Inqilab Logo

রোববার, ০৭ জুলাই ২০২৪, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১, ৩০ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

বাংলা সন নিয়েও বিভাজনের রাজনীতি হিন্দুত্ববাদীদের

অনলাইন ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১৪ এপ্রিল, ২০২২, ১:৪২ পিএম

মুঘল বাদশাহ আকবর নন, বরং গৌড়ের প্রাচীন হিন্দু রাজা শশাঙ্কই যে বাংলা সন বা 'বঙ্গাব্দ' প্রবর্তন করেছিলেন, সেই মর্মে পশ্চিমবঙ্গে জোরালো প্রচার ও 'সচেতনতা অভিযান' শুরু করেছে আরএসএস ও তাদের অনুসারী সংগঠনগুলো।

ভারতে এবার বাংলা নববর্ষ পালিত হচ্ছে শুক্রবার, ১৫ এপ্রিল। সেই বাংলা সনের সূত্রপাত যে একজন হিন্দু রাজার হাত ধরে, সেই বক্তব্য নিয়েই জেলায় জেলায় প্রচার শুরু করছে আরএসএস প্রভাবিত 'বঙ্গীয় সনাতনী সংস্কৃতি পরিষদ'। কলকাতায় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাংস্কৃতিক শাখা আইসিসিআর-এর যে সেন্টারটি রয়েছে, তার মিলনায়তনে এই উপলক্ষে নববর্ষের দিন একটি প্রদর্শনীরও আয়োজন করেছ ওই সংগঠনটি।

কিন্তু কেন হঠাৎ রাজা শশাঙ্ককেই বঙ্গাব্দ'র প্রবর্তক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার এই উদ্যোগ? পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা আরএসএসের তাত্ত্বিক নেতা ও পরিচিত মুখ জিষ্ণু বসু বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, "একটা ধারণা প্রচলিত আছে যে আকবরই বাংলা সাল গণনার রীতি শুরু করেছিলেন।" "কিন্তু বিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদদের আধুনিক গবেষণা দেখিয়ে দিচ্ছে যে নানা কারণে আকবরের পক্ষে বঙ্গাব্দ চালু করা সম্ভবই নয়।"

তিনি বলেন, "আবুল ফজলের প্রশাসনিক আকরগ্রন্থ আইন-ই-আকবরীতেও বহু সালতামামি আছে, কিন্তু সেখানেও বঙ্গাব্দের কোনও উল্লেখই নেই।" "আকবরের জীবদ্দশায় তিনি বাংলার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কখনোই পাননি, ১৫৭৬-য়ে রাজমহলের যুদ্ধ জিতে মুঘলরা প্রথম বাংলা দখল করলেও তারপরও বহু বছর ধরে যুদ্ধ চলেছিল।" "আর বেছে বেছে সেই অস্থির বাংলাতেই আকবর একটা নতুন সাল চালু করবেন, সেটা খুব অস্বাভাবিক", বলছিলেন ড. বসু।

বঙ্গাব্দ'র প্রবর্তক হিসেবে হিন্দুত্ববাদীরা বেশ অনকেদিন ধরেই গৌড়ের প্রাচীন রাজা শশাঙ্ককে তুলে ধরতে চেষ্টা করছেন, যার রাজধানী ছিল এখনকার মালদা শহরের কাছে কর্ণসুবর্ণতে। ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষ দিকে শশাঙ্ক ছিলেন গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীনে একজন সামন্ত রাজা। তবে পরে তিনি স্বাধীন ও সার্বভৌম গৌড়ভূমির শাসক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

রাজা শশাঙ্ক মারা গিয়েছিলেন ৬৩৭ বা ৬৩৮ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ। এর মোটামুটি ৪৫ বছর আগে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন এবং তখন থেকেই (৫৯৩ খ্রিস্টাব্দ) বঙ্গাব্দ চালু করা হয় - এটা ধরে নিলে ওই তত্ত্বটা অনেকটা মিলে যায়। কারণ বঙ্গাব্দর সঙ্গে খ্রিস্টীয় অব্দের ব্যবধানও ঠিক ৫৯৩ বছরের। এই মুহুর্তে যেমন ১৪২৯ বাংলা সাল শুরু হচ্ছে, আর সেটা ইংরেজি বা খ্রিস্টীয় ২০২২ সাল - ফলে গণনার ব্যবধানটা ৫৯৩ বছরের।

তবে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও গবেষক অমর্ত্য সেন তার একাধিক নিবন্ধ, বক্তৃতা ও গ্রন্থে মুঘল সম্রাট আকবরকেই বঙ্গাব্দ'র প্রবর্তক হিসেবে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করেছেন। ষাটের দশকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা বর্ষপঞ্জী সংস্কারের জন্য ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্-কে সভাপতি করে সরকার যে কমিটি গঠন করেছিল, তাদেরও স্পষ্ট রায় ছিল সম্রাট আকবর খ্রিস্টীয় ১৫৮৫ সালে বঙ্গাব্দের সূচনা করেন।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক ইসলামের বিশেষজ্ঞ কিংশুক চ্যাটার্জির পরিষ্কার জবাব, "শশাঙ্কর আমলে তো বাংলা ভাষাটাই চালু হয়নি। কাজেই তিনি বাংলার জন্য আলাদা অব্দ বা সাল চালু করেছিলেন এটা ভাবাটা বেশ বাড়াবাড়ি।" "বরং ইতিহাসে আমাদের বলে, মুঘল বাদশাহ আকবর বাংলা জয় করার পর এখানে একটি প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিলেন।

"তারা যখন দেখলেন বাংলা থেকে খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য একটা ক্যালেন্ডার দরকার, আর সেটাকে হিন্দু শকাব্দর সঙ্গে সংযুক্ত না করে বরং মুসলিম হিজরীর সঙ্গে কানেক্ট করেই ক্যালিব্রেট করা যাক। "খুব সম্ভবত সেভাবেই আকবরের দূতরা বঙ্গাব্দ চালু করে গিয়েছিলেন", বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন কিংশুক চ্যাটার্জি।

বাংলায় মুঘল যুগের ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ, প্রবীণ ইতিহাসবিদ অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য এক্ষেত্রে একটু ভিন্নমত পোষণ করেন। বিবিসিকে তিনি বলছিলেন, "আসলে ফসল তোলার ভিত্তিতে সাল গোনার যে রেওয়াজ, যাকে 'ফসলি' বলা হয়, সেটা কিন্তু ভারতের প্রায় সর্বত্রই চালু ছিল, বাংলাও তার ব্যতিক্রম নয়।"

"এই ফসলী-কেই আকবর বাংলায় একটু অদল-বদল করে হয়তো 'রেগুলারাইজ' করেছিলেন - সেই কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে তার। কিন্তু বঙ্গাব্দর প্রবর্তক আকবর, এটা বলা কতটা সমীচীন হবে আমি ঠিক নিশ্চিত নই। "আসলে সাল গণনার ইতিহাস একটা জিনিস, তার বাস্তবায়ন অন্য জিনিস। আকবরের আমলের বহু আগে থেকেই বাংলা সাল গুনতো নিজের মতো করে, তখন হয়তো পদ্ধতিটা বদলেছে", বলছিলেন অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

সম্রাট আকবরকে বাংলা 'সন' বা বঙ্গাব্দর উদ্ভাবক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অবশ্য কোনও দ্বিধাই নেই অমর্ত্য সেনের। 'দ্য আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান' বইতেও সে কথা পরিষ্কার লিখেছেনও তিনি। বছর তিনেক আগে কলকাতার ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে একটি স্মারক বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, "বাংলা 'সনে'র একটি বিশেষত্ব হল - আকবর সারা ভারত জুড়ে বহু-ধর্মে গ্রাহ্য যে ক্যালেন্ডার 'তারিখ-ইলাহী' চালু করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন, সেটার প্রভাব কিন্তু আজও টিঁকে আছে শুধু এই বঙ্গাব্দেই।"

ওই বক্তৃতায় তিনি আরও বলেন, "আকবরের আমলে যখন মুসলিম ক্যালেন্ডার বা হিজরীর প্রথম সহস্রাব্দ শেষ হয়ে আসছে - তিনি তার রাজত্বে একটি বহু-সংস্কৃতির ক্যালেন্ডার চালু করার প্রয়োজন অনুভব করেন। এটাই ছিল তারিখ-ইলাহী। "এই ক্যালেন্ডার হিন্দু সূর্যসিদ্ধান্ত রীতি অনুসরণ করত, আবার মুসলিম হিজরীর বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যও এতে সংযোজিত হয়েছিল - যেমন হিজরীর চান্দ্র ইতিহাস।"

মজার ব্যাপার হল, আকবরের দরবার ছিল যেখানে সেই দিল্লি-আগ্রাতেও কিন্তু তারিখ-ইলাহী গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। অথচ সেই ক্যালেন্ডারের একটি 'অফশুট' (শাখা) পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে আজও সগৌরবে টিঁকে আছে - যার নাম বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন। সূত্র: বিবিসি।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ