Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আরাকান প্রদেশ এখন যেন এক মৃত্যুপুরী

শামসুল হক শারেক, মিয়ানমার সীমান্ত থেকে ফিরে | প্রকাশের সময় : ২৭ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশের পাশর্^বর্তী মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশ এখন যেন এক মৃত্যুপুরী। ২ লাখ ৬১ হাজার ৯৭০ বর্গমাইলের মিয়ানমারে ২০ হাজার বর্গমাইল এলাকাজুড়ে রোহিঙ্গা মুসলিম অধ্যুষিত আরাকান। বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বে নাফ নদী ও সাগর উপকূলে বিস্তীর্ণ ‘আরাকাঁ ইয়ামা’ পাহাড়ের পাদদেশে সমৃদ্ধ আরাকানের অবস্থান। এখানে হাজার বছর ধরে বসবাস করে আসছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম। এখন গোটা আরাকানকে চারপাশে ঘিরে রেখেছে মিয়ানমারের সেনা-পুলিশ। এতেই শেষ নয়, রোহিঙ্গা নিধনে সেখানে রাত-দিন চলছে সেনা-পুলিশও মগদস্যুদের যৌথ অভিযান।
চার পাশে সেনা-পুলিশ ঘিরে রেখে রোহিঙ্গাদের উপর চালানো হচ্ছে ইতিহাসের জঘন্যতম নির্যাতন। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি। আগুন থেকে পালানোর চেষ্টায় ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে চাইলে সেনা-পুলিশ ও মগদস্যুরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করছে নারী-শিশু পুরুষ নির্বিচারে। বনে জঙ্গলে আশ্রয় নিতে চেষ্টা করলে সেনা বাহিনী হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে হত্যা করছে রোহিঙ্গাদের। আরাকান এখন যেন এক নরকপুরী। কান লাগিয়ে শুনলে যেন বাংলাদেশ সীমান্তের এপার থেকে শুনতে পাওয়া যায় নির্যাতিত রোহিঙ্গা নারী শিশু পুরুষের আর্তচিৎকার ‘বাঁচাও আমাদের বাঁচাও’। সুরায়ে নিসার ৭৫-৭৬ আয়াতে বলা হয়েছে ‘কি হয়েছে তোমাদের, কেন তোমরা তাদের রক্ষায় এগিয়ে আসছ না? অথচ নির্যাতিত জনপদের নারী শিশু পুরুষ চিৎকার করে বলছে হে! আল্লাহ আমাদেরকে জালিমের এই জনপদ থেকে কোথাও নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাও। অথবা তুমি আমাদের জন্য সাহায্যকারী কোন বন্ধু পাঠাও’।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর তাড়া খেয়ে এখন হাজার হাজার রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে প্রাণ ও সম্ভ্রম রক্ষার্থে পালিয়ে আসছে। একটু আশ্রয়ের জন্য হাত জোড় করে একটু মাথা গোজার ঠাঁই খুঁজছে। সীমান্তের উভয় পারে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে নির্যাতিত রোহিঙ্গা মসুলমানদের কান্নায়। স্বদেশের অসহনীয় জুলুমে বিপর্যস্ত হয়ে তারা মিয়ানমারের আরাকান রাজ্য থেকে জল ও স্থলপথে অবৈধভাবে ঢোকার অপেক্ষায় আছে বাংলাদেশে। ধর্ষণের শিকার নারী, স্বামী হারা স্ত্রী, কেউ বা পুত্র ও পিতৃ-স্বজনহারা। এদের মধ্যে অনেকেই আছে নির্যাতনে ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে নারী-শিশু।
মিয়ানমারের সীমান্তের ওপারে অবস্থা আরো ভয়াবহ। নৌ, স্থল, আকাশ পথে চলছে থেমে থেমে নৃশংস আক্রমণ। ফলে গগণবিদারী নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদের আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে উঠছে আকাশ বাতাস। গোটা আরাকান প্রদেশজুড়ে বিশেষ করে উত্তর মংডুর রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় আতঙ্ক কাটছে না। সে দেশের সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর দমন পীড়ন ও নির্যাতনে কোণঠাসা রোহিঙ্গারা নিজ ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছে। নাফ নদী ও সাগর জলে ভাসছে নারী-পুরুষ ও নিরীহ মানুষ বোঝাই অনেক নৌকা।
এদিকে নাফনদী ও সাগরে মিয়ানমার-বাংলাদেশের নৌবাহিনী ও কোষ্টগার্ডের টহল যানের আওয়াজে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব বিরাজ করছে সীমান্তে। এপারের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী কঠোরভাবে প্রতিরোধ করছে অবৈধভাবে রোহিঙ্গারা কোনভাবেই যেন তারা এই দেশে প্রবেশ করতে না পারে। কিন্তু এটা মানবতার কোন পর্যায়ে পড়ে? এর কোন উত্তর নেই।
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা এবং সীমান্তের ওপার থেকে বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যগুলো আরো লোমহর্ষক। ‘গত শনিবার মিায়ানমার পুলিশ ও সেনাবাহিনী পাড়ায় ঢুকে বর্বরতা চালায়। বাড়ি-ঘরে আগুন দেয়। পুরুষদের ধরে নিয়ে যায়। কোলের শিশুদের কেড়ে নিয়ে আগুনে পুড়ে হত্যা করেছে। এভাবে গ্রামের পর গ্রাম জ¦ালিয়ে-পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিচ্ছে। স্বামী ও বড় ছেলেকে ভাতের পাত থেকে তুলে নিয়ে চোখের সামনেই হত্যা করেছে। মা-বাবার চোখের সামনেই যুবতী মেয়ের ধর্ষণের পর হত্যা করা হচ্ছে। সেই ভয়াবহ নির্যাতন-নির্মম গণহত্যা, অমানবিক অত্যাচার সইতে না পেরে ভিটে-মাটি ছেড়ে বাংলাদেশের দিকে পালিয়ে আসছে সেখানে গুম, হত্যা থেকে বেঁচে থাকা রোহিঙ্গারা।
গতকাল ভোরে এক নৌকায় এসেছেন আরও ১৭ জন নারী, শিশু ও ৪ পুরুষ। এসময় নাফ নদীতে আর ১০/১২ নৌকায় বহু মানুষ ভাসতে দেখেছেন বলে জানান তারা। প্রতিটি নৌকায় নারী-শিশুর সংখ্যাই ছিল নাকি বেশি। তারা আরো জানান, ‘সেনাবাহিনী সন্ত্রাসী ধরার কথা বলে ধর্ষণ-নির্যাতনে লিপ্ত রয়েছে। তারা যেদিন যে পাড়ায় খুশি রাতের বেলা ঢুকে পড়ছে। তারা পাড়া ঘিরে কিশোরী-যুবতীদের নির্যাতন চালাচ্ছে। স্বর্ণালংকার, টাকা লুট করছে। তারপর ঘরে আগুন দিচ্ছে। প্রতিবাদ করলে গুলি করে, জবাই করে হত্যা করছে। মায়ের কোল থেকে শিশুদের কেড়ে নিয়ে আগুনে নিক্ষেপ করছে।
এদিকে মিয়ানমারে চলমান সংঘাতের কারণে সীমান্ত পরিস্থিতি পর্যাবেক্ষণ করতে দু’দিন আগে কক্সবাজার এসেছিলেন বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন। শুক্রবার বিকালে তিনি বিকালে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপসহ সীমান্তের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেন।
এর আগে দুপুরে টেকনাফ বন্দর রেস্ট হাউস প্রাঙ্গণে এক সংবাদ সম্মেলনে মিয়ানমারের আরাকান (রাখাইন) প্রদেশে রোহিঙ্গাদের মুসলিমদের ওপর অনেক অত্যাচার করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি। যা এখনো চলছে। ফলে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তবে ঢালাওভাবে যেভাবে অনুপ্রবেশের কথা অস্বীকার করেন তিনি।
ইতোমধ্যেই মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিম নির্যাতনের বিষয়টি আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি কেড়েছে। জাতিসঙ্ঘ, মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং ওআইসি রোহিঙ্গা মুসলমানের উপর মিয়ানমারের অমানবিক নির্যাতনের প্রতিবাদ জানিয়েছে। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে তাদেরকে মানবিক সাহায্য দেয়ার জন্যও অনুরোধ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের মানুষ গর্জে উঠেছে মগদস্যুদের জঘন্যতম বর্বরতার বিরুদ্ধে। গতকাল রাজধানীতে, চট্টগ্রামেও সিলেটে হাজার হাজার মুসল্লি মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছে। তারা দাবী তুলেছে, মিয়ানমারের উপর অবরোধ আরোপ করতে, কথিত গণতন্ত্রের লেবাসধারী অংসান সুকিকে লেডি হিটলার আখ্যাইত করে তার বিরুদ্ধে গণতন্ত্র হত্যার অভিযোগ এনেছে। এছাড়াও রোহিঙ্গা মুসলমানদের রক্ষায় জাতিসংঘে বাহিনী মোতায়েন ও তাদেরকে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
এরই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে কড়া প্রতিবাদও করছে। কিন্তু ‘চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনী’র মত মিয়ানমারের সেনা-পুলিশ ও মগদস্যুরা একঘণ্টার জন্যও তাদের জিঘাঙসা বন্ধ করেনি।
এখন কনকনে শীতে গুম, খুন থেকে বেঁচে যাওয়া এবং বালাদেশে আশয়্র নেয়া রোহিঙ্গাদের দরকার মানবিক সহযোগিতা। তাদের দরকার খাদ্য, গরম কাপড়, মাথা গোঁজাবার আশ্রয় ও আহত রোহিঙ্গা নারী শিশুর মানবিক চিকিৎসা।
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার রাত থেকে শনিবার পর্যন্ত উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশকালে ৪১ জন রোহিঙ্গাকে আটকের পর স্বদেশে ফেরত পাঠানো হয় এবং নাফনদী থেকে রোহিঙ্গাবাহী ৮টি নৌকা ফেরত পাঠানো হয়েছে।
আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলিম ও রোহিঙ্গাদের অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে গবেষক মুহাম্মদ ইলিয়াস সোলতান বলেন, মিয়ানমারের আরাকানে যে পরিমাণ নির্যাতন হচ্ছে তার সামন্য খবরই শুধু আমরা পাই। বাস্তব ঘটনার তারচেয়ে অনেক বেশী ভয়াবহ বলে উল্লেখ করে তিনি রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াতে আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন কক্সবাজার সদর উপজেলা রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিরুদ্ধে শহরে এক মানববন্ধন ও র‌্যালী বের করেছে। এতে বক্তব্য রাখেন কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি ও বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন কক্সবাজার জেলা সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী (খোকা), জেলা কমিউনিটি পুলিশের সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি এডভোকেট আমজাদ হোসেন, কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সহ-সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার কানন পাল, হিমছড়িসহ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি এডভোকেট আয়াছুর রহমান প্রমুখ।



 

Show all comments
  • আবুল হোসেন চরকৃষ্ণজয়ী ২৭ নভেম্বর, ২০১৬, ৩:৫৬ পিএম says : 0
    ইহুদী, খৃষ্টান, বৌদ্ধ, হিন্দু কেউই দুনিয়াতে শান্তির প্রমান রাখতে পারে নাই অশান্তি ছাড়া !! তাই সকল শান্তিকামী দুনিয়াবাসীকে এখনই ইসলামের শান্তির ছাযাতলে আশ্রয় নেয়া উচিত, এর বিকল্প উপায় নেই। বার্মায় মানবতা ভুলিন্ঠিত; বিশ্ব মাতব্বরদের চোখ কি অন্ধ হয়ে গেছে..?? যদি না হয় দোয়া করি তাদের চোখ সত্যি অন্ধ হয়ে যাক। Where is America now ??? Can't looking oppressed Muslim of Mayanmar or not only America is the enemy of the Islam and humanities. আমেরিকা এখন কোথায়?? দেখছেনা অত্যাচারী মায়ানমারের মুসলিমদের?? নাকি আমেরিকা একমা্ত্র মুসলমান ও মানবতার শত্রু..????? We pray to Allah, destroy America soon. এখনই সময় সমগ্র মুসলিম বিশ্ব এক হয়ে আরেক ক্রুসেডের ডাক দেয়া - যা 11 শতাব্দিতে গাজী সালাহ্ উদ্দিন উয়ুবী করেছিলেন এবং জেরুজালেম ইহুদীদের দখলমুক্ত করেছিলেন .. কোথায় সেই মুসলিম নেতা ............ সবইতো দেখি মুনাফেক ইহুদী খৃষ্টানদের পাছাটা দালাল ......... ইহুদী খৃষ্টানদের আর ছেড়ে দেয়া যায় না, এখনই প্রতিরোধ ও উপযুক্ত জবাব দেয়ার উপযুক্ত সময়। আর দেরী নয় সমগ্র মুসলিম বিশ্ব এক হও। আর কারো পা-ছাটার সময় নেই --- মনে ঈমানী আগুন জ্বালাও এবং ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলো .... দেখ সাদা চামড়ার “ইহুদী, খৃষ্টান” নামের মানবরূপী কুত্তাগুলো দুনিয়াতে কি করছে ..???????
    Total Reply(0) Reply
  • mohammad abdul hannan ২৭ নভেম্বর, ২০১৬, ৬:৫৯ পিএম says : 0
    where is humanity.where is kindness.world has lost its conscience
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রোহিঙ্গা

১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ