বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
প্রতিবারের ন্যায় পবিত্র মাহে রমজান আমাদের মাঝে আবার ফিরে এসেছে। মাহে রমজানুল মোবারক আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অফুরন্ত রহমত নিয়ে আমাদের কাছে আসে; শ্রাবণের বৃষ্টিধারার মতো বর্ষিত হতে থাকে সেই রহমত। এই মোবারক মাসে মানুষ নিজের পাশবিকতা দমন করে ত্যাগের শক্তি সঞ্চয় করতে পারে। আর এটিই মূলত তাকওয়ার ভিত্তি। আল্লাহ তায়ালা এই মাসের নাম নিজের একটি সিফাতি নামের সাথে মিল রেখে নামকরণ করেছেন। এটা থেকেও এই মাসের মর্যাদা উপলব্ধি করা যায়।
রোজার ইতিহাস দীর্ঘতর। আগেকার উম্মতরাও যে রোজা পালন করতেন এবং তাদের ওপরও যে রোজা ফরজ ছিল, তা কোরআনুল কারীমের নিন্মোক্ত আয়াত দ্বারা উপলব্ধি করা যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন- রোজা ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা পরহেজগার তথা খোদাভীরু হতে পার।’ (সূরা বাকারা : ১৮৩)।
রুহুল মা’আনী, আল বিদায়া ও আইনী প্রভৃতি তাফসিরগ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘আল্লাযিনা মিন ক্বাবলিকুম’ তথা ‘তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর’ বলে বুঝানো হচ্ছে, হযরত আদম আ. থেকে রাসূল সা. পর্যন্ত সকল যুগের মানুষ, তথা সকল নবীর শরীয়তের রোজা পালনের বাধ্যবাধকতা ছিল নামাজের মতোই। হযরত আদম আ.-এর যুগে প্রতি মাসে তিনটি রোজা রাখার বিধান ছিল। হযরত দাউদ আ. একদিন পর একদিন রোজা রাখতেন। হযরত মারইয়াম আ. এর ব্যাপারে কোরআন মাজীদে আছে, ‘আপনি বলুন, আমি আল্লাহর জন্যে রোজা পালন করছি, আজ আমি কারো সাথে কথা বলব না। (সূরা মারইয়াম : ২৬)।
তাফসীরে হক্কানীতে তওরাত তথা বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে যে, ইহুদীদের ওপর সপ্তম মাসের ১০ তারিখে কাফফারার রোজা রাখা ওয়াজিব ছিল। প্রাচীন খ্রিস্টানরাও সেই রোজা রাখত বলে প্রকাশ আছে। হযরত মুসা আ. তুর পর্বতে ৪০ দিন রোজা রেখেছেন। হযরত দানিয়াল আ. একাধারে তিন সপ্তাহ রোজা পালন করেছেন। বাইবেল হতে প্রতীয়মান হয়, ইহুদী-খ্রিস্টানরা এছাড়া আরো রোজা রাখত। বর্তমান যুগেও তাদের ধর্মপরায়ণ লোকেরা বছরের বিভিন্ন সময়ে রোজা পালন করে আসছে।
পূর্বেকার শরীয়তসমূহে রমজান মাসের ৩০টি রোজা ফরজ ছিল কি না এ প্রশ্নের উত্তরে মুফাসসির ও ঐতিহাসিকদের ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। কেউ বলেন, খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ওপর রমজান মাসের রোজা ফরজ ছিল। কিন্তু খ্রিস্টানরা তাতে দু’ধরনের পরিবর্তন ঘটায়। প্রথমত: কষ্টের ভয়ে তারা গ্রীষ্মের পরিবর্তে শরৎকালে রোজা রাখত। দ্বিতীয়ত: এই ত্রুটি পূরণের জন্যে ত্রিশের অধিক রোজা রাখত। তবে অন্যরা বলেন, রোজা শুধুমাত্র উম্মতে মুহাম্মদীর জন্যই ফরজ করা হয়েছে।
ইসলামী শরীয়তের রোজা ফরজ হওয়া সম্পর্কে হাফেজ ইবনে হাজার রহ. বলেন, রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পূর্বে মুসলমানদের ওপর ১০ মুহাররমের রোজা ফরজ ছিল। অতঃপর রমজানের রোজার হুকুম নাজিল হলে উক্ত রোজার বাধ্যবাধকতা রহিত হয়ে যায়।
আল্লামা ইবনে কাসির রহ. স্বীয় তাফসীরগ্রন্থে মুসনাদে আহমদ থেকে হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রা.-এর একটি দীর্ঘ বর্ণনা উল্লেখ করেছেন। এই রেওয়াতে বলা হয়েছে, ইসলামের শুরুতে রোজা তিনটি স্তর অতিক্রম করে। এক. রাসূল হিজরত করে মদীনায় গমন করলে তিনি প্রতিমাসে তিনটি করে রোজা রাখতেন। তার সাথে আশুরার রোজাও পালন করতেন।
অতঃপর রমজান মাসের রোজা ফরজ হয়। দুই. রমজান মাসের রোজার হুকুম এলে প্রথম দিকে মুসলমানদের এখতিয়ার দেয়া হয় যে, যার ইচ্ছা রাখবে এবং যার ইচ্ছা ফিদিয়া দিবে। তারপর আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা রমজান মাসকে পায়, তারা অবশ্যই রোজা রাখবে।’ (সূরা বাকারা : ১৮৫)। এই আদেশের ফলে মুসাফির ও পীড়িত নয়, এমন প্রত্যেক নর-নারীর ওপর রোজা পালন আবশ্যকীয় হয়ে পড়ে।
তবে যারা চরম বার্ধক্যে উপনীত, তাদেরকে প্রতি রোজার পরিবর্তে ফিদিয়া দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে। তিন. ইতোপূর্বে রাতে শোয়ার পূর্ব পর্যন্ত খাওয়া-দাওয়া ও স্ত্রী সহবাসের অনুমতি ছিল। শুয়ে পড়লে এ সকল ধরনের কাজ নিষিদ্ধ ছিল। অতঃপর কোরআনের অপর আয়াত মতে সুবহে সাদিকের পূর্ব পর্যন্ত এসব কাজের অনুমতি দেয়া হয় এবং সুবহে সাদিকের পর হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজা পালনের আদেশ আসে।
রোজা কোন মাসে ফরজ হয়েছিল, এই সম্পর্কে আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থে বলেন, হিজরী দ্বিতীয় সনে শাবান মাসে বদর যুদ্ধের আগে রমজানের রোজা ফরজ করা হয়। বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা ইউসুফ বাননুরী রহ. বলেন, হিজরি দ্বিতীয় সনের ১০ শাবান রোজা ফরজ করা হয় এবং উক্ত সনেই কেবলা পরিবর্তনসহ যাকাত-ফিতরার হুকুম অবতীর্ণ হয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।