পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। পুড়ছে ঘর-বাড়ি, হাঁড়ি-পাতিল, ধান-চাল, গৃহপালিত পশু-পাখি। আগুনের লেলিহান শিখা থেকে বাদ যায়নি রোহিঙ্গা মুসলিমদের মাঠের ফসলও। আকাশে কু-লী পাকিয়ে উঠছে ধোঁয়া। প্রাণ বাঁচাতে পালানো শিশু-নারীকে গুলি করা হচ্ছে। গুলিতে নিহত রক্তাক্ত লাশের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছে নারী-শিশুর স্বজন। ঘরের ভিতরে আগুনে পুড়ে অঙ্গার হওয়া লাশের পাশে বসে আহাজারী করছে স্ত্রী-ছেলেমেয়ে। এক বিভীষিকাময় নারকীয় দৃশ্য। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সুচির নেতৃত্বাধীন সরকারের সেনাবাহিনীর এই নিষ্ঠুরতায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের মানবাধিকার ভূলণ্ঠিত। কিন্তু বিশ্ব মিডিয়াগুলোতে এগুলো স্বাভাবিক ‘খবর’। নীরব বিশ্ববিবেক! প্রতিবেশী দেশেও এ নিয়ে নেই তেমন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া! বন-জঙ্গল, সাগর পেরিয়ে বাঁচার চেষ্টায় মরিয়া সীমান্তে আসা রোহিঙ্গা মুসলিম নারী-শিশুদের ‘অবৈধ প্রবেশ’ ঠেকিয়েই যেন দায় শেষ করছি। উদ্বাস্তু রোহিঙ্গারা মুসলমান, এটাই কি তাদের অপরাধ? বিগত ষাটের দশকে হাজার হাজার মাইল দূরের ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদে ভিয়েতনামীদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে ঢাকার রাজপথ কাঁপিয়েছি। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিয়ে মানবতার স্বার্থে গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে ঢাকার রাজপথে গান গেয়ে টাকা তুলে ভিয়েতনামের নির্যাতিত মানুষের জন্য পাঠিয়েছি। অথচ বাড়ির পাশের দেশ মিয়ানমার। যাদের সঙ্গে হাজার বছরের আত্মিক সম্পর্ক। সে দেশের রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিপন্নতা আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করছে না। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর মুসলিম বিদ্বেষী হিংস্রতার প্রতিবাদ করছি না। দু’একটি ইসলামী দল প্রতিবাদ করলেও বড় রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবীরা নীরব। জাতি হিসেবে আমরা কি মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলেছি?
বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সাফল্যে পৃথিবীকে এখন বলা হয় গ্লোবাল ভিলেজ (বিশ্বগ্রাম)। বৈশ্বিক যোগাযোগে পৃথিবীর এক প্রান্তের খবর নিমিষেই চলে যায় অন্যপ্রান্তে। মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের রাখাইন রাজ্যে মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামে গত অক্টোবরে রোহিঙ্গাদের গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে। অতঃপর গত ৯ নভেম্বর মিয়ানমার সেনাবাহিনী অভিযানের নামে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর শুরু করে আক্রমণ। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পরিচালিত সে অভিযানে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়েছে রাখাইন রাজ্যের শত শত মুসলিম অধ্যুষিত গ্রাম। রোহিঙ্গা মুসলিমদের রক্তে ভিজে গেছে রাখাইন রাজ্যের মাটি। নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে সাড়ে তিনশ’ মুসলিম শিশু-নারী-পুরুষ। ঘরছাড়া করা হয়েছে এক লাখ ৬০ হাজার মানুষকে। এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু বনে-জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে; সাগরে ভাসছে। বর্বরতার হাত থেকে বাঁচাতে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করে বিতাড়িত হয়ে আবার সাগর-বন-জঙ্গলে চলে গেছে। এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা মুসলিমকে আশ্রয় দেয়ার দাবি জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিক কফি আনান এবং ওআইসি রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিতাড়নের প্রতিবাদে মিয়ানমারের ওপর চাপ দেয়ার দাবি জানিয়েছে। শুধু তাই নয়, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সুচি বাতাসে বারুদের গন্ধ ছড়িয়ে বন্দুকের নলে মিয়ানমারে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চান কি নাÑ এ প্রশ্ন রেখে তার নোবেল প্রাইজ বাতিলের দাবি জানিয়েছে লাখো মানুষ। প্রশ্ন হলো রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের রক্তাক্তের খবর ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বিশ্বে; বিপন্ন হয়ে পড়েছে মানবতা; তারপরও বিশ্ব বিবেক নীরব কেন? রোহিঙ্গারা মুসলিম ধর্মের বলেই কি তারা বিশ্বের পরাশক্তি দেশগুলোর কাছে অপাংক্তেয়? আর প্রতিবেশী দেশের মুসলিম হিসেবে বিপর্যয়ের মুখেপড়া রোহিঙ্গা মুসলিম শিশু-নারীদের জন্য আমরা কি করছি? রোহিঙ্গারা মুসলিম না হয়ে যদি অন্য ধর্মাবলম্বী হতো, তাহলে কি আমরা নীরব থাকতাম? আশ্রয়ের সন্ধানে বন-জঙ্গল-সাগর পাড়ি দিয়ে বেঁচে থাকার আকুতিকে পায়ে দলিয়ে দিতাম?
অক্টোবরে এক পুলিশ চেকপোস্টে সমন্বিত হামলার জের ধরে রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে ব্যাপকভিত্তিক সেনা অভিযান শুরু হয়। অতঃপর ৯ নভেম্বর সেটা বীভৎস হত্যাযজ্ঞের রূপ লাভ করে। রোহিঙ্গা মুসলিম হত্যাযজ্ঞ শুরুর পর সাংবাদিক ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর ওই এলাকায় প্রবেশে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। তথাকথিত ‘শান্তির রানী’ অং সান সুচির নেতৃত্বাধীন সরকারের সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর জুলুম-নির্যাতন চলছে তো চলছেই। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমান সমর্থিত ‘রোহিঙ্গা ভিশন’ নামে একটি ওয়েবসাইটে পোস্ট করা একটি ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, কিছু আগুনে পোড়া লাশ মাটিতে রাখা হয়েছে এবং এগুলোকে ঘিরে তাদের স্বজনরা আর্তনাদ করছে। ধারাভাষ্যে বলা হয়, রাখাইন রাজ্যের মংডুর উত্তরাঞ্চলীয় একটি গ্রামে ১৩ নভেম্বর অন্তত ৯ জন মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরে ফেলে দেশটির সেনাবাহিনী। সে দিনের পর থেকে ওই গ্রামের আরও ৯০ জন নারী-পুরুষ-শিশুর সন্ধান এখন পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। এলাকাটি বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে খুব কাছে। বিবিসির খবরে বলা হয়, ওই ভিডিওতে যাদের দেখানো হয় তাদের ভাষা অনেকটা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম এলাকার আঞ্চলিক ভাষার মতোই। ভিডিওতে আগুনে পোড়া ধ্বংসস্তুপের মধ্যে তিনটি লাশও দেখানো হয়। ভিডিওতে একটি লাশের পাশে বসে দুই মহিলা কাঁদছেন। এক মহিলা লাশটির মুখে হাত বোলাচ্ছিলেন এবং বিলাপ করছিলেন। পাশেই ছিল আরও একটি লাশ। ভিডিওচিত্রটিতে একজন ধারাভাষ্য দিচ্ছিলেন, তবে তাকে দেখা যায়নি। তিনি বলছিলেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ১৩ নভেম্বর এই ঘটনা ঘটিয়েছে।
আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলমাদের বর্তমান অবস্থাকে নরকের সঙ্গে তুলনা করে বলছেন, সেখানে প্রায় দেড় মাস ধরে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে কমপক্ষে সাড়ে তিনশ’ মানুষ নিহত হয়েছে। বিবিসিতে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, সেখানে এমন অত্যাচার চলছে যা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। অক্টোবরের ৯ তারিখ থেকে সাড়ে তিনশ’ জনকে হত্যার পাশাপাশি বহু নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। সাড়ে তিন হাজার বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ঘরবাড়ি হারিয়েছেন ত্রিশ হাজারেরও বেশি মানুষ। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে মিথ্যাবাদী উল্লেখ করে তিনি বলেন, হত্যাযজ্ঞের পর থেকে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক কিম্বা সাংবাদিকদের সেখানে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। রাখাইন রাজ্যে স্থানীয় রোহিঙ্গা মুসলিমদের সাথে আমাদের যোগাযোগ রয়েছে। তাদের সাথে কথাবার্তার ভিত্তিতে আমরা যেসব খবর পাচ্ছি সেই চিত্রটা আরো অনেক বেশি ভয়াবহ। সবচে খারাপ অবস্থা উত্তর আরাকান এবং মংডু টাউনশীপে। সেনাবাহিনী বিভিন্ন পাড়ায় বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছে। লোকজনকে গুলি করে মেরে ফেলছে। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে লোকজন যখন বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে, তখন হেলিকপ্টার গানশিপ থেকে গুলিবর্ষণ করে তাদেরকে হত্যা করা হচ্ছে। রোহিঙ্গারা যেখানে গিয়ে লুকাচ্ছে সেখানে রাস্তা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় পথেঘাটে, খালে নদীতে তাদেরকে মেশিনগান দিয়ে গুলি করে মেরে ফেলা হচ্ছে। লোকজন নৌকায় করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে চাইলে তাদের নৌকার ওপর গুলি করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করায় উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, যাদের নিরাপত্তা নেই তাদেরকে বাংলাদেশের আশ্রয় দেয়া উচিত। আমাদের ওপর যে নির্যাতন চলছে তার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। বাংলাদেশের উচিত মানবিক কারণে তাদের জন্য সীমান্ত খুলে দেয়া। না হলে এই লোকগুলো যাবে কোথায়? অবশ্য রোহিঙ্গা ইস্যু বাংলাদেশের জন্য অস্বস্তিকর বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। গতকাল সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে চোরাচালান প্রতিরোধ সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক শেষে তিনি জানান, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে মিয়ানমার সীমান্তে বিশেষ প্রহরার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নৃশংসতায় সাড়ে ৩শ’ মানুষ খুন এবং এক লাখ ৬০ হাজার নিখোঁজের খবর প্রচার করা হলেও জাতিসংঘের হিসাবে এখন পর্যন্ত ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম গৃহহীন হয়ে পড়েছে। এদের অর্ধেকের বেশি গৃহহীন হয় ৯ নভেম্বরের পর। রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনী অভিযানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা, মহিলা ও কিশোরীদের ধর্ষণ, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ব্যাপকভিত্তিক অভিযোগ উঠেছে। তবে সেনাবাহিনী বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করছে। তবে তারা স্বীকার করেছে ৬৯ জন রোহিঙ্গা মুসলমানকে (তাদের ভাষায় বাঙালী) হত্যা করেছে।
এদিকে গৃহবন্দী থাকাবস্থায় ১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া অং সান সুচির বিরুদ্ধে ব্যাপক অসন্তোষ শুরু হয়েছে। মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলমানরা দীর্ঘদিন ধরেই রাষ্ট্রীয় ও সংখ্যাগুরু বৌদ্ধদের সন্ত্রাসের শিকারে তিনি নিশ্চুপ। দীর্ঘ বন্দী জীবন কাটানো সুচি ২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর মিয়ানমারের নির্বাচনে বিজয়ী হন। তারপরও মুসলিমদের ওপর নিপীড়ন চলছেই। এ অবস্থায় সুচির নোবেল পুরস্কার প্রত্যাহারের দাবি ক্রমাগত জোরালো হচ্ছে। ‘পিটিশন ওয়েবসাইট চেঞ্জ ডট’ ওআরজি নামে এক ওয়েব সাইটে জমা হচ্ছে তার পুরস্কার প্রত্যাহারের দাবির একের পর এক আবেদন। বাংলাদেশ সময় গতকাল রোববার দুপুর পর্যন্ত ওই পিটিশনে ১ লাখ ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষ স্বাক্ষর করেছেন। নরওয়ের নোবেল কমিটির কাছে পিটিশনটি উপস্থাপন করতে হলে অন্তত দেড় লাখ স্বাক্ষর লাগবে পিটিশনে। অং সান সু চির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে খোলা হচ্ছে নতুন নতুন পিটিশন। চলছে স্বাক্ষর সংগ্রহ। উল্লেখ, ২০১২ সালে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে জাতিগত সহিংসতায় শতাধিক মানুষের প্রাণহানির পাশাপাশি হাজার হাজার মানুষকে ঘরহারা হওয়ার পর সুচির নীরব ভূমিকার প্রতিবাদে শান্তিতে পাওয়া তার নোবেল পুরস্কার বাতিলের এই ক্যাম্পেইন শুরু হয়।
মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর নির্যাতনের ভয়ে সাগর-বন-জঙ্গল পথে পালিয়ে প্রতিদিনই বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছে ঘরছাড়া রোহিঙ্গা মুসলমানরা। টেকনাফের স্থানীয়রা বলছেন, সীমান্ত রক্ষীদের কড়া প্রহরা সত্ত্বেও গোপনে তাদের কেউ কেউ ঢুকছে। আবার সীমান্ত রক্ষীরা অনেককে ফেরত পাঠাচ্ছে। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিজিবিকে কঠোর নজরদারীর নির্দেশ দিলেও মানবিক বিবেচনায় বাংলাদেশের সীমান্ত খোলা রাখার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর। শরণার্থী বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরুর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সি আর আবরার বলছিলেন, মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক মহল থেকে যতটা চাপ দেয়া প্রয়োজন ততটা দেয়া হচ্ছে না। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সনদে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে। সে হিসেবে মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের সাহায্য করার বিষয় রয়েছে বাংলাদেশের। বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে সি আর আবরার বলেন ‘লোকগুলো (রোহিঙ্গা মুসলিম) যখন জীবনের ভয়ে ভীত হয়ে আরেক দেশে আশ্রয় প্রার্থনা করছে; তখন শুধু বাংলাদেশ নয়, সব দেশের আন্তর্জাতিক দায়িত্ব পালন করার বিষয় রয়েছে। এটা একটা মানবিক সমস্যা’। ইউএনএইচসিআর এক বিবৃতিতে মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের দুরবস্থা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। মিয়ানমারের সরকারকে সেখানের নাগরিকদের নিয়ম অনুযায়ী রক্ষা করার আহ্বান জানিয়েছে।
হাজার বছর আগে মুসলিমরাই এক সময় মিয়ানমার শাসন করতো। সেই মুসলমান জনগোষ্ঠীকে চূড়ান্তভাবে নির্মূল করতে ১৯৮৯ সালে আরাকান রাজ্যের নাম বদলে রাখাইন প্রদেশ রাখা হয়। একই সময়ে বার্মার নামকরণ করা হয় মিয়ানমার। মুসলিম রোহিঙ্গাদেরকে অবর্মী ও অবৌদ্ধ বলে অভিহিত করা হয়। নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে তাদের বিদেশী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। শুধু তাই নয়, তাদের ব্রিটিশ শাসনামলে বার্মায় এসে বসতি স্থাপনকারী ‘অবৈধ বাঙালি অভিবাসী’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। বার্মা থেকে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বহিষ্কার করার লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালে অপারেশন পরিচালনা করা হয়। ১৯৯১ সালে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে মিয়ানমার থেকে বহিষ্কারের চেষ্টায় সেনাবাহিনী আবার ‘অপারেশন পাই থায়া’ বা ‘পরিষ্কার ও সুন্দর জাতি অপারেশন’ নামে দ্বিতীয় অভিযান শুরু করে। ২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা এ সময় পালিয়ে বাংলাদেশে আসে। ১৯৯৪ সালে আইন করে রোহিঙ্গা মুসলিমদের দু’টির বেশি সন্তান নিষিদ্ধ করা হয়। ২০১২ সালে আবার রাখাইন বৌদ্ধরা রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্মূলে দাঙ্গা শুরু করে। এতে এক হাজার রোহিঙ্গা মুসলিমকে হত্যা করা হয়। অবশ্য সরকার ১৯২ জন নিহত হওয়ার কথা স্বীকার করে। ওই সময় উগ্র-সাম্প্রদায়িক বৌদ্ধরা মুসলমানদের গ্রামগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ১ লাখ ২৫ হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় রোহিঙ্গা মুসলমানরা মিয়ানমারের নাগরিক নয়। তাই তাদের আশ্রয়ের দায়িত্ব মিয়ানমার সরকারের নয়। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে মিয়ানমার সরকারের স্বীকৃত ১৩৫টি জাতি গোষ্ঠীর দেশের বৈধ নাগরিক রাখাইন প্রদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা চালায় বৌদ্ধ ভিক্ষুরা তুচ্ছ ঘটনায়। ভাগ্যের নির্মমতায় আরাকানের এক সময়কার মুসলিম রাজশক্তির অংশ রোহিঙ্গারা এখন শরণার্থী। এ সংকট শুরু হয় ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে বার্মার আরাকান দখলের পর থেকে। ১৮১৫ সালে আরাকান স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহী নেতা সিনপিয়ার মৃত্যুর দুইশ’ বছর পরও রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার সুরাহা হয়নি। মিয়ানমারের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী আরাকানি জনগণ ও রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর যে নির্যাতন-নিপীড়ন চালাচ্ছে তা চরম মানবাধিকার লংঘন। পূর্বপুরুষদের ভিটেবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে রোহিঙ্গা মুসলমানরা এখন অনাহার পুষ্টিহীনতায় খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন যাপন করছে। অথচ বিশ্ব বিবেক নীরব।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।