Inqilab Logo

বুধবার, ০৩ জুলাই ২০২৪, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১, ২৬ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

মুসলিমরা চাইলে ৬৬৫ বছরে ভারতে একজন হিন্দুও অবশিষ্ট থাকতো না

কলকাতা টিভির সাংবাদিক সুচন্দ্রিমা পালের বিশেষ তথ্যবহুল প্রতিবেদন

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২১ জুন, ২০২২, ৮:০৯ পিএম | আপডেট : ৮:৩৪ পিএম, ২১ জুন, ২০২২

ভারতের ক্ষমতাসীন উগ্র হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির শাসনামলে ইতিহাস বিকৃতি করে কীভাবে ইসলামবিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে তা নিয়ে একটি তথ্যবহুল বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে পশ্চিমবঙ্গভিত্তিক কলকাতা টিভি। সাংবাদিক সুচন্দ্রিমা পালের উপস্থাপনায় ওই প্রতিবেদনে ইতিহাস থেকে প্রমাণ তুলে ধরা হয়, মুসলিম শাসকদের দীর্ঘ ৬৬৫ বছরের শাসনামালে ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলিমরা কীভাবে মিলেমিশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে বসবাস করতেন। কিন্তু বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর ভারতবর্ষের সেই সোনালী ইতিহাস বিকৃত করে মুসলিম রাজা-বাদশাদের খলনায়ক হিসেবে উপস্থাপনা করে অন্ধভক্তদের মাঝে মুসলিম-বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। সুচন্দ্রিমার প্রতিবেদনটি সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। নিচে দৈনিক ইনকিলাব পাঠকদের জন্য প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হলো-

৬৬৫ বছর ধরে চলেছিল বিভিন্ন বংশের হলেও ইসলামি শাসন। হ্যাঁ, দীর্ঘ ৬৬৫ বছর। গত ৬ বছর বিজেপির শাসনে সবচেয়ে বেশি যেকথা তারা বোঝাবার চেষ্টা করেছে, ‘হিন্দু খাতরেমেহে’। অথচ এই হিন্দুরা অনায়াসে পার করেছে ৬৬৫ বছরের ইসলামি শাসন। ৬৬৫ বছরে কেউ যদি চাইতো তাহলে কি এই ভূখণ্ডে একজনও হিন্দু অবশিষ্ট থাকতো।

মাঝে মধ্যে ইতহাস চর্চা করা ভালো। কিছু মানুষ আছেন, যারা ইতিহাসের নামে তাদের ইচ্ছেমতো যা খুশি তাই বোঝাতে থাকেন। সেটা বিপজ্জনক। তাই আজ একটু ইতিহাস ঘাঁটা যাক। মাঝে মধ্যেই দেখবেন আরএসএস বিজেপির লোকজন বলেন, ইসলাম কী হিংস্র! তাদের রাজারা-বাদশারা কী হিংস্র! কী অত্যাচার না চালিয়েছে। হিন্দু দেখেছে আর মাথা কেটেছে এবং এসব বলতে গিয়ে সবচেয়ে আগে যার নাম আছে, সে হলো চেঙ্গিস খান।

ভারতে এসেই হিন্দুদের কচু কাটা করেছিলেন। খান মানেই মুসলমান আর মুসলমান মানেই অত্যাচারী। অশিক্ষিত জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধার ধারে না। আল্লাহ’র নির্দেশে কেবল কাফেরদের মারা এই হলো তাদের কাজ এবং সেই খানেদের অন্যতম হলো চেঙ্গিস খান।

আইটি সেল থেকে এই তথ্য পৌঁছে দেওয়া হয়। তারপর সত্যিকারের অশিক্ষিত ভক্তের দল বা ধান্দাবাজি করে যাওয়ার জন্য জুটে যাওয়া পাবলিক এই তথ্য গোল গোল চোখ করে এমন বর্ণনা করবে যে, মনে হবে ‘বিগ ব্যাশ’ সে নিজেই হাজির ছিল। চেঙ্গিস খানের সাথে সে সেলফিও তুলেছিল।

এবার তথ্যটা দেখা যাক। চেঙ্গিস খান মুসলমান ছিলেন না। তিনি ছিলেন টেংগ্রিস্ট। এশীয়, ইউরোপীয়, ইসতেপীয় অঞ্চলের আকাশ দেবতা। টেংড়ির পুজো করতেন। কেবল তাই নয়, তিনি হালাল মাংসের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। তার বংশধর কুবলাই খান বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন এবং তিনি সুন্নাত এবং হালাল দুই এর ওপরেই নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।

চেঙ্গিস খান ভারতবর্ষের ধারেকাছেও আসেনি। আফগানিস্তানে এসেছিলেন তার ছেলে। অতএব চেঙ্গিস খান দিল্লিতে লাশের পাহাড় বানিয়েছিল এ তথ্য ভুল। হ্যাঁ, তিনি কিছু জায়গাই লাশের পাহাড় বানিয়েছিলেন, তা ছিল মুসলমানদের। মধ্য এশিয়ার সব অংশের সম্রাট শাহ আলাউদ্দিন মোহাম্মদকে আক্রমণ করেছিলেন এবং তার সম্রাজ্যে মুসলমান প্রজা আর সামরিক বাহিনীদের কচুকাটা করেছিলেন এবং তারা ছিলেন মুসলমান।

শোনা যায়, সেই সময় তিন দিনে দেড় লাখ মুসলমান হত্যা করেছিলেন। মুসলমান বলে নয়, তারা তাকে বাধা দিতে এসেছিল তাই। এই হলো চেঙ্গিস খান প্রসঙ্গ।

এবার আসা যাক, তৈমুর লং প্রসঙ্গে। তৈমুর সুন্নি মুসলমান ছিলেন। নাক্সবান্দ ধারার সুফি ধারার মুসলমান। কিন্তু সম্রাট যিনি তার সম্রাজ্য বাড়াতে চান। ঘোড়ার পিঠে চড়ে দুর্ধর্ষ সৈন্য বাহিনী নিয়ে ছুটেছেন দেশ থেকে দেশান্তরে সামনে যারা এসেছেন, সে মুসলমানই হোক খ্রিস্টান, শিয়া হোক, সুন্নি হোক তাকেই মেরেছেন। লাশের পাহাড় তৈরি হয়েছে। লুটপাট করে ঘোড়া, উট, হাতি সোনা-গহনা নিয়ে দেশে ফিরেছেন। কোথায় না গেছেন? ওধারে চীন, এ ধারে পারস্য, ওধারে রাশিয়া, আর নিজের রুক্ষ শুষ্ক দেশকে সাজিয়েছেন।

বিরাট বিরাট মাদ্রাসা তৈরি করেছেন। তৈরি হয়েছে মসজিদ এখনও উজবেকস্তানে গেলে, সেসব মাদ্রাসা, মসজিদ দেখা যায়। না, তাদের প্রাসাদ দেখা যাবে না আসলে তেমন প্রাসাদ তৈরিই করাননি।

এবার আসি ভারতবর্ষে অভিযানের কথায়। আবার বিজেপি-আরএসএস তাদের ইতিহাস বলবে, কীভাবে হিন্দু রাজাদের মেরে কেটে তৈমুর লাশের পাহাড় তৈরি করেছিল।

তথ্য বলছে, দিল্লি শহরের ঠিক বাইরে তৈমুর বাহিনীর সঙ্গে লড়াই হয়েছিল ১৩৯৮ সালে। লড়াই ছিল তুঘলক বংশের শেষ সম্রাট নাসির উদ্দিন মোহাম্মাদ শাহের বিরুদ্ধে। তুঘলক বংশের এই রাজাকে হারিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন আমির তৈমুর। বিশাল ধন সম্পত্তি লুট করে চলে গিয়েছিলেন। যেমন অন্য বহু রাজা-সম্রাটরা করতো। এই জন্যই তারা তাদের দেশে নায়ক হয়ে থাকতেন।

উজবেকস্তানে আমির তৈমুর আমাদের দেশের গান্ধীজির মতো। টাকা থেকে সংসদ সর্বত্র আমির তৈমুর। তো তিনি ভারতে এসে লড়লেন। কিন্তু মুসলমান রাজা, নবাব, সম্রাটদের সঙ্গে বিজেপির লবসাথ ইউনিভার্সিটিতে বলা হয়, তিনি কাফের মারতে বেরিয়েছিলেন। আসলে মধ্যযুগের ইতিহাসের যেকোন সম্রাট-নবাবের মতো তিনিও ছিলন সাম্রাজ্যলোভী নিষ্ঠুর।

মারাঠাদের দিকেই তাকিয়ে দেখুন না ‘ছেলে ঘুমোলো, পাড়া জুড়ালো, বর্গি এলো দেশে’। এই বর্গি কারা? এরা তো হিন্দু। ভবানী পাঠক কে ছিল? কারে পুজো করতেন? এই বর্গিরা লুটপাট করতো।

মহিলাদের অপহরণ করতে এসেছিল এই বাংলায়। কে আটকালো আলীবর্দি খান। একজন মুসলমান রাজা তাকে আটকাচ্ছে। কাকে আটকাচ্ছে? হিন্দু লুটেরাদের। আর কাকে বাঁচাচ্ছে? তার হিন্দু প্রজাদের। এমনি এমনি নাকি?

হিন্দু প্রজারা খাজনা দিতো। তাই তাদের বাঁচিয়ে ছিলো। এর সাথে হিন্দু-মুসলমানের কোন সম্পর্ক নেই। অথচ বিজেপি আরএসএস তারা বোঝাচ্ছে মুসলমান রাজত্যে কি অত্যাচারই না হয়েছে। হয়েছেতো, হিন্দু রাজারা অত্যাচার করেছে, মুসলমান নবাবরাও করেছে। যেকোন শাসক যেমন করে থাকে।

আবার তাদের মধ্যে ভালো শাসকও ছিলেন। সম্রাট অশোকের দ্বিতীয় অধ্যায় ছিল ধর্মের শাসন। আকবর শুরু থেকেই ছিলেন কল্যাণকারী রাজা।

শের শাহ সুরি। যার আসল নাম ছিলো ফরিদ খান। ছিলেন একজন প্রজাবশ্য সম্রাট। তৈরি করেছিলেন গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড। ডাক ব্যবস্থার প্রচলন করেছিলেন। মারা গেলেন কালিনজরের যুদ্ধে। কাদের বিরুদ্ধে মহোবার রাজপুতদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে।

মহোবার রাজপুত মানে হিন্দু। আকবর লড়াই করছে হলদি ঘাটিতে মহারণা প্রতাপের বিরুদ্ধে। তার সেনাপতি কে ছিলেন অমবারের রাজা মান সিং। অন্যদিকে মহারণা প্রতাপের সেনাপতি দুর্ধর্ষ বীর হাকিম খান।

তাহল কী দাঁড়ালো? ইতিহাসের রাজা-সম্রাট-নবাব-সুলতানদের লড়াই হিন্দু-মুসলমান দেখে করেনি। তাদের যুদ্ধ হয়েছে পররাজ্য গ্রাস করার জন্য, সম্পদ আহরণ করার জন্য। আর কোন কারণ ছিলো না। সেই সময়ের মন্দির ছিলো ধনরত্নে ভরা। যেমনটা এখনকার তিরুপতি ইত্যাদির মতো।

মুসলমান নবাব-সম্রাটরা সেগুলো লুটপাট করেছিলে ওই সম্পদের জন্য। সোমনাথের মন্দিরও সেই জন্যই লুট করেছিল নাদির শাহ। খবর ছিলো মন্দিরের গর্ভগৃহে তাল তাল সোনা আছে।

শ্রীরঙ্গাপত্তা নামের কাছে মন্দির লুট করেছিল মারাঠারা। বাংলার বেশ কিছু এমন মন্দির লুট করেছিলো মারাঠারা। আসলে চেয়েছিলে সম্পদ আহরণ করতে। কিন্তু যে ঘটনাগুলোকে আজ এতো দিন পরে তুলে ধরছে আরএসএস-বিজেপি। তা দিয়ে তারা বোঝানোর চেষ্টা করছে। কেবল মুসলমান রাজারা হিন্দুদের ওপর অত্যাচার করতো।

আচ্ছা আসুন, তাহলে আরেকটা তথ্য দেয়া যাক। ১১৯২ সালে পৃথ্বীরাজ চৌহানকে যুদ্ধে হারিয়ে মোহাম্মাদ ঘোরি দিল্লি দখল করে। এরপর ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পর ব্রিটিশরা আসে। ৬৬৫ বছর ধরে চলেছিল বিভিন্ন বংশের ইসলামি শাসন। মানে সম্রাট বা নবাব বা সুলতানের ধর্ম ছিল মুসলমান।

বিজেপি রোজ বলে মুসলমানরা আগামী ৫০ বছরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠবে। যদিও তারা ওই ১৫ শতাংশেই দাঁড়িয়ে। গত ছয় বছরের বিজেপি শাসনে সবচেয়ে বেশি যে কথা তারা বোঝাবার চেষ্টা করেছে, তাহলো ‘হিন্দু খাতরেমেহে’। অথচ এই হিন্দুরা অনায়েসে পার করেছে ৬৬৫ বছরের ইসলামি শাসন।

ভারতবর্ষের এই বিশাল ভূখণ্ডে কটা মন্দির ভাঙার ইতিহাস পাওয়া যায়। ৬৬৫ বছরে কেউ যদি চাইতো এই ভূখণ্ডে একজন হিন্দুও কোথাও অবশিষ্ট থাকতো। কেউ কোনো ধার্মিক অত্যাচার করেনি, কোনো মন্দির ভাঙেনি। অত্যাচার হয়েছে, ধর্মীও কারণেও অত্যাচার হয়েছে। মন্দির ভাঙাও হয়েছে, তবে তার ছিল সারা দেশের, সারা সমাজের কথা। আর সব রাজা, সব নবাব, সব সুলতানরাই একইভাবে ভাঙার কাজ করে গেছেন তাও নয়।

ধরুন আওরঙ্গজেবের কথা, যেকথা বিজেপি-আরএসএস সবথেকে বেশি বলে। আসুন দেখা যাক সত্যটা কী। আওরঙ্গজেব নাকি কাশিবিশ্বনাথের মন্দির ভেঙেছিলেন, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ছিল। আবার উনিই আবার কামাক্ষ্ম মন্দিরের জন্য জমি দান করেন। উজ্জয়নির মহাকাল মন্দিরের জন্য জমিদান করেছিলেন। বৃন্দাবনের কৃষ্ণ মন্দিরের জন্য জমি দান করেছিলেন। তাহলে কী দাঁড়াল, উনি মন্দির ভেঙেছেন আবার মন্দিরের জন্য দানও করেছেন।

উনি ধর্মভীরু মুসলমান ছিলেন মসজিদের জন্য প্রচুর দান-ধ্যান করতেন স্বাভাবিক। কিন্তু গোলকোন্টার রাজা তানাশা তাকে খাজনা দিচ্ছিলেন না। ওদিকে প্রচুর ধনরত্ন মসজিদের ভেতর জমা করেছিলেন। আওরঙ্গজেব সেই মসজিদ ভেঙে ধনরত্ন লুট করেন। অন্তত একটা মসজিদ ভাঙার কথা তো ইতিহাসেই আছে।

আসলে আমরা নবাব, সম্রাট, সুলতানদের নৈতিক ধার্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করছি। নবাব, সম্রাট, সুলতানরা অর্থ-প্রতিপত্তি-ক্ষমতার জন্য শাসন করতেন, ধর্ম-ন্যায়নিষ্ঠার জন্য নয়। আসলে এটা এক ধরনের ইতিহাসের বিকৃতি। ইতিহাসকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টি দিয়ে দেখানোর চেষ্টা। যা শুরু হয়েছিল ১৮৫৭ সাল থেকে সিপাহী বিদ্রোহের সময় থেকে।

বাহাদুরশাহ জাফরকে সামনে রেখে কারা লড়ছিলেন। লক্ষীবাড়ি, তাতিয়াটিুপি, মঙ্গলপান্ডে, কুমার সিংহ হিন্দু মুসলমান মিলে লড়ছিলেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। ব্রিটিশরা তখন থেকে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসি নিতে শুরু করে। তারাই প্রথম ইতিহাস বিকৃত করে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে অন্য ইতিহাস লেখা শুরু করে। সেই ইতিহাস আজ বিজেপি আরএসএস আমাদের শেখাতে চাইছে।

এটাই সত্যি, আসুন আমরা ইতিহাস দেখি। দিল্লির সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইতিহাস খুব পুরনো নয়। এমন কি দেশভাগের সময়তেও দিল্লি ছিল শান্ত। ১৯৭৪ সালে সদর বাজার এলাকায় আরেকটা হামলা হয়। দশজনের মৃত্যু হয়। ৪৪ দিন কারফিউ জারি ছিল। এরপর ১৯৮৭ সালে হসকচ এলাকাতে ১৫ জন মারা গিয়েছিল। তারমধ্যে ১০ জন পুলিশের গুলিতে। মানে পুলিশ শুরু থেকেই সক্রিয় ছিল।

১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার ঠিক পরে সিলেমপুরে হিংসা ছড়ায়। ৩০ জন মারা গিয়েছিল। বিজেপি এরপর থেকে দিল্লিতে বেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এরআগ পর্যন্ত দিল্লি কংগ্রেসের দখলে ছিল। অবশ্যই ১৯৮৪ সালের শিখ হত্যার কথা উঠবেই। কিন্তু সেটাতো সাম্প্রদায়িক হিংসা ছিল না। সেটা ছিল গণহত্যা। কংগ্রেস নেতাদের নেতৃত্বে গণহত্যা। যার জন্য তাদের কয়েকজন শাস্তি পেয়েছে। কংগ্রেস দল হিসেবেই ক্ষমা চেয়েছে। অথচ এই কংগ্রেস দলই আজকে এই নতুন দিল্লির চেহারা তৈরি করেছে।
আগে ঠিক দিল্লির ঠিক মধ্যখানে ছিল মুসলমান লোকজনের বাস। বাহাদুর শাহ জাফর মার্গ, আসিফ আলী মার্গের উলটো দিকে তুর্কমান গেটের উলটো দিকে ছিল বিরাট বস্তি এলাকা। দেশভাগের সময় পয়সাওয়ালা মুসলমানরা চলে গিয়েছিল পাকিস্তানে, পড়েছিলেন গরীব সেই সব মুসলমানরা। তারাই থাকতেন ওই বস্তিতে।

সঞ্জয় গান্ধী আর তার সাগরেদ বলা যায় জগমহনকে নিয়ে ওই তুর্কমান গেটের বস্তির পাশের গেট ভাঙেন, বুলডোজার দিয়ে ভাঙেন। উৎখাত হন লক্ষ লক্ষ মুসলমান গরীব মানুষ। সঞ্জয় গান্ধী তখন দিল্লি সাজাচ্ছিলেন। ওই উৎখাত হওয়া মানুষেরা চলে যান দিল্লির উত্তর পূর্বে। সেখানে তৈরি হলো জোগ্গি-ঝুপড়ি।

মজার বিষয় হলো বেআইনীভাবে তৈরি হওয়া ঝুপড়ি তৈরি করতে সহায়তা করেছিলেন কংগ্রেস নেতারাই। তাই ওইসব কলোনীর নাম হলো ইন্দিরা গান্ধী নগর, জহরলাল নগর, সঞ্জয় নগর। এখনও লেখা থাকে যে, যে কলোনী সে সে নামে। সেসব বেআইনী কলোনীকে আইনী করা হবে বলেও প্রতিশ্রুতিও সেই কবেকার।

এবারেও নরেন্দ্র মোদি বললেন, কিন্তু রেজিস্ট্রি হলো মাত্র ২৯ জনের নামে। তাও আইনসম্মত ভাবে নয়। সেই কথা যাক, যা বলছিলাম ওই তুর্কমান গেটের পাশ থেকে সরে গিয়ে যমুনাপাড়ে কিছু মুসলিম ঘেটো তৈরি হলো। সেখানে দেশের অন্য প্রান্ত থেকে মুসলিমরা এলেন। ৭১-এ বাংলাদেশ থেকেও এলেন। কিন্তু সব মিলিয়ে সেই ঘেটোর মতোই হয়ে রইলো। হিন্দু-মুসলমান এলাকা হলো। হিন্দু এলাকা হলো, মুসলমান এলাকা হলো এবং এই অঞ্চলে কমিউনাল টেনশন লেগেই রইলো।

হিন্দু এলাকা গুলো ১৯৯২ সাল থেকে বিজেপির এলাকা হয়ে উঠলো আর মুসলিম এলাকা হলো কংগ্রেসের। অবশ্য ২০১৫ সাল থেকে এই এলাকাগুলো চলে গেছে আমের (আম আদমি পার্টি) কাছে। কংগ্রেস ক্রমশ শক্তি হারিয়েছে। এবারে হিংসা বলুন. হামলা বুলন তাকে এই পটভূমিতে দেখলে বুঝতে সুবিধা হবে কেন দিল্লির উত্তর-পূর্বেই হামলা হলো। কেন ওই এলাকাগুলোতে বিজেপি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।

একইভাবে দেশের যেখানে যেখানে মিক্স পপুলশন (মিশ্র জনগোষ্ঠী) হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে থাকেত তার থেকে যেখানে হিন্দুরা এক এলাকায় মুসলমানরা তার পাশের এলাকায় সেখানে কেন বিজেপি জিতেছে। বিজেপির সমর্থন বাড়ছে তার ওপরে রয়েছে উত্তরপ্রদেশের লাগোয়া এলাকা। যেখান থেকে সহজেই ভাড়া করা গুণ্ডাদের পাঠানো যায়।
মুসলিম ঘেটোগুলো দেখিয়ে খুব সহজেই বলা যায় ওরা সংখ্যায় বাড়ছে। ওরা মাইকে সকাল-সন্ধ্যা আজান দেয়, ৫টা বিয়ে করে। আসলে ওরা পাকিস্তানের চর, ওরা জঙ্গি। এর ফলে হিন্দু এলাকায় এক ধরনের পোলারাইজেশন হবে। যেটা বিজেপি চায়। সেই পোলারাইজেশন থেকে স্লোগান উঠবে, ‘দেশকে গাদ্দার রুখো’, ‘গুলি মারো’ ।

তা্ই তাদের ৩০৩ জন সংসদের একজনও মুসলমান নয়। উত্তর প্রদেশে তারা একজন মুসলমানকেও এমএলএ’র টিকেট দেয়নি। তাদের দরকার নেই। তারা মুসলিমদের ঘেটোয় রাখতে চাই। উলটো হিন্দুদের তাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মেরুকরণ চাই। এটাই তাদের ঘোষিত রাজনীতি। তাই তারা দিল্লি থেকে কোলকাতা স্লোগান দিতে পারে ‘দেশকে গাদ্দার রুখো’, ‘গোলি মারো সালোকো’।

গাদ্দার কারা? উত্তর পরিষ্কার। কেন ওই তো পোশাক দেখেই চেনা যাচ্ছে। যারা তাদের হয়ে কথা বলছে তারাই দেশাদ্রোহী, তারাই গাদ্দার। যেখানে হিন্দু-মুসলিম একসঙ্গে থাকবে সেখানে মেরুকরণ করা কঠিন। সেখানে আঙ্গুল তুলে গুজব ছড়ানো কঠিন। ওরা রোজ গরুর মাংশ খায় বললে কেউ বলবে চাচার তো ইউরিক এসিড, মাছ-মাংশ কিছুই খায় না। গুজব ছড়ানো হলো ওরা রোজ কাফেরদের মারবে বলে নামাজ পড়ে। তখন কেউ বলবে, ধাত তাই হয় নাকি।

এই সেদিন ব্লু পিসিকে রক্ত দিল ওসমান ভাই। তাই ওরা চায় আলাদা করতে। বিজেপি আরএসএস চায় মুসলমানরা খিদিরপুর আর পাকসা কাছেই থাক। গুজব ছড়াতে হবে, হিন্দু ভোট মেরুকরণে সুবিধা হবে। এই অপরাজনীতির বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ