বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
মিথ্যার কিছু রূপের আলোচনা করতে গিয়ে গত আলোচনায় কিছু রূপের কথা বলা হয়েছিল। আজ আরো কয়েকটি ব্যাপারে আলোচনা করার চেষ্টা করা হলো।
গণমাধ্যমে মিথ্যা। গণমাধ্যমে বস্তুনিষ্ঠ ও সৎ সাংবাদিকতা দেশ ও জাতির তথা বিশ্ব মানব কল্যাণে যথেষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম। আবার মিথ্যা, অবাস্তব ও বানোয়াট সংবাদ প্রচারের কারণে অশান্তি ও অস্থীতিশীলতাও তৈরি হয়। এখানে যে মিথ্যা প্রচার করা হয় তা সারা দেশে, সারা বিশ্বে প্রচারিত হয়ে যায় এবং এর কারণে নানা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। ফলে এমন ক্ষেত্রে মিথ্যা প্রচারের শাস্তি অনেক ভয়াবহ।
মেরাজের রাতে রাসূল (সা.)-কে বিভিন্ন অপরাধীদের শাস্তি দেখানো হলো। তার মধ্যে ছিলÑ এক লোক বসা, পাশে আরেকজন দাঁড়ানো। তার হাতে লোহার পেরেক। লোহার পেরেক দিয়ে এই লোক পাশের লোকটির চোয়ালে আঘাত করে এবং পেরেকটি তার চোয়ালে ঢুকিয়ে ঘাড় পর্যন্ত নিয়ে যায়। তারপর একইভাবে অপর চোয়ালে আঘাত করে। ততক্ষণে আগের চোয়াল স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে এবং সে আবার আঘাত করতে থাকে। জিজ্ঞাসা করা হলো, এরা কারা? বলা হলো, সামনে চলো। (এভাবে অন্যান্য অপরাধীদের শাস্তিও দেখানো হলো। পরিশেষে যখন একে একে সবার শাস্তির কারণ জানানো হলো, তখন বলা হলÑ
আঘাত করে করে যার চোয়াল বিদীর্ণ করে ফেলতে দেখেছেন, সে ছিল মিথ্যাবাদী। মিথ্যা বলত (এবং তা প্রচার করত) ফলে তার বলা মিথ্যা প্রচার হতে হতে দিগদিগন্তে ছড়িয়ে পড়ত। কাজেই কিয়ামত পর্যন্ত তার সাথে এমনটি করা হতে থাকবে, এভাবেই তাকে শাস্তি দেয়া হবে। (সহীহ বুখারী : ১৩৮৬)।
সাক্ষ্য প্রদানে মিথ্যা : ইসলামে সত্য সাক্ষ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। এর মাধ্যমে মানুষের হক ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে সামান্য হেরফেরের মাধ্যমেও অন্যের ওপর বড় ধরনের জুলুম হয়ে যেতে পারে। অনেক সময় অন্যের সম্পদ আত্মসাতের মতো ভয়াবহ গোনাহও সংঘটিত হয়ে যায় এই মিথ্যা সাক্ষ্যের কারণে।
তাই ইসলাম সত্য সাক্ষ্যের প্রতি উৎসাহিত করেছে। একান্ত ওজর না থাকলে সাক্ষ্যদান থেকে বিরত থাকতেও নিষেধ করেছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে : তোমরা সাক্ষ্য গোপন করো না। যে তা গোপন করে, অবশ্যই তার অন্তর পাপী। (সূরা বাকারা : ২৮৩)।
বিপরীতে মিথ্যা সাক্ষ্যের ব্যাপারে রয়েছে কঠিন হুমকি-বাণী। সব থেকে বড় গোনাহগুলোর মধ্যে রাখা হয়েছে এই মিথ্যা সাক্ষ্যকে। হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বড় (কবীরা) গোনাহগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া।’ (সহীহ বুখারী : ২৬৫৩)।
মিথ্যা সাক্ষ্য অনেক বড় গোনাহ। এর মাধ্যমে অনেক সময় নিরপরাধ মানুষ নির্যাতিত এবং নিপীড়িত হয়। হতে হয় মিথ্যা হয়রানির শিকার। অনুরূপ মিথ্যা শপথের ব্যাপারেও হাদীসে কঠিন ধমকি এসেছে : ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের সম্পদ আত্মসাৎ করার জন্য বিচারকের সামনে মিথ্যা শপথ করবে, কিয়ামতের দিন সে আল্লাহর সাথে এই অবস্থায় সাক্ষাৎ করবে যে, তিনি তার উপর খুবই অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত থাকবেন।’ (সহীহ বুখারী : ৪২৭৫)।
অন্য হাদীসে ইরশাদ হয়েছেÑ ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কসম খেয়ে কোনো মুসলমানের হক বিনষ্ট করল, আল্লাহ তাআলা তার জন্য জাহান্নাম অবধারিত করে দেবেন এবং জান্নাত তার ওপর হারাম করে দেবেন। একজন সাহাবী জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সেটা যদি কোনো সামান্য জিনিসও হয়? (অর্থাৎ কেউ যদি কারো সামান্য ও তুচ্ছ জিনিসও কসম খেয়ে আত্মসাৎ করে, তারও কি এই পরিণতি হবে?) উত্তরে নবীজী বললেন : হ্যাঁ, যদি সেটা পিলু বৃক্ষের একটি ডালও হয়। (সহীহ মুসলিম : ১৩৭)।
এছাড়াও ব্যবসার ক্ষেত্রে মিথ্যা বলা, কাউকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া, বাচ্চাকে খেলার ছলে মিথ্যা বলাও মিথ্যার কিছু রূপ। এসমস্ত বিষয়গুলোও আমাদের খেয়াল রাখা উচিত।
সত্যবাদিতা একটি মহৎ গুণ। ভালো স্বভাবগুলোর উৎস। মিথ্যা একটি সর্বজনবিদিত অপরাধ। যা কেবল ব্যক্তির পরকালকেই বরবাদ করে না, তার ব্যক্তিত্বকেও ধ্বংস করে। মানুষের আস্থা, ভালোবাসা, আন্তরিকতার জায়গাটা তখন আহত হয়। ডেকে আনে ক্ষতি আর ক্ষতি। ক্ষেত্রবিশেষে মিথ্যাকে নগদ লাভ মনে হলেও এর রয়েছে কঠিন পরিণতি। আসুন, সত্য গ্রহণ করি। মিথ্যা বর্জন করি। সত্যের সাথে থাকি, মিথ্যা পরিহার করি। আল্লাহ তাআলাই তাওফীকদাতা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।