হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
মোবায়েদুর রহমান : গত রোববার ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন্স ডে বা ভালোবাসা দিবস উদযাপিত হয়ে গেল। এই দিবসটি নিয়ে কোনো কিছু লেখার প্রবৃত্তি আমার ছিল না। কারণ এই বিষয়টি নিয়ে ইতিপূর্বে একাধিকবার দৈনিক ইনকিলাবে লিখেছি। তারপরেও ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও আজ লিখছি। এই দিবসটি সম্পর্কে পত্রিকার পাতায় একটি চটকদার সংবাদ ছাপা হয়েছিল। সংবাদটিতে বলা হয়েছিল, একজন যুবক এবং একজন যুবতী, অর্থাৎ একটি তরুণ যুগল একটি চাঞ্চল্যকর ঘোষণা দেয়। ওই ঘোষণায় বলা হয় যে, ভ্যালেন্টাইন্স ডে বা ভালোবাসা দিবস সম্পর্কে তারা কোনো ঢাক ঢাক গুড় গুড় নীতি অনুসরণ করতে চায় না। তারা যা করবে সেটি প্রকাশ্যে করবে। তারা ঘোষণা দেয় যে, প্রায় ২ কোটি মানুষ অধ্যুষিত ঢাকা মহানগরীর একটি জনবহুল স্থানে তারা প্রকাশ্যে চুম্বন করবে এবং দীর্ঘক্ষণ ধরে চুম্বনে লিপ্ত থাকবে। তাদের এই দীর্ঘস্থায়ী চুম্বন কর্ম অবলোকন করার জন্য তারা ঢাকা মহানগরীর সমস্ত নর-নারীকে আহ্বান জানায়। তারা মনে করে যে, তাদের ভাষায়, বাংলাদেশের সমাজের রক্ষণশীলতার সরব এবং প্রকাশ্য প্রতিবাদ হবে এই দীর্ঘস্থায়ী চুম্বন। এখানেই তারা শেষ করেনি। তারা আশা করেছিল যে, তাদের এই চুম্বন লীলা দর্শণ করে দেশের মানুষ বিপুলভাবে অনুপ্রাণিত হবে এবং আগামীতে রাস্তাঘাটে যেখানে সেখানে চুম্বন লীলায় লিপ্ত হবে। আমরা জানি না নিচের এই কবিতাটি তাদেরকে উদ্দাম চুম্বন লীলায় লিপ্ত হতে কতখানি অনুপ্রাণিত করেছে।
দুইটি তরঙ্গ উঠি প্রেমের নিয়মে
ভাঙিয়া মিলিয়া যায় দুইটি অধরে।
ব্যাকুল বাসনা দুটি চাহে পরস্পরে-
দেহের সীমায় আসি দু’জনের দেখা।
প্রেম লিখিতেছে গান কোমল আখরে-
অধরেতে থরে থরে চুম্বনের লেখা।
দু’খানি অধর হতে কুসুমচয়ন-
মালিকা গাঁথিবে বুঝি ফিরে গিয়ে ঘরে!
দুটি অধরের এই মধুর মিলন
দুইটি হাসির রাঙা বাসরশয়ন।
(চুম্বন : সঞ্চয়িতা : পৃষ্ঠা-৩১, সালমা সংস্করণ : ১৪০৬)
॥দুই॥
এই লেখাটি লিখছি রবিবার ১৪ ফেব্রুয়ারি সকালে। আর এটি ছাপা হবে ১৬ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার। ইতিমধ্যেই ভ্যালেন্টাইন্স ডে বা ভালোবাসা দিবস উদযাপিত হয়ে গেছে। তাই আমি জানি না যে, গত রবিবার ভ্যালেন্টাইন্স ডে তে এই প্রকাশ্য চুম্বন প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে কি-না। আমি এও জানি না যে, এই প্রদর্শনীটি অনুষ্ঠানের সত্যি সত্যিই কোনো সিরিয়াস প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল কি-না। নেয়া হয়ে থাকলে সরকার তথা পুলিশ বাহিনীর এ ব্যাপারে কোনো ভূমিকা ছিল কি না। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ঐ যুগল তাদের সিদ্ধান্তে অটল ছিল কি না, নাকি তারা এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করেছে, সেটি এখনো জানা যায়নি। তবে এই লেখার সময় অর্থাৎ রবিবার দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করি। দুপুর পর্যন্ত একাধিক টিভি প্রোগ্রাম দেখলাম এবং অনলাইন নিউজ পেপার ও নিউজ পোর্টাল দেখলাম। কোথাও ওই যুগলের প্রকাশ্য চুম্বনের খবর সম্প্রচারিত হতে বা প্রকাশিত হতে দেখিনি। হতে পারে, তারা এই ধরনের কাজ করেছে, কিন্তু মিডিয়া সেটি প্রকাশ করেনি। কারণ এতে সমাজের নৈতিক অবক্ষয় এমন পর্যায়ে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে যেখান থেকে ফিরে আসার আর কোনো পথ পাওয়া যাবে না। আবার এমনও হতে পারে যে, সাধারণ মানুষ এই ঘোষণার সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। ফলে ঐ তরুণ-তরুণী যুগল আর এগুতে সাহস পায়নি। আমি সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করবো। সন্ধ্যার পরে এই কলামটি অফিসে পাঠাব। কারণ, যদি এরকম কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা কোথাও ঘটেই থাকে তাহলে সন্ধ্যার মধ্যেই ঘটতে হবে। আর আমি সেই খবর শেষ মুহূর্তে হলেও এই কলামের মধ্যে ঢুকিয়ে দেব।
তবে এই ধরনের সিদ্ধান্তকে সুনিশ্চিতভাবেই একটি উসকানি বলে বিবেচনা করা যায়। এই উসকানি যুবক-যুবতীদের প্রাক-বিবাহ সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য নিশ্চিতভাবে ধরে নেয়া যায়। প্রকাশ্যে হোক আর গুনগুন করে হোক, এসব তরুণ-তরুণীর কাছে রবীন্দ্রনাথের একটি গান অন্তত ভ্যালেন্টাইন্স ডে বা ভালোবাসা দিবসের জন্য অসাধারণ জনপ্রিয়, আকর্ষণীয় এবং যথাযথ বলে বিবেচিত হবে। গানটি হলো,
উড়াব ঊর্ধ্বে প্রেমের নিশান
দুর্গম পথ মাঝে
দুর্দম বেগে দুঃসহতম কাজে।
রুক্ষ দিনের দুঃখ পাই তো পাব-
চাই না শান্তি, সান্ত¡না নাহি চাব।
পাড়ি দিতে নদী হাল ভাঙে যদি
ছিন্ন পালের কাছি,
মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব
তুমি আছ আমি আছি।
দু’জনের চোখে দেখেছি জগৎ,
দোঁহারে দেখেছি দোঁহে-
মরু পথ তাপ দু’জনে নিয়েছি সহে।
ছুটি নি মোহন মরীচিকা - পিছে- পিছে,
(গীত বিতান পৃষ্ঠা : ২০৩, পল্লব সংস্করণ : ১৯৯৩)
একে তো প্রেম, তার ওপর আবার ভ্যালেন্টাইন্স ডে বা ভালোবাসা দিবস। সুতরাং তারা হবে উদ্দাম। তারা করবে উদ্বাহু নৃত্য। যৌবনের জোয়ারে তারা তাদেরকে ভাসিয়ে দেবে আর সমবেত কণ্ঠে গেয়ে উঠবে,
ঝড়ে যায় উড়ে যায় গো
আমার মুখের আঁচলখানি।
ঢাকা থাকে না হয় গো,
তারে রাখতে নারি টানি॥
আমার রইল না লাজলজ্জা,
আমার ঘুচল গো সাজসজ্জা-
তুমি দেখলে আমারে
এমন প্রলয়- মাঝে আনি
আমায় এমন মরণ হানি॥
(গীত বিতান পৃষ্ঠা : ২৮০, পল্লব সংস্করণ : ১৯৯৩)
বাহারী জামা কাপড় পরে গত পরশু দিন অসংখ্য তরুণ-তরুণী রাস্তায় নেমে এসেছিল। কপোত-কপোতী মিলিত হয়েছিল, গান গেয়েছিল। সেটি উচ্চৈঃস্বরে হোক বা অনুক্ত হোক। ওদের সুরে ভাষা পেয়েছিল এবং মনের বীণায় সংগোপনে ঝঙ্কৃত হয়েছিল অমর কণ্ঠশিল্পী মোহাম্মদ রফির ভরাট কণ্ঠের সেই গান।
জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ
হায় মোহাব্বত জিন্দাবাদ
॥তিন॥
তথা কথিত ভালোবাসা দিবসে যেসব তরুণ-তরুণী কলকলিয়ে ওঠে তারা কারা? ঘর পালিয়ে বাইরে যারা প্রেম করে তারা কারা? পরিচিত জনের চোখের আড়ালে যারা প্রেম করে তারা কারা? এরা তারাই, যারা কোনো সহজ-সরল সমাজ স্বীকৃত বন্ধনে আবদ্ধ নেই। ফিরে যাচ্ছি ১৯৯৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র একটি অনুষ্ঠান। আজব একটি নাম, ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’। বাংলা করা হয়েছে- ভালোবাসা দিবস। ওইদিন ঐ দিবসটি একটি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃত পেলো। চুটিয়ে প্রেম করার অধিকারকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া হলো। ওইদিন ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে হাজির ছিলেন, তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। আজ তিনি যোগাযোগমন্ত্রী। ভ্যালেন্টাইন্স দিবসকে যদি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না দেয়া হয় তা হলে সরকারের একজন মন্ত্রী ভালোবাসা দিবসের একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হন কিভাবে? আর যদি বা হলেনই, তাহলে ভ্যালেন্টাইন্স দিবসের মাহাত্ম বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন এবং মনিকা লিওনস্কির অবৈধ প্রেমের জয়গান গাইলেন কিভাবে? ষড় ঋতুর বাংলাদেশে ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’ বলে ঋতু রাজকে বরণ করার ঐতিহ্য অতি পুরনো এবং সনাতন। তাই বসন্তের প্রথম প্রভাতে কেউ যদি হর্ষোৎফুল্ল কণ্ঠে গেয়ে ওঠেন,
পারুলের হিল্লোল, শিরীষের হিন্দোল
মঞ্জুল বল্লীর বঙ্কিম কঙ্কন
উল্লাসে উতরোল বেনুবন কল্লোল
কম্পিত কিশলয়ে মলয়ের চুম্বন।
অথবা ফাল্গুন রাত্রে ‘পর্নের পাত্রে’ ‘মুকলিত মল্লিকার হিল্লোলে’ আন্দোলিত হয়ে কেউ যদি ডাক দেয়,
ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল
লাগল যে দোল
স্থলে-জলে বনতলে
লাগল যে দোল
দ্বার খোল দ্বার খোল।
তাহলে বলার কিছু নেই। কিন্তু তাই বলে হিমেল মাঘের অবসানকে সোল্লাসে বিদায় এবং ‘দখিন হাওয়ার স্রোতে’ ‘বকুল গন্ধে বন্যার আগমনী’ ঘোষণার জন্য সিঁদুর রঙের আবির ছড়াতে হবে কেন?
বিগত ২২ বছর হলো ‘দৈনিক ইনকিলাবে’ কলাম লিখে চলেছি। লিখে চলেছি অবিরাম। কত লেখাই তো লিখলাম। কিন্তু সমাজের ওপর তার কি কোনো ইমপ্যাক্ট হচ্ছে? মেঘে মেঘে অনেক বেলাই তো হয়ে গেলো। কিন্তু উন্নতি বা উত্তরণ কি কিছু হয়েছে? এটি আমার প্রশ্ন। উত্তর দেয়া বা বিচার বিবেচনা করার মালিক জনগণ, বিশেষ করে পাঠক সমাজ।
ভালোবাসা দিবস নামক এই অবাঞ্ছিত বস্তুটিকে বাংলাদেশে প্রসব করেছেন একজন নাম করা ব্যক্তি, এখন বিএনপির সাথে আছেন। নাম শফিক রেহমান। এখন ২০১৬ সালে আবার তিনিই বলছেন, ‘যদিও আশির দশকের তুলনায় নব্বইয়ের দশকে এটা খুব বেশি উদযাপন হওয়া শুরু হয়, তবে সেটা বাণিজ্যিক কারণে।’ এরপর তিনি বলছেন, ‘বাংলাদেশে ফিরে আসার পর মনে হলো এটা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। (একটি মহতি মিশন!) কারণ, এখানে ভালোবাসার বাণী আছে। তবে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে করা যাবে না। (আমার প্রশ্ন, কেন করা যাবে না? কারণ আপনিতো ওদের আদর্শেই বিশ^াস করেন।) আপনি বলছেন, ছোট বেলায় আমরা এটাও লক্ষ্য করেছি এপ্রিল ফুল ডে করতে গেলে বলা হতো এটা খ্রিস্টানদের জিনিস, মুসলিম বিরোধী। (আমার প্রশ্ন, এটা কি খ্রিস্টানদের জিনিস নয়?)। আপনি বলছেন, ভয় ছিল আমি কোনো কিছু করতে গেলে আমার বিরুদ্ধে প্রচার হতে পারে আমি ইসলাম বিরোধী। সেজন্য সেন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে নামটা কেটে দিয়ে শুধু ভালোবাসার দিন হিসেবে নাম দিয়েছি। (আমার প্রশ্ন, নামে কি বা আসে যায়?) আপনি বলেছেন, আসলে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস বলতে কিছু নেই। আমার প্রশ্ন, বিলম্বিত বোধদয়?
শফিক রেহমান সাহেব, এপ্রিল ফুল বা ভ্যালেন্টাইন্স ডে কি খ্রিস্টানদের জিনিস নয়? আপনি আশঙ্কা করেছেন, আপনাকে কি ইসলাম বিরোধী বলা হবে কি না? আপনি কি মনে করেন? জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামী মূল্যবোধে বিশ^াসীরা আপনাকে কি মনে করেন? আপনার সাংস্কৃতিক চিন্তাধারা কি বিএনপির সাথে যায়? নাকি আওয়ামী লীগের সঙ্গে যায়?
আপনি বিএনপির সাথে আছেন কিভাবে? আর বেগম জিয়া-ই বা আপনাকে রেখেছেন কিভাবে?
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।