বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
মেহেরবান আল্লাহ আমাদের দুটি ঈদ দান করেছেন। ঈদ হলো খুশির দিন, আনন্দের মৌসুম। ঈদে আমরা খুশি ও আনন্দ প্রকাশ করব এবং দরিদ্র ও অসহায়দের সুখ ও আনন্দদানের চেষ্টা করব। তবে স্মরণ রাখতে হবে, মুসলিমের আনন্দ-উদযাপন আর অমুসলিমের আনন্দ-উদযাপন এক হতে পারে না। মুমিনের আনন্দ-উদযাপন হয় আল্লাহর পছন্দনীয় আমলের মাধ্যমে আর অমুসলিমের আনন্দ-উদযাপন হয় তাঁর নাফরমানির মাধ্যমে। মুসলিমের জীবন ও চিন্তা আখেরাতকেন্দ্রিক আর কাফেরের সবকিছু দুনিয়াকেন্দ্রিক। আল্লাহ তাআলা বলেন : তারা (অর্থাৎ কাফেরগণ) পার্থিব জীবনেই উল্লসিত, অথচ আখেরাতের তুলনায় পার্থিব জীবন তো মামুলি ভোগমাত্র। (সূরা রা‘দ : ২৬)।
আল্লাহ তাআলা মুমিনদের উদ্দেশে বলেন : (হে নবী!) বলুন, এসব আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর রহমতেই হয়েছে। সুতরাং এতেই তাদের আনন্দিত হওয়া উচিত। তারা যা-কিছু পুঞ্জীভূত করে, তা অপেক্ষা এটা শ্রেয়! (সূরা ইউনুস : ৫৮)।
আনাস রা. বলেন, নবীজী (সা.) যখন মদীনায় আগমন করেন তখন দেখেন, মদীনাবাসী বছরে দুই দিন উৎসব করে। নবী কারীম (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা এই দুই দিন আনন্দ-ফুর্তি কর কেন? তারা বলল, জাহেলি যুগে এ দুইটি দিন আমরা উৎসব-আনন্দ করতাম। নবী কারীম (সা.) বললেন : আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে এ দুই দিনের বদলে উত্তম দুটি দিন দান করেছেন। ঈদুল আযহা ও ঈদুর ফিতর। (সুনানে আবু দাউদ : ১১৩৪)।
হাদীসটি থেকে স্পষ্ট যে, অমুসলিমদের পর্ব-উৎসব বর্জন করার জন্যই আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দুটি ঈদ দান করেছেন। সুতরাং আমরা আমাদের ঈদ উদযাপন করব, অমুসলিমদের পর্ব-উৎসব থেকে বিরত থাকব। সাথে সাথে আমাদের ঈদ যেন অমুসলিমদের পর্ব-উৎসবের মতো নিছক পার্থিব আমোদ-প্রমোদের ক্ষেত্র না হয়, সেদিকেও খুব খেয়াল রাখব। হাসান বসরী রাহ.-এর বক্তব্য অনুযায়ী আমাদের ঈদ তো হলো : ঈদুল ফিতর হলো, ঈদের নামাজ পড়া ও সদাকাতুল ফিতর আদায় করা এবং ঈদুল আযহা হচ্ছে ঈদের নামাজ পড়া ও কুরবানী করা। (ফাযাইলুল আওকাত, বায়হাকী, পৃ. ৩০৩-৩০৪ (১৪৪)।
এই হলো ঈদের হাকীকত। পুরো এক মাস রোজা রাখা ও তারাবী পড়ার পর ঈদের দিন আল্লাহ রোজাদারদেরকে তাদের মেহনতের সওয়াব ও পুরস্কার দান করবেন। জাহান্নামীদের তালিকা থেকে তাদের নাম মুছে দেবেন। তাই রোজাদাররা খুশি হয়ে শুকরিয়া স্বরূপ দান-সদকা করবে এবং ঈদের নামাজ আদায় করবে।
মোটকথা, মুমিনের সুখ-শান্তি ও হাসি-আনন্দ হলো দ্বীন ও আখেরাতকেন্দ্রিক। সুতরাং মুমিনের ঈদ ও আনন্দ অমুসলিমের উৎসব-বিনোদনের, আমোদ-ফুর্তির মতো হবে না। মুমিন তার ঈদ উদযাপনে আল্লাহর নাম ভুলবে না, শরীয়তের সীমা অতিক্রম করবে না এবং বিজাতির উৎসব ও আমোদ-প্রমোদের অনুসরণ করবে না, গুনাহে লিপ্ত হবে না। মুসলিম অন্যান্য সকল বিষয়ে যেমন নবীজীর সুন্নাহর অনুসরণ করে এবং সালাফে সালেহীন তথা মহান পূর্বসূরিদের আদর্শের অনুসরণ করে, ঈদের আনন্দ উদ্যাপনেও তাদেরই অনুকরণ করবে।
মুমিন ঈদের দিন আল্লাহর নিআমতের ওপর খুশি প্রকাশ করবে এবং মাগফিরাত লাভের আনন্দে আনন্দিত হবে। আল্লাহপ্রদত্ত এ খুশির দিনকে বৈধ বিনোদনের মাধ্যমে উদযাপন করবে। কিন্তু এতে সে দ্বীন-শরীয়ত পাশ কাটিয়ে উন্মাদ হয়ে পড়বে না, আল্লাহর নাফরমানিতে লিপ্ত হবে না। এমনই ছিল সালাফে সালেহীনের ঈদ।
তাদের দৃষ্টিতে ক্ষমা ও পুরস্কার লাভই ঈদের আসল আনন্দ। জানি না, আমাদের মধ্যে কে পুরস্কৃত, তাকে আমরা শাবাশি দিতাম! আর কে বঞ্চিত, তার জন্য আমরা শোক প্রকাশ করতাম! হে পুরস্কৃত! তোমাকে অভিনন্দন। হে বঞ্চিত! আল্লাহ তোমার ক্ষতিপূরণ করুন। (লাতাইফুল মাআরিফ : পৃ. ২৩৫)। এর চেয়ে সত্য ও বাস্তব কথা আর কী হতে পারে?
ইবনুল জাওযী রাহ. বলেন : বন্ধুগণ! জমকালো জামা পরা, যা অহঙ্কার সৃষ্টি করে এবং আড়ম্বরপূর্ণ খাবার খাওয়া, যার অনিষ্ট থেকে বাঁচা যাবে না- এর নাম ঈদ নয়; ঈদ হলো আল্লাহভোলা কলব তাওবার জামা পরিধান করা, যা অদৃশ্যের (আল্লাহর) সঙ্গে মিলনের আনন্দে আন্দোলিত থাকে। (আততাবসিরাহ : ২/১১৪)।
বাস্তব কথা হলো, আমাদের পূর্বসূরিগণ এভাবেই মুহাসাবা ও আত্মসমালোচনার দৃষ্টিতে নিজের দিকে তাকাতেন। মুহাসাবা বিহীন নিছক আনন্দে গা ভাসিয়ে দেওয়া, আরো আফসোসের বিষয় হলো, গুনাহের মাধ্যমে আনন্দ উদযাপন করা কখনই মুমিনের শান নয়। ঈদ মানে খুশি। ঈদ মানে আনন্দ। কিন্তু কার জন্য? কী জন্য? এগুলো নিয়েও আত্মবিশ্লেষণ করা দরকার। পাশাপাশি এ-ও চিন্তা করা দরকার, এ আনন্দ কীভাবে উদযাপন করব?
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।