পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
জেনোসাইড মানে গণহত্যা। ইংরেজি শব্দ ‘স্টপ জেনোসাইড’ শব্দগুচ্ছের অর্থ ‘বন্ধ করো গণহত্যা’। ’৭১-এ বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, গণহত্যা, হানাদার পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর হত্যাকা-, শরণার্থী শিবিরে মানুষের যাপিত জীবন তথ্যচিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান ও আলমগীর কবির। ২০ মিনিট দৈর্ঘের ওই তথ্যচিত্রটি প্রচারণা দিয়ে ‘বিরোধ’ হলেও সেটি দেশ-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ‘স্টপ জেনোসাইড’ গণহত্যা ও মানবতার লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে দেশের ছাত্র-শিক্ষক ও তরুণ সমাজের দেশপ্রেম তথা প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। ক’দিন আগে টিভিতে দেখলাম ‘জালিয়ানওয়ালাবাগ’ নামক একটি হিন্দী সিনেমা। ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের অমৃতসর শহরে ইংরেজ সেনানায়ক ব্রিগেডিয়ার রেগিনাল্ড ডায়ারের নির্দেশে এক হত্যাকা- সংঘটিত হয়। শহরের জালিয়ানওয়ালাবাগের বদ্ধ উদ্যানে সমবেত নিরস্ত্র মানুষের উপর গুলিবর্ষণ করে হাজার হাজার নিরীহ মানুষ হত্যা করা হয়। ব্রিটিশ সেনাবাহিনী-পুলিশের ওই নির্মম হত্যাকা-ের প্রতিবাদে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইংরেজ সরকারের দেয়া ‘নাইটহুড’ উপাধি ত্যাগ করেন। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ইংরেজদের বিরুদ্ধে কবিতা লিখে ঘুমন্ত মানুষকে জাগিয়ে তুলে বিদ্রোহী কবি উপাধি পেয়েছেন। ‘বল বীর- বল উন্নত মম শির/ শির নেহারি আমারি নতশির ঐ শিখর হিমাদ্রির! বল বীর- বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি/ চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি---’। আজ বড় বেশি প্রয়োজন ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামের মতো কবির। জাতি আজ জহির রায়হান ও আলমগীর কবিরের মতো সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের বড় বেশি অভাববোধ করছে। রোহিঙ্গা মুসলিম হত্যাযজ্ঞ ইস্যুতে প্রতিবেশী ভারত এবং চীন নীরব। রোহিঙ্গারা মুসলিম হওয়ায় রাখাইনে বীভৎস গণহত্যা তাদের হৃদয় স্পর্শ করেনি। ভারত নীরব এ কারণেই কি আমাদের দেশের দুই ধারায় বিভক্ত কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী-সংস্কৃতিসেবীরা নীরব?
দেশে বর্তমানে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে কবি, সাহিত্যিক, লেখক, সংস্কৃতির ব্যক্তিত্ব, শিল্পী। এরা কার্যত নিজেদের জন্যই; দেশ, মানুষ এদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। দেশ প্রেমের চেয়ে এদের কাছে দল প্রেম বেশি; মানবপ্রেমের চেয়ে পকেটপ্রেম বেশি। একটি গান গেয়েই নিজের টাকায় ‘ক্যাসেট’ বের করে হয়ে যান শিল্পী। অভিনেতা-অভিনেত্রী, সিনেমা-নাটকের পরিচালকদেরও একই অবস্থা। এদের মানবপ্রেম দূরের কথা দেশপ্রেম নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এদের মধ্যে মেধাবী যেসব গুণীজন রয়েছেন তারা কারণে-অকারণে নিজেদের আড়াল করে রাখছেন। ঐতিহাসিকভাবে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের আত্মার সম্পর্ক। আরাকানেই প্রথম মুসলিম বসতি স্থাপিত হয়। সেই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমরা এখন গণহত্যার শিকার। গণহত্যার শিকার হাজার হাজার নারী-শিশু-পুরুষ-যুবক-যুবতীর দুর্দশার চিত্র মিডিয়ায় আসছে। শুক্রবার বাদ জুম্মা রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে লাখ লাখ মুসুল্লি ‘মিয়ানমারের গণহত্যা’ বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন। গণহত্যা বন্ধের দাবিতে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াত, সিপিবি, বাসদ, জাসদ, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, হেফাজত, ইসলামী ঐক্যজোট, জাগপা, পিএনপি, এলডিপি, ডিএল, চরমোনাই পীরের দলসহ অর্ধশত রাজনৈতিক সংগঠন বিক্ষোভ মিছিল করেছে। সুচির উদ্দেশে সবার মুখে এক আওয়াজ ‘স্টপ জেনোসাইড’। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম গণহত্যা বন্ধের দাবিতে সবাই হয়ে উঠেছেন প্রতিবাদী। অথচ কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, সাংস্কৃতির সেবীরা একেবারে নীরব! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম বেঁচে থাকলে মিয়ানমারের মুসলিম গণহত্যা বন্ধে কলম দিয়ে রক্ত ঝরাতেন। জহির রায়হান ও আলমগীর কবিরের মতো সংস্কৃতির ব্যক্তিত্বরা বেঁচে থাকলে নোবেল বিজয়ী অং সান সুচির সেনাবাহিনীর গণহত্যার চিত্র বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে ছুটে যেতেন নাফ নদীতে। নৌকায় দিনের পর দিন ভেসে থাকা ক্ষুধার্থ রোহিঙ্গাদের চিত্র ক্যামেরায় ধারণ করতেন। বিবেকের তাড়নায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোহিঙ্গা মুসলিমদের পাশে দাঁড়াতেন। অথচ সেই দেশপ্রেমী ব্যক্তিত্বদের বড়ই অভাব বর্তমান শিল্প-সাহিত্যিক অঙ্গনে।
গণহত্যা কি? অপরাধ প্রতিরোধ ও শান্তি বিধানের আন্তর্জাতিক চুক্তির আর্টিকেল ২ অনুযায়ী গণহত্যার অর্থ হচ্ছে কোন গোষ্ঠীকে পুরাপুরি কিম্বা তাদের কোন একটি খ- বা অংশকে ধ্বংস করা। জাতি গোষ্ঠী হলো; ক. যে অর্থে আমরা নিজেদের বাংলাদেশী জাতি বুঝি; খ. যে অর্থে পাহাড়ি বা সমতলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা নিজেদের একটি গোষ্ঠী মনে করে; গ. যে অর্থে ধর্মীয় গোষ্ঠীকে আমরা বুঝি। কোন ধর্মীয়গোষ্ঠীকে পুরাপুরি কিম্বা তার কোনো অংশকে হত্যা-ধ্বংস করার চেষ্টা হলো গণহত্যা। গণহত্যার আর্টিকেল ৩ অনুসারে অপরাধগুলো হচ্ছে ক. গণহত্যা; খ. গণহত্যার জন্য ষড়যন্ত্র করা; গ. গণহত্যায় সরাসরি প্ররোচনা দেওয়া এবং জনগণের মধ্যে উন্মাদনা সৃষ্টি করে প্ররোচিত করা; ঘ. গণহত্যার চেষ্টা করা এবং ঙ. গণহত্যায় সংশ্লিষ্ট থাকা। নোবেল বিজয়ী অং সান সুচি যে রোহিঙ্গা মসুলিম গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত এবং তার নোবেল পুরস্কার প্রত্যাহারের দাবিতে অনলাইনে ভোট দেয়ার হিড়িক পড়েছে, তা নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য।
রোহিঙ্গা মুসলিমদের কাছে এখন সুচির মিয়ানমার মানে নিশ্চিত মৃত্যু। রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্বিচারে অত্যাচার-নিপীড়নে হত্যা করা হচ্ছে; বসতভিটা আগুনে জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয়া হচ্ছে। নারী-শিশুদের ধর্ষণ করে নির্মমভাবে পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। বিশ্ব মিডিয়ার খবর হলো মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের রাখাইন রাজ্যে নজিরবিহীন মুসলিম নির্যাতন চলছে। নিত্যদিন নির্বিচারে গণহত্যা হচ্ছে। মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর ত্রিমুখী নৃশংসতায় দিশেহারা রাখাইন প্রদেশে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমরা। ওই দেশের সেনাবাহিনী, পুলিশ ও সীমান্তরক্ষীদের চলমান গণহত্যা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। পরিস্থিতি বিভীষিকাময়। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা দেশী-বিদেশী মিডিয়াকে জানিয়েছে, মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোই রোহিঙ্গাদের ঘর-বাড়ি আগুনে জ্বালিয়ে ধ্বংস করে দিচ্ছে, কুপিয়ে-পিটিয়ে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করছে, গাছে ঝুলিয়ে রাখছে মধ্যযুগীয় বীভৎস কায়দায় গুলি করে, পুড়িয়ে নির্মমভাবে হত্যা করছে, নারী-শিশুদের হত্যার আগে করছে ধর্ষণ। বনে-জঙ্গলে পালিয়েও রেহাই পাচ্ছে না রোহিঙ্গারা। স্থানীয় বৌদ্ধ সম্প্রদায় ও সরকারি বাহিনী সমানে রোহিঙ্গা বিরোধী নৃশংসতা চালিয়ে যাচ্ছে। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের পাশাপাশি মগদের বাসস্থান হওয়ায় এলাকাটি হিংস্র ‘মগের মুল্লুকে’ পরিণত করেছে। নির্যাতনের ভয়াবহতা এতো ব্যাপক যে যারা পালাতে পারেনি তারা বর্তমানে জীবন্মৃত। আল্লাহ ছাড়া তাদের দেখার যেন কেউ নেই। বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের আত্মীয়রা জানান; মিয়ানমারের সেনাসদস্যরা শত শত রোহিঙ্গা পুরুষকে ধরে নিয়ে তাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালাচ্ছে। তারা বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে সে খবর কেউ জানে না। সুচির নেতৃত্বাধীন সেনা সদস্যদের অত্যাচার থেকে নিজেদের রক্ষা করতে বন-জঙ্গল ও পাহাড়ের পাদদেশে তাঁবু পেতেছে। যারা পুরনো বসতভিটা ছেড়ে যায়নি, তাদের বাড়িঘরে তল্লাশির নামে সেনা সদস্যরা ঘর-দোকান, মূল্যবান লুট করে জ্বালিয়ে দিচ্ছে; গৃহপালিত গরু-ছাগল নিয়ে যাচ্ছে। খবরে প্রকাশ, মংডুর উত্তরে হাতিরপাড়া, নাইছাপ্রাং, কেয়ারিপ্রাং, ধুদাইং, জাম্বুুনিয়া, গৌজুবিল, রাম্ম্যাউবিল, কুজাবিল, রাহবাইল্যা, বুড়াসিকদারপাড়া, লংডুং, বলিবাজার এবং রাচিদং জেলার মেরুংলোয়া, ধুংছে, ওয়াস্যং, রড়ছড়া, আন্দাং, কেয়ান্দং এলাকার রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন-নিপীড়ন চলছে নির্বিচারে। শুক্রবার মসজিদগুলোতে জুমার নামাজ আদায়ের জন্য মুসলিম রোহিঙ্গাদের যেতে দেয়া হয়নি। মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর লেলিয়ে দিতে রাখাইন রাজ্যের গ্রামগঞ্জে বসবাসরত মগ যুবক ও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এ কারণে রোহিঙ্গাদের মধ্যে আরো বেশি ভীতি ও আতঙ্ক বাড়ছে।
সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ১০ অক্টোবর শুরু হওয়া গণহত্যার পর চিরুনি অভিযানে হাজার হাজার রোহিঙ্গা যুবককে গ্রেফতার করা হয়। প্রায় ৩০ হাজার বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ৭ দশক থেকে রাখাইন প্রদেশে পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গা মুসলিম নিধনযজ্ঞ চলছে। নানা ছলচাতুরিতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী, পুলিশ ও সীমান্তরক্ষীরা হামলে পড়ছে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর। নির্যাতিত রোহিঙ্গা আবালবৃদ্ধবণিতা জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মানবিক কারণে বাংলাদেশ সরকার তাদের আশ্রয় দিতে বাধ্য হচ্ছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের পর বর্তমানে ‘রাজনৈতিক বন্ধ্যাত্বের’ মধ্যেই দেশের রাজনৈতিক দলগুলো মিয়ানমারের গণহত্যার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে। গণহত্যা বন্ধে এখন উচ্চকন্ঠ হওয়া প্রয়োজন কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের। প্রবাদে আছে ‘জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও পবিত্র’। অতএব, শুধু রাজনৈতিক দল নয়, লেখক বুদ্ধিজীবী কবি সাহিত্যিক সাংবাদিক সকলকে গণহত্যার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া জরুরী। অথচ জহির রায়হান, আলমগীর কবিরের মতো ব্যক্তিত্বের বড়ই অভাব?
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।