Inqilab Logo

সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ৩০ বৈশাখ ১৪৩১, ০৪ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস ২০২২ ও পাবলিক পরিবহনে ধূমপান বন্ধ করা সময়ের দাবি

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৩০ মে, ২০২২, ৬:৩৫ পিএম

বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসটি মূলতঃ তামাকজাত পণ্যের বিপদ সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য উৎসর্গীকৃত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্য দেশগুলি বিশ্বে তামাক দ্বারা সৃষ্ট রোগ এবং মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া হিসাবে ১৯৮৭ সালে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসটি তৈরি করেছিল। শুধু তাই নয়, এদিনের উদ্দেশ্যটি হলো তামাক সেবনের ক্ষতিকারক অভ্যাস ত্যাগ করতে সহায়তা করাও। এর অর্থ হলো বয়স্ক সমস্ত লোককে সিগারেট, বিড়ি বা তামাকের সাথে জড়িত ধূমপানের অভ্যাস গ্রহণে নিরুৎসাহিত করা। তামাক প্রতিবছর ৮ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু ঘটায়।
প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরও বিশ^ব্যাপী দিবসটি আগামী ৩১ মে উদ্যাপিত হতে যাচ্ছে। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (ডাব্লুএইচও) অনুসারে এ বছরে দিবসটির থীম হলো Tobacco’s Threat to our environment অর্থাৎ তামাক আমাদের পরিবেশের জন্য হুমকি। বাংলাদেশ প্রেক্ষিতে এর ভাবানুবাদ করা হয়েছে ‘তামাকমুক্ত পরিবেশ, সুস্বাস্থ্যের বাংলাদেশ’।
আমরা যখন বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসটির কথা বলি তখন স্বাভাবিকভাবেই এটি বিশ্ব ধূমপানমুক্ত দিবস হিসাবে মনে আসে। আমরা মনে করি যে কীভাবে আমরা লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষকে ধূমপান বন্ধ করতে উৎসাহিত করতে পারি । কারণ তামাক ব্যবহারের প্রধানতম উপায় হলো ধূমপান। ধূমপানের মূল সমস্যা হলো তামাক জ্বালানো তামাক নিজে নয়। যখন একটি সিগারেট জ্বালানো হয়, তখন তামাক জ্বলতে থাকে এবং ধোঁয়া তৈরি করে যাতে উচ্চ স্তরের ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ থাকে যা ধূমপান সম্পর্কিত রোগগুলির প্রাথমিক কারণ। জ্বলন্ত সিগারেট/বিড়ি হতে নিঃসৃত ধোঁয়া অধূমপায়ীর ফুসফুস ক্যান্সার, হার্টের অসুস্থতা এবং হতাশাসহ দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতার কারণ হতে পারে। আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির মতে, ধূমপায়ীদের যখন পরোক্ষ ধূমপানের ধোঁয়া বা পরিবেশগত তামাকের ধোঁয়ায় আক্রান্ত করা হয়, তখন এটিকে অনৈতিক ধূমপান বা নিষ্ক্রিয় ধূমপান বলে।
তামাক ও তামাকজাতদ্রব্য চাষ, বিপণন, ও গ্রহণ এর সর্বস্তরে পরিবেশকে দূষিত করে ফেলে। তামাক চাষের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি নষ্ট হয়। তামাক উৎপাদনে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক সার ও কীটনাষক ব্যবহার করা হয়। অতিরিক্ত সার ও কীটনাষক মাটির স্বাভাবিক সক্ষমতা নষ্ট করে। বৃষ্টির পানিতে সার ও কীটনাষক ধূয়ে নদী বা খালের পানিতে মিশে যারফলে জীববৈচিত্র মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তামাকচাষ ও পরিচর্যায় নিযুক্ত শ্রমিক ও কৃষকদের বিষাক্ত তামাকপাতার সংস্পর্শে বারবার আসার ফলে নানা ধরণের চর্মরোগ তৈরী হয়। বিশেষকরে নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরী হয়। নারী ও শিশুরা তামাকপাতা উত্তোলন ও শুকানোর কাজে নিয়োজিত থাকে। তামাকপাতা শুকানোর কাজে বিশেষকরে তামাকপাতা সাজিয়ে একটানা তাপ বজায় রাখতে হয়। এর জন্য প্রয়োজন বিপুল কাঠ। কৃষকরা এ সময় বিপুল কাঠের জোগান নিশ্চিতে প্রচুর গাছ-পালা কেটে আনে যারফলে পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দেয়। সিগারেট বিড়ি উৎপাদনে প্রচুর পরিমাণে তামাকের গুঁড়া বাতাসের সাথে মিশে বায়ু দূষিত করে। তামাক গাছের গোড়া মাটির সাথে মিশে মাটির স্বাস্থ্যকে নষ্ট করে। সিগারেটের বাট অপচনশীল প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থ দিয়ে তৈরী করা হয়। প্রতিদিন প্রায় ২০ কোটি সিগারেটের বাট মাটি বা পানির সাথে মিশে পরিবেশ দূষণ করে চলেছে।
আইন অনুসারে, "পাবলিক ট্রান্সপোর্ট" অর্থ মোটর গাড়ি, বাস, ট্রেন, ট্রাম, জাহাজ, লঞ্চ, সমস্ত ধরণের যান্ত্রিক গণপরিবহন, বিমান এবং অন্যান্য যে কোনও পরিবহণ সরকারী গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা সরকার কর্তৃক নির্ধারিত বা ঘোষিত হয়। আইনের উপর ভিত্তি করে, এই ধরনের পরিবহনগুলি ধূমপানমুক্ত থাকতে হবে। কিন্তু বাস্তবে, পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ধূমপান চলছে এবং মাঝে মাঝে অসহনীয় হয়ে উঠে। ড্রাইভিং চলাকালীন চালক এবং তাদের সহযোগীরা প্রকাশ্যে সিগারেট খায় যা যাত্রীদের জন্য বিরক্তি সৃষ্টি করে। রাজধানীর গণপরিবহনগুলোতে ধূমপান করা একটি নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাত্রীরা বাসে ধূমপান কম করলেও, চালক ও সহযোগীরা নিয়মিত ধূমপান করে থাকে। গবেষণায় দেখা যায় যে, শতকরা ৬২ ভাগ পরিবহন কর্মীরা এখনও পাবলিক পরিবহনে ধূমপান করে থাকে। বাসে ধূমপান করলে শতকরা ২৯ ভাগ যাত্রীরা প্রতিবাদ করেন। এছাড়া পাবলিক পরিবহনগুলির মধ্যে শতকরা ৬১ ভাগ গাড়িতেই এখন পর্যন্ত ধূমপান বিরোধী স্থায়ী সাইনেজ নেই। (সূত্র: ডাস্ মনিটরিং রিপোর্ট ২০২২, সময়কাল: ডিসেম্বর’২১ হতে ফেব্রুয়ারী’২২)
জনস্বাস্থ্যের স্বার্থেই সংশোধিত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুসরণ করে সব ধরণের পাবলিক প্লেস এবং পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ধূমপান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে দুর্ভাগ্যক্রমে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আইনটি মানা হয়না। কখনও কখনও, যাত্রীদের হাতে সিগারেট জ্বালিয়ে যাত্রী বিশ্রামাগারে গাড়ির জন্য অপেক্ষারত অবস্থায় দেখা যায় যা ধূমপান না করা অন্যান্য যাত্রীদের জন্য অস্বস্তিকর ও ক্ষতিকর। এটি বেশিরভাগ যুবক বা মধ্যবয়সী নাগরিকরা করেন এবং তাদের শিক্ষিতও বলে মনে হয়।
সরকার একদিকে যেমন সর্বজনীন স্থানে তামাক ব্যবহারের বিরুদ্ধে, অন্যদিকে লঙ্ঘনকারীরা তাদের আচরণে আগ্রাসী এবং এভাবে সংশোধিত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সর্বত্র উপেক্ষা করছে। এছাড়াও, যাত্রীরা যখন ড্রাইভার এবং সহযোগীদের ধূমপান বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করেন, তখন তারা যাত্রীদের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়। অনেক সময় প্রতিবাদকারী যাত্রীরা ড্রাইভার এবং তাদের সহযোগীদের দ্বারা হয়রানির শিকার হয়। এসব ধূমপায়ী লোকদের এবং ড্রাইভার ও তাদের সহযোগীদের পরিবহনে ধূমপান থেকে বিরত রাখতে আইন প্রয়োগকারীদের সহায়তা অত্যন্ত জরুরী। অপরাধীদেরকে দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে এসে বিচার করার জন্য সরকারের এনফোর্সমেন্ট বিভাগকে আরও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের ৯ এবং ১৪ ধারায় বলা আছে যে, কর্তৃত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ঘটনা পরিদর্শন সাপেক্ষে লিখিত মামলা করতে পারবে এবং শুধুমাত্র নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জরিমানা করতে পারবে । কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, প্রয়োগের দূর্বলতার কারণে ঠিকমতো আইনটি প্রয়োগই হচ্ছেনা।
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে মোবাইল কোর্টের উপর আরও বেশী গুরুত্বারোপ করা উচিত। প্রতিবছর যে পরিমাণ মোবাইল কোর্ট করা হয় তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই নগণ্য। বিশেষকরে বাস টার্মিনালগুলোতে এ বিষয়ে মোবাইল কোর্ট একদমই হয়না বললেই চলে, এমনকি এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মহলের কোনো প্রকার নজরও নেই বলা যেতে পারে। অথচ প্রতিদিনই অসংখ্য যাত্রীগণ শিকার হচ্ছেন পরোক্ষ ধূমপান দ্বারা, যার ফলে তারা নানাবিধ অসুখে পতিত হচ্ছে। তাই জনস্বাস্থ্য রক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সঠিক বাস্তবায়নে প্রয়োজনে অন্য কোনো বিষয়ের সাথে যুক্ত করে হলেও রাজধানীর বাস টার্মিনাল এবং গণপরিবহনগুলোতে মোবাইল কোর্ট এর পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যাপক জনসচেতনতা ছাড়াও পরিবহন সংস্থা সহ বিআরটিএ, বিআরটিসি, বিআইডব্লিউটিএ এবং পুলিশ বিভাগকে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে। ড্রাইভারও তাদের সহযোগীদের পরিবহন সংস্থার নির্দেশনার পাশাপাশি বিআরটিএ কে পরিবহনের ফিটনেস প্রদানের সময় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রতিপালনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া, বিআরটিসি কে ড্রাইভারদের প্রশিক্ষণকালীন সময়ে ধূমপান বন্ধে উদ্বুদ্ধকরণ সহ বাস ধূমপান রাখতে কঠোর নির্দেশনা প্রদান এবং পুলিশ বিভাগকে আইন লঙ্ঘনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সক্রিয় হওয়া জরুরী।
গ্যাটস সার্ভে ২০১৭ অনুসারে, বাংলাদেশে এখনও পরোক্ষ ধূমপানের শিকার ৩৯% মানুষ এরমধ্যে অধিকাংশই শিকার হয় পাবলিক প্লেসে। বিশেষকরে মানুষ যখন যাতায়াতের জন্য বাসÑলঞ্চ ব্যবহার করে এবং টার্মিনালগুলোতে যখন সবাই অবস্থান করে, ডাস্ পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, টার্মিনালের শতকরা ৬৮ ভাগ দোকানেই তামাকজাত পণ্য বিক্রি করা হয় যারমধ্যে একটি দোকানেরও তামাকপণ্য বিক্রয়ের কোনো প্রকার লাইসেন্স নেই। এছাড়া শতকরা ৬৩ ভাগ দোকানে তামাকের বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হচ্ছে (সূত্র: ডাস্ মনিটরিং রিপোর্ট ২০২২, সময়কাল: সেপ্টেম্বর’২১ হতে নভেম্বর’২১)। টার্মিনালগুলোর সার্বিক পরিবেশ উন্নয়ন ও পরিবেশবান্ধব টার্মিনাল গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। টার্মিনালগুলোয় যত্রতত্র থুতু ও কফ ফেলা, পানের পিক ফেলা খুবই সাধারণ বিষয় এবং তামাকজাত দ্রব্য এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে টার্মিনালের পরিবেশ উন্নয়ন করা সম্ভব হবে। সেক্ষেত্রে টার্মিনালের নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ, সিটি কর্পোরেশন, ইজারাদার, বাস-মালিক কর্তৃপক্ষ, শ্রমিক ইউনিয়ন একসাথে সমবেতভাবে কাজ করতে হবে। এর পাশাপাশি টার্মিনালগুলোতে বিক্রয় নিয়ন্ত্রণের জন্য পয়েন্ট অব সেল কমাতে হবে। মোবাইল ভেন্ডরদের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে। তামাক বিক্রয়ে আলাদা বিক্রয় লাইসেন্স আরোপ করতে হবে। টার্মিনালগুলোর পরিবেশ উন্নয়নে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে হবে। নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য বিআরটিএ ও বিআইডাব্লিউটিএ -এর এনফোর্সমেন্ট শাখাগুলোকে কাজে লাগাতে হবে এবং ট্রাফিক সার্জেন্টদেরকে জরিমানা আরোপের ক্ষমতা প্রদান করতে হবে।
আমরা মনে করি যে, বিআরটিএ, বিআরটিসি, বিআইডব্লিউটিএ সহ অন্যন্য সহযোগী প্রত্যেকটি সংস্থা যদি তাদের নিজনিজ ক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্য রক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সঠিক বাস্তবায়নে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদারকরন এবং সে অনুযায়ী যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে তবে আমরা খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে গণপরিবহন সেক্টরটিকে ধূমপানমুক্ত করতে পারবো বলে বিশ^াস করি।



 

Show all comments
  • মোয়াজ্জেম হোসেন টিপু ৩১ মে, ২০২২, ৩:১৫ পিএম says : 0
    উপরোক্ত আর্টিকেলটি ডাস্ এর উপদেষ্টা জনাব আমিনুল ইসলাম বকুলের লেখা। তাই দয়া করে সংশোধন করে লেখকের নামে আর্টিকেলটি প্রকাশ করার জন্য অনুরোধ করা হলো। বিনীত মোয়াজ্জেম ,ডাস্।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ