নারী দিবস ম্যারাথনে পাপিয়া চ্যাম্পিয়ন
‘নিরাপদ সমাজ, নিরাপদ নারী’-স্লোগানে অনুষ্ঠিত নারী দিবস রেগুলার ম্যারাথনে রেগুলার বাংলাদেশের পাপিয়া খাতুন চ্যাম্পিয়ন, হামিদা
১৯৮১ সালে সাইক্লিং খেলা দিয়ে শুরু মো. আব্দুল কুদ্দুসের খেলোয়াড়ি জীবন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলে অসংখ্য পদক জিতেছেন। গড়েছেন অনেক সাইক্লিষ্ট। যারা বর্তমানে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন দেশের সাইক্লিং ট্র্যাক। দেশেসেরা সাইক্লিষ্টদের কারিগর তিনি। তার তত্বাবধানে আন্তর্জাতিক অঙ্গণেও সাফল্য কুড়িয়ে এনেছেন বাংলাদেশের সাইক্লিষ্টরা। কিন্তু অবহেলিতই রয়ে গেছেন আবদুল কুদ্দুস। শুধু সাইক্লিষ্ট গড়ার করিগরই নন তিনি। সব সময় খেলোয়াড়দের আর্থিক সহযোগিতা করার ক্ষেত্রেও উদারহস্ত কুদ্দুস। অনেক সময় সাইক্লিষ্টদের বিদেশ যাওয়ার অর্থের যোগান দিয়ে হয়েছেন প্রতারিতও। সেই অর্থ আজও ফেরত পাননি বাংলাদেশ সাইক্লিং ফেডারেশনের তহবিল থেকে। সাইক্লিংয়ের জন্য এত কিছু করেও এখনও পাননি জাতীয়ভাবে কোন স্বীকৃতি। দীর্ঘ চার দশকেও তার ভাগ্যে জোটেনি জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার। জীবনের অর্ধেক সময় ক্রীড়াঙ্গণে ব্যয় করা তৃণমূলের এই ক্রীড়াবিদ ও সংগঠকের হাপিত্যেস জাতীয় একটি সম্মাননা বা স্বীকৃতির।
বেশিরভাগ ক্রীড়াবিদ ও সংগঠকের সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা থাকে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারের। সৌভাগ্যবানরা জীবিত অবস্থায় সেই সম্মান পেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেন। শান্তির আবেশে ভেসে যান। আবার অনেকে জাতীয় এই সম্মানের যোগ্য থাকলেও পুরস্কার না পেয়েই না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। কেউ কেউ মৃত্যুর পর জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পেলেও জীবিত অবস্থায় না পাওয়ায় তাদের পরিবার এবং সংশ্লিষ্টরা আফসোসও করেন। তবে জীবিত থেকেই দেশের ক্রীড়াঙ্গণের সর্বোচ্চ এই স্বীকৃতি পেতে আকুল আব্দুল কুদ্দুস। তার কথায়, ‘জীবনের ৫৮ বছরের মধ্যে ৪২ বছর কাটিয়েছি ক্রীড়াঙ্গণে। দেশের ক্রীড়াঙ্গণে অনেক সাফল্যের কারিগর। কিন্তু আজও তার স্বীকৃতি পাইনি। এই হতাশা নিয়েই কি পরপারে যেতে হবে আমাকে?’
১৯৮১ সালে ঢাকা জেলা শহরে প্রথমবার সাইক্লিং খেলতে এসেই রৌপপদক জিতেন কুদ্দুস। এরপর ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত জাতীয় রেকর্ডসহ ২৩টি স্বর্ণ, রৌপ্য ও ব্রোঞ্জসহ ৫২টি পদক জিতেছেন। ১৯৯২ সালে ট্যুর ডি বাংলাদেশ টুর্নামেন্টে ১০০০ কিলোমিটারে প্রথম স্থান অর্জন করেন। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ট্যুর ডি পাকিস্তানে ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ১৮৬০ কিলোমিটারে ১০ স্টেজের খেলায় ৭ম স্থান অধিকার করে সনদ পান।
খেলোয়াড়ী জীবনের মতো বর্ণিল কুদ্দুসের কোচিং ক্যারিয়ারও। বাংলাদেশ বস্ত্র শিল্প কর্পোরেশনকে জাতীয় সাইক্লিংয়ে একবার চ্যাম্পিয়ন করান। বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশনকে (বিজেএমসি) জাতীয় সাইক্লিংযে ১৯ বার চ্যাম্পিয়নশিপ করিয়েছেন এই কোচ। ২০১৬ সালের জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে আবদুল কুদ্দুসের তত্বাবধানে ২০টি ইভেন্টের মধ্যে ১৯টিতে স্বর্ণপদক জেতে বিজেএমসি। আন্তর্জাতিক অঙ্গণে আরও সমৃদ্ধ কুদ্দুসের কোচিং ক্যারিয়ার। ২০০২ সালে দিল্লি দ্বিতীয় সার্ক সাইক্লিং প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশকে দুটি রৌপ্য ও নয়টি ব্রোঞ্জ জিতিয়ে রানার্সআপ করান তিনি। ২০০৬ সালে নবম সাফ গেমসে সাইক্লিং প্রশিক্ষক হিসেবে শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং দেশকে ব্রোঞ্জপদক এনে দেন। ২০১৩ সালে দিল্লিতে ট্র্যাক এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে তার প্রশিক্ষণে বাংলাদেশ দল ১টি রৌপ্য ও একটি ব্রোঞ্জপদক জিতে ঘরে ফেরে। পরের বছর স্কটল্যান্ডের গøাসগোতে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ গেমসে দলগত ইভেন্টে বাংলাদেশ জাতীয় সাইক্লিং দলের প্রশিক্ষক হিসেবে অংশ গ্রহণ করেন এবং দেশকে নবম স্থান অর্জন করান। একই বছরে দিল্লিতে এশিয়ান ট্র্যাক চ্যাম্পিয়নশিপে সাইক্লিং প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন কুদ্দুস। ২০১৮ সালে মালয়েশিয়াতে এশিয়ান ট্র্যাক চ্যাম্পিয়নশিপে সাইক্লিং প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এই সাবেক ক্রীড়াবিদ সংগঠক ও কোচ। সদ্য সমাপ্ত ৪১তম জাতীয় সাইক্লিং প্রতিযোগিতায় তার প্রশিক্ষণে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ আনসার সাইক্লিং দল।
কুদ্দুসের প্রশিক্ষণে মাঠ পর্যায়ে বহু খেলোয়াড় তৈরী হয়েছে। দেশের সাইক্লিংয়ে ৯৫ ভাগ সাইক্লিস্ট তার হাতেই গড়া। যাদেরকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তুলে এনে সাইক্লিষ্ট বানিয়েছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাইক্লিষ্ট হলেন- ফারহানা সুলতানা শিলা (সদ্য জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত সাইক্লিষ্ট), আবদুর রউফ, শাহ ইফতেষার আলম নাহিদ, সেবীকা মন্ডল, সোনিয়া ইসলাম অভি, তরিকুল ইসলাম, মনোয়ারা খানম সাথী, স্বপন আলম, সমাপ্তী বিশ^াস, মুকতাদির আল হাসান, শিল্পী খাতুন, সুবর্ণা বর্মন, তিথী বিশ্বাস ও খন্দকার মাহবুব আলম, রিয়াদ মাহমুদ, জয়নুল আবেদিন, পারুল আক্তার, এমএ মতিন বাবু, জাহিদ চৌধুরী সুমন ও রুনা লায়লা। এছাড়া ফেডারেশনের বর্তমান কোষাধ্যক্ষ এবং প্রশিক্ষক মো. সাহিদুর রহমান সাহিদেরও কোচ ছিলেন আবদুল কুদ্দুস। সাংগঠনিক জীবনেও নিজের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন আব্দুল কুদ্দুস। বাংলাদেশ সাইক্লিং ফেডারেশরে সাবেক কমিটিগুলোর দুইবারের যুগ্ম সম্পাদক, দুইবারের কোষাধ্যক্ষ ও দুইবারের সদস্য হিসেবে থেকে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন।
বিজেএমসির কোচ হিসেবে তৃণমূল থেকে তিনি সাইক্লিং, নারী ভলিবল, হ্যান্ডবল, কাবাডি, ভারোত্তোলন, অ্যাথলেটিকস, পুরুষ ফুটবল, নারী ফুটবল, জিমন্যাস্টিক্স, তায়কোয়ান্ডো ও উশুর খেলোয়াড় সংগ্রহ করে জাতীয় দলে সরবারাহ করেছেন। যারা আজ নিজেদের অবস্থানে সমৃদ্ধ। তাইতো তিনি এখন ক্রীড়াঙ্গণের ‘মামা’ হিসেবে খ্যাত। শুধু ক্রীড়াবিদ, কোচ বা সংগঠক হিসেবেই নয়, সাইক্লিষ্টদের বিদেশ সফরে ফেডারেশনের আর্থিক সংকটেও বহুবার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন আবদুল কুদ্দুস। ২০১৭ সালে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত এশিয়ান ট্র্যাক সাইক্লিংয়ে অংশ নেয়ার জন্য জাতীয় দলের সাইক্লিষ্ট ও সংগঠকদের সাড়ে ৩ লাখ টাকা ধার দিয়েছিলেন তিনি। মালয়েশিয়ার ওই আসরে বাংলাদেশ থেকে চারজন সাইক্লিস্ট ও তিনজন কর্মকর্তা গিয়েছিলেন। পৃষ্ঠপোষক না পাওয়ায় বিজেএমসির ‘মামা’খ্যাত কুদ্দুসের কাছে ধরনা দেন ফেডারেশন কর্তারা। বেøজার, ট্র্যাকসুট, স্যু এবং বিমান ভাড়া বাবদ অর্থের যোগান দেন এই কুদ্দুস। যে টাকা ফেডারেশন এখনও শোধ করেনি। এ বিষয়ে সাইক্লিং ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান মানু বলেন, ‘ঘটনা সত্যি। মালয়েশিয়া যাওয়ার খরচ দিয়েছিলেন কুদ্দুস। কিস্তিতে দিলেও এতদিনে শোধ হয়ে যেত তার দেনা। যদিও মালয়েশিয়ায় যাওয়া পুরো দলটি ছিল বিজেএমসির। তাদেও দেয়ার কথা ছিল অর্থ। কিন্তু সেই অর্থ তারা দেয়নি। তাই বলে কুদ্দুসের টাকা না দেয়ার কোনো কারণ নেই। পুরো ঘটনার আমি সাক্ষী।’
এতো কিছুর পরও অবহেলিতই রয়ে গেলেন দেশের বরেণ্য সাবেক ক্রীড়াবিদ, সংগঠক ও কোচ আব্দুল কুদ্দুস। সাইক্লিংবোদ্ধারা মনে করেন জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারের জন্য কুদ্দুসকে বিবেচনা করে তার দীর্ঘ ৪২ বছরের কাজের স্বীকৃতি দিয়ে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সুবিচার করবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।