বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
ফার্সি ভাষায় একটি প্রবাদ বাক্য হচ্ছে এই : ‘হার কামালেরা জাওয়ালাস্ত’ অর্থাৎ প্রতিটি পূর্ণতাপ্রাপ্ত বস্তুর পতন অনিবার্য। এই নিরিখে চিন্তা করলে সহজেই অনুধাবন করা যায় যে, বর্তমান দুনিয়ার মানুষ জ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যতখানি শীর্ষে আরোহণ করেছে, ঠিক ততখানি উন্নতি ও অগ্রগতি পাপাচার ও অনাচারের ক্ষেত্রেও সাধন করেছে। উভয় পাল্লাই এখন সমানে সমান।
এর জন্য দায়ী বিশ্বজোড়া সমাজব্যবস্থা। জ্ঞান ও প্রযুক্তির অধিকারী মানুষ নিজেদের সমাজব্যবস্থাকে এমন একপর্যায়ে নিয়ে এসেছে, যেখানে পাপ ও অন্যায় বলতে কিছুই নেই। জীবন চলার পথের সকল বাঁকে বাঁকে পাপ ও অন্যায়ের পসরাভর্তি উপকরণ বিনা আয়াসেই পাওয়া যাচ্ছে। বিশ্ববাসীর মধ্যে এমন একটা সময় ও পরিবেশ প্রকট হয়ে দেখা দেবে, এ বিষয়টি মহান আল্লাহপাক পূর্বাহ্নেই জানতেন। আর জানতেন বলেই তিনি প্রিয় হাবীব মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)- কে এ বিষয়ে অবগত করেছেন।
সর্বশেষ আসমানী কিতাব আল কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হয়েছে : (হে নবী) আপনি বলুন, প্রত্যেক মানুষই নিজ নিজ রীতি অনুযায়ী কাজ করে, অতঃপর আপনার প্রতিপালক বিশেষভাবে জানেন, কে সর্বাপেক্ষা নির্ভুল পথে আছে। (সূরা বনী ইস্রাঈল : ৮৪)। এই আয়াতে কারীমার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়টি একটি শব্দের মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত ব্যক্ত করেছেন। শব্দটি হলোÑ ‘শাকিলাতুন’। এই শব্দটি ষোল আনা কুরআন শরীফে মাত্র একবার ব্যবহৃত হয়েছে। তাই, এই শব্দটির অর্থ ও মর্ম অনুধাবনে সকলেরই উচিত গভীরভাবে যত্নবান হওয়া। আসুন এবার সে দিকে নজর দেয়া যাক।
(এক). ‘শাকিলাতুন’ শব্দের অর্থ হলো (১) অভ্যাস, (২) স্বভাব, (৩) নিয়্যত, (৪) রীতি-পদ্ধতি ইত্যাদি। সবগুলো অর্থের সারমর্ম হলো সামাজিক পরিবেশ। মোটকথা, সামাজিক পরিবেশ ও পরিস্থিতির আওতায় মানুষের অভ্যাস, মানুষের প্রকৃতি, মানুষের নিয়ত, মানুষের রীতি-পদ্ধতি বিভিন্নভাবে প্রকাশ পায়। স্বভাবত সহজাত প্রকৃতিতেই তা তার জীবন চলার পথে বিকশিত হয়ে উঠে।
(দুই). সামাজিক পরিবেশে মানুষের অভ্যাস এবং প্রথা ও প্রচলন একটি বিরাট স্থান দখল করে আছে। এর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে দেখা যায় যে, প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই সমাজ এবং পরিবেশের প্রভাবে একটি স্বভাব, অভ্যাস এবং মানবিকতা গড়ে ওঠে। এই অভ্যাস ও মানসিকতা অনুযায়ী পরিবেশের প্রভাবে তার সকল কাজকর্ম নিষ্পন্ন হয়ে থাকে। আর এ কারণেই বর্তমান দুনিয়ার পাপাচারে ভরা পরিবেশ ষোল কলায় পূর্ণতা লাভ করে চলেছে। সুতরাং এর পতন যে অবশ্যম্ভাবী তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
(তিন). ইমাম, জাস্সাস (রহ.) ‘শাকিলাতুন’ শব্দের অর্থ ‘সমভাবাপন্ন’ বলে উল্লেখ করেছেন। এই অর্থের আলোকে উল্লিখিত আয়াতে কারীমার অর্থ ও মর্ম এই যে, প্রত্যেক ব্যক্তি তার সমভাবাপন্ন ব্যক্তির সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে ও অন্তরঙ্গ হয়। মুমিন মুসলমানগণ সমভাবাপন্ন মুমিন মুসলমানদের সাথে এবং কাফের ও অভিশপ্তরা তাদের মতো দুষ্টের সাথে অন্তরঙ্গ হয় এবং দুষ্ট লোকের কর্মপন্থাই অনুসরণ করে। আল কুরআনে মহান আল্লাহ পাক এই বিষয়টিকে এভাবেও ব্যক্ত করেছেন।
ইরশাদ হয়েছে : দুশ্চরিত্রা রমণীকুল দুশ্চরিত্র পুরুষের জন্য এবং দুশ্চরিত্র পুরুষকুল দুশ্চরিত্রা নারীকুলের জন্য, সচ্চরিত্রা রমণীকুল সচ্চরিত্র পুরুষকুলের জন্য এবং সচ্চরিত্র পুরুষকুল সচ্চরিত্রা নারীকুলের জন্য, তাদের সম্পর্কে লোকে যা বলে, তার সাথে তাদের কোনো সম্পর্কই নেই, তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও সম্মানজনক জীবিকা। (সূরা নূর: ২৬)। এই আয়াতে কারীমার সারমর্ম হচ্ছে এই যে, খারাপ সংসর্গ, খারাপ পরিবেশ এবং খারাপ অভ্যাস ও রীতি থেকে বিরত থাকার প্রতি সকলেরই উচিত যত্নবান হওয়া এবং পাপ ও পঙ্কিলমুক্ত জীবন গঠন করা।
(চার). উল্লিখিত আয়াতে কারীমায় শাকিলাতুন্ শব্দের মাধ্যমে মানুষকে হুঁশিয়ার করা হয়েছে যে, মন্দ অভ্যাস, সংসর্গ ও মন্দ পরিবেশ থেকে বিরত থাকা, মুক্ত ও পবিত্র থাকা একান্ত দরকার এবং সৎ লোকের সাহচর্য ও সংসর্গ এবং সৎ অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত। কেননা, পরিবেশ, সংসর্গ এবং প্রথা ও প্রচলিত রীতি-পদ্ধতি দ্বারা মানুষের মধ্যে যে স্বভাব গড়ে ওঠে, তার প্রত্যেক কাজকর্ম, চলাফেরা তদনুযায়ীই হয়ে থাকে।
সুতরাং চলমান পৃথিবীর সর্বত্র মন্দের জোয়ার বয়ে চলেছে। তাই, এর জাওয়াল বা পতন অনিবার্য হয়ে পড়েছে। তবে, চলমান পরিস্থিতিতে মনের কোনে একটি প্রশ্ন দানাবেঁধে ওঠা খুবই স্বাভাবিক। প্রশ্নটি হলো পরাসক্তির অধিকারী ও তাদের দোসরদের ভরাডুবি কে ঘটাবেন এবং কিভাবেই বা তাদের পতন ঘটবে? এর উত্তরে বলা যায় যে, তাদের পতন ঘটাবেন স্বয়ং আল্লাহ পাক। কেননা, তিনি ‘ফায়্যালুন লিমা ইউরিদ’ অর্থাৎ যা ইচ্ছা করেন তা বাস্তবায়ন করতে পারেন। এই লক্ষ্য পূরণের জন্য তিনি তাঁর সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছেন। যারা অহর্নিশ কাজ করে চলেছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।