকাল শুক্রবার সর্বোচ্চ আদালত এই নিষেধাজ্ঞা দেন।
অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে শ্রীলঙ্কায় খাদ্য, জ্বালানি এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর তীব্র ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আজ শনিবার শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্ট একজন নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু করবে। এক সপ্তাহের মধ্যে এমপিদের ভোটে একজন নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
সরকারি দলের যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে, তাই এমপিরা রানিল বিক্রেমাসিংহেকেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নিতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে। তবে মিস্টার বিক্রেমাসিংহের সঙ্গে রাজাপাকশে পরিবারের বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। কাজেই শ্রীলঙ্কার জনগণ এটি মেনে নেবে কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন। কারণ সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রী রানিল বিক্রেমাসিংহেকেও পদত্যাগ করতে হবে বলে দাবি করছিল। এ সপ্তাহের শুরুতে জনতা তার বাড়ির ভেতরেও ঢুকে পড়ে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে তাদের সঙ্ঘাত হয়েছিল। তখন একজন বিক্ষোভকারী মানুরি পাবাসারি বিবিসিকে বলেছিলেন, সামনের দিনগুলোতে রানিল বিক্রেমাসিংহের বিরুদ্ধেও বিক্ষোভ শুরু হবে।
‘তার পেছনে জনগণের কোনো সমর্থন নেই এবং তিনি রাজাপাকশের সমর্থক হিসেবে পরিচিত’, বলছিলেন তিনি। ‘নতুন প্রেসিডেন্ট এবং নতুন প্রধানমন্ত্রী রাজাপাকশের সমর্থকদের মধ্য থেকে হতে পারবে না’।
এদিকে শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নন্দলাল ভিরাসিঙ্গে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, শিগগিরই যদি একটি স্থিতিশীল সরকার গঠন করা না যায়, শ্রীলঙ্কা একদম অচল হয়ে যাবে। বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, প্রয়োজনীয় পেট্রোল কেনার জন্য যথেষ্ট বিদেশি মুদ্রা পাওয়া যাবে কিনা সেটা নিয়ে বিরাট অনিশ্চয়তা আছে। তিনি আরো বলেন, শ্রীলঙ্কাকে দেনার দায় থেকে উদ্ধারে যে আন্তর্জাতিক সাহায্য দরকার, সেটা নির্ভর করবে এরকম একটি সরকার গঠনের ওপর।
এদিকে সিঙ্গাপুর জানিয়েছে, গোতাবায়া রাজাপাকশে সেখানে আসার পর এখনো রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেননি। সাবেক প্রেসিডেন্ট গত বৃহস্পতিবার তার স্ত্রী এবং দুজন দেহরক্ষী সাথে নিয়ে সিঙ্গাপুরে আসেন। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তিনি যে আইনি সুরক্ষা আগে পেতেন, সেটি এখন তার নেই। কাজেই নিরাপদে থাকার জন্য একটি দেশে আশ্রয় খোঁজার কাজটি তার জন্য এখন আরো কঠিন হয়ে পড়লো।
শ্রীলঙ্কার নিরাপত্তা সূত্রগুলো বার্তা সংস্থা এএফপিকে জানিয়েছেন, তিনি হয়তো কিছুদিন সিঙ্গাপুরে থাকবেন, এরপর তিনি সম্ভবত সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাওয়ার চেষ্টা করবেন।
বিলুপ্ত হবে প্রেসিডেন্টের পতাকা, বাদ যাবে ‘হিজ এক্সেলেন্সিও’ : শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী রানিল বিক্রেমাসিংহে শপথ নিয়ে প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসে বেশ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তার সিদ্ধান্ত অনুসারে এখন থেকে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টকে সম্বোধনে ‘হিজ এক্সেলেন্সি’র ব্যবহার বাতিল হচ্ছে। বিলুপ্ত হচ্ছে প্রেসিডেন্টের পতাকাও। গতকাল শুক্রবার স্থানীয় সময় দুপুর ১২টার দিকে প্রধান বিচারপতি জয়ন্ত জয়সুরিয়ার কাছে শপথ নেন রানিল। তারপরই এসব সিদ্ধান্তের কথা জানান তিনি। লঙ্কান এ গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, দেশের আইন-শৃঙ্খলা, গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষায় নিজের প্রতিশ্রুতির ওপর জোর দিয়েছেন রানিল বিক্রেমাসিংহে। টেলিভিশনে দেওয়া বক্তব্যে তিনি বলেন, আমি কখনই কোনো অসাংবিধানিক কাজে সহায়তা করব না। কারণ, আইনশৃঙ্খলার পতন দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ সময় তিনি খাদ্য, বিদ্যুৎ এবং পানি সরবরাহের শৃঙ্খলা ব্যাহত হতে পারে বলে সতর্ক করেন। জনগণকে সামনে আসা বিপৎজ্জনক পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা রাখতে আহ্বান জানান তিনি।
রানিল আরো বলেন, শূন্য রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছাড়া দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ, পুলিশের মহাপরিদর্শক এবং তিন সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডারদের সমন্বয়ে একটি বিশেষ কমিটি করা হয়েছে। সংবিধানের ১৯তম সংশোধনী আবারও সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করা উচিৎ বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
রাজনীতিবিদদের উচ্চাকাঙ্খা একপাশে রেখে দেশের কথা ভাবতে আহ্বান জানিয়ে লঙ্কান অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট বলেন, ব্যক্তিকে রক্ষা করার চেয়ে দেশকে রক্ষা করুন। দেশকে বাঁচাতে রাজনীতিতে সক্রিয় থাকুন। এ সময় প্রেসিডেন্টের ভাষণকালীন তাকে হিজ এক্সেলেন্সি শব্দটির ব্যবহার নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানান রানিল। প্রেসিডেন্টের পতাকা বিলুপ্ত করা হবে বলেও তিনি জানান। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, দেশকে একটিমাত্র পতাকা ছায়াতলে রাখতে হবে এবং সেটি শুধুমাত্র জাতীয় পতাকা।
দেশে যে বিক্ষোভ চলছে সে ব্যাপারে তিনি বলেন, আইন ও শান্তি বজায় রাখার জন্য অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ গৃহীত হয়, তবে কেউ কেউ নাশকতার কাজে লিপ্ত রয়েছে। কেউ কেউ নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের ওপর চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছেন। কোনো গোষ্ঠীকে সংসদীয় গণতন্ত্র নষ্ট করতে দেয়া হবে না।
মাহিন্দা ও বাসিলের দেশত্যাগে আদালতের নিষেধাজ্ঞা : শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজপাকশের পলায়নের পর তার বড় ভাই মাহিন্দা রাজাপাকশে ও ছোট ভাই বাসিল রাজাপাকশের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। গতকাল শুক্রবার সর্বোচ্চ আদালত এই নিষেধাজ্ঞা দেন।
শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে প্রভাবশালী রাজাপাকশে পরিবারের সিনিয়র সদস্য মাহিন্দা রাজাপাকশে দেশটির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। প্রবল জনবিক্ষোভের মুখে গত মে মাসে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি। বর্তমানে শ্রীলঙ্কার উত্তরাঞ্চলীয় শহর ত্রিকোনমালিতে নৌবাহিনীর একটি ঘাঁটিতে সপরিবারে রয়েছেন তিনি। বাসিল রাজাপাকশে ছিলেন শ্রীলঙ্কার অর্থমন্ত্রী। তিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন আরো আগে, মার্চের শেষের দিকে।
গত ১২ জুলাই দেশত্যাগ করে দুবাই যেতে গোপনে কলম্বো বিমানবন্দরে এসেছিলেন বাসিল রাজাপাকশে। কিন্তু দেশটির সরকারবিরোধী একদল বিক্ষোভকারী বিমানবন্দর ঘেরাও করে রাখায় ভেস্তে যায় সেই পরিকল্পনা।
১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর বর্তমানে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সঙ্কট পার করছে শ্রীলঙ্কা। দেশটিতে বর্তমানে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বলতে কিছুই নেই। ফলে খাদ্য, ওষুধ, জ্বালানির মতো অতি জরুরি পণ্যও আমদানি করতে পারছে না দেশটি।
উদ্ভূত এই পরিস্থিতির জন্য রাজাপাকসে পরিবারের অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতিকে দায়ী করে চলতি বছরের মার্চ থেকে শান্তিপূর্ণ সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু হয় শ্রীলঙ্কায়। আন্দোলনকারী জনগণ শুরু থেকেই প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে, প্রধামন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে ও তার নেতৃত্বাধীন সরকারের পদত্যাগ দাবি করে আসছিলেন। সূত্র : এনডিটিভি, নিউজফার্স্ট, আল-জাজিরা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ