Inqilab Logo

সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পেট ভাড়ায় আসছে ইয়াবা

আড়াই বছরে ছয়জনের মৃত্যু : টার্গেট নারী, শিক্ষার্থী ও অভাবী মানুষ

সাখাওয়াত হোসেন | প্রকাশের সময় : ৫ জুন, ২০২২, ১২:০১ এএম

রাজধানীর ডেমরা গলাকাটা ব্রীজ সংলগ্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে গত ২০ মে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তৈয়্যবা বেগম, তার ১১ বছরের শিশু তামান্না আক্তার ও ভাইয়ের স্ত্রী ইয়াছমিনকে গ্রেফতার করে। তাদের কাছে তথ্য ছিল, গ্রেফতারকৃতরা ইয়াবা বহন করছে। তবে গোয়েন্দারা তাদের দেহ ও মালামাল তল্লাশী করে কিছুই পায়নি। পরে তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে এক্স-রে করানো হয়। এতে শিশু তামান্না ও ইয়াছমিনের পেটের ভেতর বিশেষ কোনো বস্তু থাকার অস্তিত্ব মিলে। পরে তাদেরকে ওষুধ খাওয়ালে তামান্নার পেট থেকে স্কচটেপ মোড়ানো ৭৮০ পিস এবং ইয়াছমিনের পেট থেকে ৭২০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট বেরিয়ে আসে। কক্সবাজার থেকে ইয়াবা সংগ্রহ করে ঢাকায় এনে এভাবে বিক্রি করছিল চক্রটি। পথে কোথাও যেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সন্দেহের চোখে পড়তে না হয়, তাই সঙ্গে আনা হতো শিশুদের।

জানা গেছে, শুধু সড়ক ও নৌ পথেই নয়, কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম থেকে বিমানে করে ঢাকায় নিয়ে আসা হচ্ছে ইয়াবা। বিশেষ ধরনের প্যাকেটে করে পেটে ভরে একজন বহনকারী সর্বোচ্চ আড়াই থেকে তিন হাজার পিস ইয়াবা পাচার করছে। অথচ বিমানবন্দরে দেহের ভেতরে বহন করা মাদক শনাক্তের প্রযুক্তি না থাকায় ধরা পড়ছে না। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা জানান, পেটের ভেতরে ধাতব পদার্থ ছাড়া ইয়াবা বা অন্য কোনো মাদক বহন করা হলে তা স্ক্যানারে ধরা পড়ে না। পেটে থাকা মাদক শনাক্তে এক্স-রে মেশিন প্রয়োজন হলেও তা বিমানবন্দরে নেই। এ কারণে সহজেই মাদক পাচারকারীরা পার পেয়ে যাচ্ছে।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা জানিয়েছে, সীমান্তবর্তী জেলা ও কক্সবাজার থেকে ইয়াবা কিনে মাদক ব্যবসায়ীরা তাদের মাধ্যমে পাচার করে। এসব ইয়াবা পলিথিন ও স্কচটেপ দিয়ে ছোট ছোট বলের মতো তৈরি করে খেয়ে পেটের ভেতরে তথা পাকস্থলীতে বহন করে ঢাকায় নিয়ে আসতো। এরপর মলত্যাগের মাধ্যমে পেট থেকে অপসারণের পর তা পাচারকারীদের হাতে তুলে দিতো।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পাচারের উদ্দেশ্যে কারবারিদের পেট ভাড়া নেন ইয়াবা ব্যবসায়ীরা। এরপর বিভিন্ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে মলদ্বার বা কলার সাথে ছোট পোটলা গিলে তাদের পেটে প্রবেশ করানো হয় ইয়াবার ছোট ছোট পোটলা। কিন্তু কোনো কারণে ওইসব ইয়াবা গলে বিষক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ফলে অনেকে মারাও যান। ইয়াবার ক্ষেত্রে চোরাকারবারিরা পলিথিনে পেঁচিয়ে টিউবের মতো তৈরি করে থাকে। একেকটি টিউবে ৪০০ থেকে ৫০০ ইয়াবা ট্যাবলেট থাকে। এগুলো কখনও কলার ভেতরে ঢুকিয়ে মুখ দিয়ে গিলে খাওয়ানো হয়। আবার কখনও বিশেষ কৌশলে মলদ্বার দিয়ে পেটের ভেতরে ঢোকানো হয়। ৫ থেকে ২০/২৫টি টিউব একসঙ্গে পেটের ভেতরে ঢুকিয়ে বহনকারীরা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাত্রা শুরু করে।

সূত্র জানায়, পথে তারা তল্লাশির মুখোমুখি হলেও তাদের ধরা যায় না। পেটের ভেতর ইয়াবা বহনের প্রবণতা ধীরে ধীরে বাড়ছে। লোভে পড়ে মাদক চোরাকারবারিরা আত্মঘাতী এ কৌশল বেছে নিচ্ছে। কক্সবাজার থেকে একটি চালান ঢাকায় আনতে পারলে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা পায় বহনকারীরা। বিভিন্ন সময়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে যারা গ্রেফতার হয়েছে তারা স্বীকারোক্তিতে বলেছে, অর্থের লোভেই এমন ভয়ঙ্কর কৌশল বেছে নিয়েছে। নিয়মিত কারবারিদের পাশাপাশি নারী, পুরুষ ও শিক্ষার্থীদের দিয়ে পেটে ভরে ইয়াবা আনছে। একবার চালান নিয়ে এলে বহনকারীরা বিমান টিকিট ছাড়াও কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা পাচ্ছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে এক শ্রেনীর মানুষ পেটের ভেতরে ইয়াবা বহন করছে। সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে মাদক পাচারের মতো বড় অপরাধে জড়াচ্ছে। অনেক সময় পেটের ভেতরে ইয়াবা ফেটে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইয়াবা পাচারকারী চক্র এক শ্রেনীর মানুষকে এ ধরনের অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত করছে সামান্য ৫ থেকে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে। বর্তমান সময়ে যে কোন পেশায় কাজ করে জীবন-যাপন করা যায়। মাদক বহনের মতো জঘন্য অপরাধ পরিহার করার জন্য তিনি সকলের প্রতি আহ্বান জানান।

ডিএনসির ঢাকা মেট্রো উপ-অঞ্চলের একজন কর্মকর্তা বলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বহনকারীরা ইয়াবার কারবারি নয়। টেকনাফ ও আশপাশের মানুষ টাকার জন্য জীবনের ঝুঁঁকি নিয়ে এই কারবার করছে। কারবারিদের মূল টার্গেট স্বামী পরিত্যক্তা, ছাত্রছাত্রী এবং বেকাররা। গত আড়াই বছরে পেটে ইয়াবা বহন করার সময় ফেটে ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসক এম আব্দুল্লাহ বলেন, পেটের ভেতরে ইয়াবা ভরা হলে যেকোনো সময় মৃত্যু হতে পারে। পলিথিন ফেটে বা লিক হয়ে ইয়াবা পাকস্থলিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। প্রাথমিকভাবে পেট ব্যথার উপসর্গ দেখা যেতে পারে। যদিও চোরাকারবারিরা কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে আবার বের করে ফেলে। তবে ধারাবাহিকভাবে এই কাজে কেউ লিপ্ত থাকলে তার দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যগত ঝুঁঁকি তৈরি হতে পারে বলে জানান এই চিকিৎসক।

পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, গত বছর ১২ আগস্ট আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে পেটে করে ইয়াবা পাচার করতে একটি বিশেষ কৌশলে বেলুনে মোড়ানা ১৭ প্যাকেট ইয়াবা খায় টেকনাফের মো. মোস্তাফা (২৪)। চট্টগ্রামে রওয়ানা দেয়ার আগ মুহূর্তে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে ওয়াশ করে বের করা হয় ১২ প্যাকেট ইয়াবা। কিন্তু বাকি ৫ প্যাকেট ইয়াবা ফেটে যাওয়ায় সেগুলো বের করা সম্ভব হয়নি। অবস্থা বেগতিক দেখে তাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
র‌্যাবের একজন কর্মকর্তা জানান, গত ৩ মে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় অংপ্রু (৬২) নামে এক মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করেছে র‌্যাব-১১। তার পেট থেকে বের করা হয় ৩ হাজার ২৩০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট। অংপ্রু কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থানার মৃত শাহঅংগিউয়ের ছেলে। তিনি আরো বলেন, অংপ্রু দীর্ঘদিন ধরে অভিনব কৌশলে পেটের ভেতর করে ইয়াবা পাচার করে আসছিল। নারায়ণগঞ্জের জেনারেল হাসপাতাল ভিক্টোরিয়াতে জরুরি অবজারভেশন ওয়ার্ডে ডাক্তার এবং ওষুধের ধারা তার পেট থেকে নিষিদ্ধ ইয়াবা উদ্ধার করেন।

এপিবিএন অতিরিক্ত এসপি জিয়াউর রহমান জানান, গত ১৬ মে রাতে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের অভ্যন্তরীণ টার্মিনালের সামনে থেকে মাসুদ খান (৩৯) নামে এক মাদক বিক্রেতাকে গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে মাসুদ স্বীকার করেন যে পাচারের উদ্দেশ্যে তিনি পেটের মধ্যে ইয়াবা বহন করছিলেন। ওষুধ খেয়ে টয়লেটে গিয়ে তিনি ৪ হাজার ৬৭৫ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট বের করে দেন। বিমানবন্দরে সুরক্ষা ভেদ করে কীভাবে ঢুকছে ইয়াবা? জানতে চাইলে বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অতিরিক্ত এসপি মো. আলমগীর হোসেন বলেন, বিমানবন্দরে দেহের ভেতরে বহন করা মাদক শনাক্তের প্রযুক্তি না থাকায় এ পথকে বেছে নিয়েছে মাদক চক্র। শুরুতে যাত্রী বেশে ব্যাগে লুকিয়ে আনলেও, এখন শরীরের নানা অঙ্গে বা পেটের ভেতরেই মাদক বহন করছে পাচারকারীরা যা স্ক্যানারে ধরা পড়ে না। কারণ মাদক আসলে মেটাল না। মাদক ধরতে প্রয়োজন এক্স-রে মেশিন, যেটি বিমানবন্দরে নেই।



 

Show all comments
  • Aslam ৫ জুন, ২০২২, ৬:২১ এএম says : 0
    ডিজিটাল বাংলাদেশ ডিজিটাল কৌশল
    Total Reply(0) Reply
  • Yousman Ali ৫ জুন, ২০২২, ১০:০৫ এএম says : 0
    হাইরে মানুষ মানুষ হলিনা
    Total Reply(0) Reply
  • md shahid rahman ৫ জুন, ২০২২, ১০:৪২ এএম says : 0
    omg
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইয়াবা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ