হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
আবদুল আউয়াল ঠাকুর : সাবেক প্রধান বিচারপতি ব্যারিস্টার মোস্তফা কামাল সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদকে বিস্ময়কর প্রতিভা হিসেবে উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘স্বদেশি আন্দোলন, পাকিস্তান আন্দোলন, বাঙালিদের স্বাধিকার আন্দোলন- এদেশের অর্ধ শতাব্দীব্যাপী তাবৎ রাজনৈতিক আন্দোলনে তার ভূমিকা কখনো সক্রিয় কর্মীর, কখনো নেতার, কখনো পরামর্শদাতার। এই স্বনামখ্যাত সাংবাদিক ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে তার ‘সংবাদপত্রকে সাংবিধানিক অধিকার ফিরাইয়া দাও’ শীর্ষক উপ-সম্পাদকীয় কলামে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে সংবাদপত্রের অবস্থা আলোচনা করিতে হইলে দুই দিক হইতে বিচার করিতে হয়। এক. যা হইয়াছে, দুই. যা হওয়া উচিত। যা হইয়াছে অবস্থাটার আবার দুই রূপ। এক সাংবিধানিক ও আইনগত, দুই বাস্তব রূপ।’ তিনি লিখেছেন, ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতা মানেই সংবাদপত্রের মালিকানারও স্বাধীনতা, তথাপি তর্কচ্ছলে ধরা যাইতে পারে এটা সংবাদপত্রের মতামতের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা। এ ছাড়াও সংবাদপত্রের মালিকানা সম্পর্কে সংবিধানের অন্যত্র সুস্পষ্ট বিধান রহিয়াছে।’ ওই লেখায় তিনি সে সময়ের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। সে গণতন্ত্রও কোনো বিশেষণমুক্ত নয়। নির্ভেজাল নিরঙ্কুশ পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র। পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রে যেমন অপজিশন পার্টি সরকারের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ স্বাধীন সংবাদপত্রও তেমনি রাষ্ট্রের শাসন বিভাগ আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের মতোই একটি অপরিহার্য বিভাগ। রাষ্ট্রের ওই তিনটি খুঁটির মতোই স্বাধীন সংবাদপত্র তার চার নম্বর খুঁটি। এই তিনটি খুঁটির একটির অভাবে যেমন রাষ্ট্র চলিতে পারে না, সংবাদপত্র ছাড়াও তেমনি রাষ্ট্র চলিতে পারে না। আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা যেমনি অপরিহার্য, সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও ঠিক সেই পরিমাণে অপরিহার্য। এটা কোনো নীতি কথা বা ধর্ম বিশ্বাস নয়। বাস্তব কঠোর সত্য। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের স্বাধীনতা আমাদের দেহ রক্ষার জন্য যেমন অত্যাবশ্যক রাষ্ট্র-দেহ রক্ষার জন্যও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ঠিক ততখানি অ্যাবশ্যক। নাগরিকের সত্য স্বাধীনতাই রাষ্ট্রের স্বাধীনতা। নাগরিকের স্বাধীনতা নির্ভর করে সত্য ও নির্ভুল সংবাদ সরবরাহের ওপর। কারণ নির্ভুল ও সত্য সংবাদের ওপর নির্ভর করে নাগরিকদের মতামতের নির্ভুলতা। নাগরিকের নির্ভুল মতামতের ওপর নির্ভর করে সরকারি পলিসি ও প্রোগ্রামের নির্ভুলতা। গণতান্ত্রিক সরকার শুধু এভাবেই ঠিক পথে চলিতে পারে। এখন বুনিয়াদি প্রয়োজন যে সত্য ও নির্ভুল সংবাদ পরিবেশন, সেটা করতে পারে একমাত্র স্বাধীন সংবাদপত্র। সংবাদপত্রের এ স্বাধীনতার মানে শুধু স্বাধীনভাবে সংবাদ সরবরাহ নয়, পাঠকের কাছে সে সংবাদের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করাও সংবাদপত্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য। সংবাদপত্র শুধু সংবাদ প্রচারই করে না সংবাদ আবিষ্কারও করে। সংবাদপত্র শুধু জনমত প্রচারই করে না, জনমত তৈরিও করে। এত বড় মহান দায়িত্ব পালন করিতে পারিলে সংবাদপত্রকে জনগণের আস্থা ভাজন হইতে হয়। এইজন্য সংবাদপত্র শুধু সত্য সংবাদ প্রকাশ করিলেই হয় না, সংবাদপত্র যে সত্য সংবাদই প্রকাশ করিয়াছে, পাঠক ও জনসাধারণের সেটা বিশ্বাসও করিতে হয়। সংবাদপত্রের প্রতি পাঠক ও জনসাধারণ একবার আস্থা হারাইয়া ফেললে তার দ্বারা দেশের ও সরকারের কোনো কাজ হয় না। জনগণ ও সংবাদপত্রের মধ্যে এই অনাস্থার দূরত্ব ‘ক্রেডিবিলিটির গ্যাপ’ সৃষ্টি হইয়া গেলে তেমন সংবাদপত্র থাকা না থাকা সমান হইয়া যায়।’ এ প্রসঙ্গে তিনি আরও লিখেছেন, ‘আজকালের ডিক্টেটররা মনে করেন সাংবাদিকরা টাকার কাঙ্গাল। তাদের টাকা দিয়া যা ইচ্ছা তাই বলান ও লেখান যায়’।... ‘তারা জানে না যে সাংবাদিকদের তারা যতটা নির্বোধ স্তাবক মনে করেন। সাংবাদিকদের মেজরিটি আসলে তা নয়।’
চার দশকেরও বেশি আগে বিশিষ্ট এই সাংবাদিক যে বিশ্লেষণ ও মন্তব্য করেছিলেন বর্তমান সময়ে তারই অবতারণা হয়েছে। তবে প্রেক্ষিত আলাদা। বর্তমান সময়ে ১/১১-এর সরকারকে ঘিরে যে আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে তিনি হয়তো কোনো বিবেচনাতেই সেরকম একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা কল্পনাও করেননি। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব রাজনীতিকদের হলেও দেশকে বিরাজনীতিকরণের যে আত্মঘাতী খেলা শুরু হয়েছিল ১/১১-তে সে সময়ের পূর্ণ আলোচনা না উঠলেও সংবাদ প্রকাশ নিয়ে বড় ধরনের আলোচনা হচ্ছে। অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের সংসদ সদস্যরা এ নিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন। ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের সম্পাদক পত্রিকাটির ২৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে একটি টেলিভিশন চ্যানেলে ওই সময়ে তার দৈনিকে প্রকাশিত খবর নিয়ে কথা বলার পরপরই সংশ্লিষ্টরা সরব হয়ে উঠেছেন। আলোচনায় তিনি খোলামেলাই বলেছেন, সে সময়ে ডিজিএফআই কর্তৃক সরবরাহকৃত তথ্য যাচাই-বাছাই না করে ছেপে তিনি ভুল করেছেন। এ বক্তব্যের সূত্র ধরে সংসদ সদস্যরা দৈনিকটি বন্ধ ও এর সম্পাদক এবং প্রকাশকের শাস্তির দাবি করেছেন। একজন সদস্য সম্পাদক মাহফুজ আনামের পদত্যাগ এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেফতার করে তার বিচার দাবি করেছেন। তিনি ওয়ান-ইলেভেনের সময় মিথ্যা অপবাদ দিয়ে সাজানো গল্প ছাপানো ও মিথ্যা প্রচারণা চালানোর দায়ে বিচার দাবি করেছেন। আরেকজন সদস্য বলেছেন, মিথ্যার বেসাতি দিয়ে খবরের ডালা সাজিয়ে কোনো ব্যক্তির গোষ্ঠী দেশের ক্ষতি করলে অবশ্যই তার বিচার হবে। তিনি বলেছেন, মাহফুজ আনাম বিচারের আগেই ট্রায়াল করে ফেলেছেন, তা উনি স্বীকারও করেছেন। মাহফুজ আনামের স্বীকারোক্তি নিয়ে তথ্যমন্ত্রী ভিন্ন কথা বলেছেন বিবিসিকে। তিনি মনে করেন এটা তার সাহসী উক্তি। যারা এ ধরনের ভুল তথ্য সরবরাহ করেছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা এমন প্রশ্নের সদুত্তর না দিলেও মন্ত্রী স্বীকার করেছেন ১/১১এর অনেকেই এখন সরকারের সঙ্গে রয়েছেন। কার্যত এই আলোচনার মধ্যেই মূল প্যান্ডোরার বক্স লুক্কায়িত রয়েছে। খুব সংক্ষিপ্ত হলেও মৌলিক কিছু প্রসঙ্গ এর মধ্যেই উঠে এসেছে। কারণ ওই সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গনের বাইরেও অনেক আলোচকই টক-মিষ্টিশোতে রসিয়ে রসিয়ে অনেক অসত্য তথ্যই দিয়েছেন। বিশ্লেষণ করে ১/১১এর পক্ষে ছাপাই গেয়েছেন। এক্ষেত্রে প্রথমত বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে ১/১১-এর কুশীলবদের নিয়ে বা সে সময়ে যা ঘটেছে তা নিয়ে আলোচনা না করে আশ-পাশের আলোচনা কতটা সঙ্গত ও বিবেচ্য হতে পারে। কেন এবং কী কারণে ১/১১ হয়েছিল বা হতে পেরেছিল তার পাশাপাশি এ থেকে কারা কীভাবে লাভবান হয়েছে সেটিও ভাবার রয়েছে। একথা সবারই জানা, সে সময়ে দেশকে বিরাজনীতিকরণের যে আত্মঘাতী খেলা শুরু হয়েছিল তার মূল টার্গেট ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, বিএনপি তথা মূল্যবোধে বিশ্বাসী জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক শক্তি। যে মিথ্যে খবরের সূত্র ধরে বর্তমান আলোচনা সে ব্যাপরটি তো কেবলমাত্র আওয়ামী লীগের বেলাতেই ঘটেনি বরং আওয়ামী লীগের চেয়েও অনেক বেশি ঘটেছে বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের ক্ষেত্রে। এমনকি বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত ¯্য‹ান্ডালও প্রকাশ করা হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, ওই সরকারকে দায়মুক্তি দেয়ার অঙ্গীকারে ক্ষমতায় গিয়ে ১/১১ পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকার বর্তমান প্রধানমন্ত্রীসহ নিজ দলীয়দের সব মামলা প্রত্যাহার করে নিলেও বেগম জিয়াসহ বিএনপি নেতারা সেই মামলারই জের বহন করছেন। একযাত্রায় দুই ফল কি সঙ্গত? বাস্তবতা তো এই যে, সেদিন বেগম জিয়া দেশ ত্যাগে সম্মত না হওয়াতেই দেশের বিরাজনীতিকরণ প্রতিহত হয়েছিল। তার প্রতিদান হিসেবে বর্তমান সরকার বিএনপিকে রাজনীতি থেকে নিশ্চিহ্ন করতে যেসব প্রক্রিয়া অনুসরণ ও অবলম্বন করেছে এবং করছে তা কি ১/১১-এর সরকারের চেয়ে ভিন্ন কিছু, নাকি আরও ভয়াবহ? বোধকরি ১/১১-এর আলোচনা করতে গেলে সঙ্গত বিবেচনাতেই একশ্রেণীর রাজনীতিকের দায়িত্বহীনতার প্রসঙ্গ উঠে আসে। বড় আকারে আলোচনায় না গিয়েও এটুকু বলা যায়, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে সেনা সমর্থিত সরকার গ্রহণের মধ্যে রাজনৈতিক সততার কোনো নজির নেই। ওই সরকারকে সমর্থন জানাতে যারা উঁকিঝুঁকি দিয়েছেন তাদের অনেকের কথাবার্তার রেকর্ড এখনো বাজছে। শুধু তারা বা ওই সময়েই নয়, ’৮২-এর সামরিক শাসনকে যারা সমর্থন দিয়েছিলেন তাদের সঙ্গে ১/১১-এর সমর্থকদের খুব একটা পার্থক্য নেই। সরকারকে সমর্থন দিতে অনেক বড় বড় সাংবাদিকও সেদিন বিভিন্ন অফিসে আনাগোনা করেছেন। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক এবং আলাপ-আলোচনা বৈঠকের মুখরোচক খবর তখন প্রেসক্লাবের চায়ের আলোচনাতেও শোনা যেত। সেসব আলোচনার মূল প্রতিপাদ্যই মূলত উঠে এসেছে চলমান আলোচনায়। এ কথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব কেন এবং কীভাবে অন্যদের হাতে হস্তান্তরিত হয়ে গিয়েছিল তার আলোচনা না করে প্রকাশিত খবর নিয়ে আলোচনা স্বার্থপরতার নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এখানে মূল যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চর্চার প্রসঙ্গ রয়েছে তাকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। সংবাদপত্রের মূল সম্পর্ক হচ্ছে রাজনীতির সাথে। মিডিয়া হচ্ছে মতের বাহন। সে বিবেচনায় যারা মতকেই নির্মূল করতে চেয়েছে তাদের সঙ্গে মিডিয়ার দহরম-মহরমের কার্যত কোনো যুক্তি না থাকলেও এটাই সত্যি যে, সে সময়ের পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। এই ভিন্ন বাস্তবতার দায় কার্যত রাজনীতিকদেরই বহন করতে হবে বিশেষ করে যারা ক্ষমতায় গিয়ে এই ভয়াবহ বিপর্যয় নিয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মুখ খোলননি। এক্ষেত্রে নিজেদের দায়মুক্ত রেখে অন্যদের দায়ী করার সুবিধালোভী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এর চেয়েও দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, বর্তমান সরকারের কর্মপ্রক্রিয়াতে ১/১১ প্রসঙ্গ উঠেছে। এ কথাও আজ বিশেষ বিবেচনায় রাখতে হবে যে, ১/১১ থেকে প্রকৃত উপকার দেশের জনগণ পায়নি। আর এটা হয়েছে বা হতে পেরেছে বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ার কারণেই।
দেশে মিডিয়া তথা মত প্রকাশের বর্তমান অবস্থা কী তা নিয়ে আলোচনা অর্থহীন। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশের মত প্রকাশের সীমাবদ্ধতার কথা নানাভাবেই উঠে আসছে। এই অশুভ আলামতবাহী বাস্তবতাতেই দেশের বিচার বিভাগ নিয়ে গুরুতর আলোচনা সামনে এসেছে। সময়ের বিবেচনায় এবং বিষয়ের গুরুত্বের দিক থেকে আলোচ্য প্রসঙ্গের গভীরতাকে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। দেশের প্রধান বিচারপতি যখন মৌলিক কিছু প্রশ্ন তুলেছেন তখন আরেকজন সাবেক প্রধান বিচারপতি অন্য একটি বিষয়ের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করেছেন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিতের লক্ষ্যে করণীয় শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিচার বিভাগ নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছেন বিশিষ্টজনরা। তারা বলছেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগে আজো দলীয়করণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়োগ-পদোন্নতি-বদলি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে আইন মন্ত্রণালয় থেকে। দলীয়করণ নামক ক্যান্সারে আক্রান্ত পুরো বিচার বিভাগ। আলোচনায় সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা প্রবীণ আইনবিদ ড. কামাল হোসেন বলেছেন, আজ সংবিধানের অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দেশের সর্বোচ্চ বিচার বিভাগীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে দলীয়করণের মাধ্যমে। তিনি বলেছেন, বিচার বিভাগ না থাকলে আমরা কেউ নিরাপদ থাকব না, আমাদের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিও নিরাপদ থাকবে না। তিনি আরও বলেছেন, বিচার বিভাগকে স্বাধীন করা গেলে দেশ সংবিধান অনুযায়ী চলছে কিনা তা বিচারকরাই দেখতে পারবেন। সুপ্রিমকোর্টের সাবেক বিচারপতি আবদুল মতিন বলেছেন, চিফ জাস্টিসকে ডিনারে ডাকা মানেই বিচার বিভাগে হস্তক্ষেপ করা। এ ছাড়া ওই কাজটি করার পর ওই বিচারপতি সঠিক রায় লিখলেও জনগণ মনে করবে তিনি সঠিক রায় লিখতে পারছেন না। তিনি উল্লেখ করেছেন, ওয়ান-ইলেভেনের সময়েও বিচারপতিদের দাওয়াত দেয়া হয়েছিল। এই যে তিনি ওয়ান-ইলেভেনের কথা বলেছেন, এটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক আশঙ্কার প্রসঙ্গ। কারণ আলোচ্য ডিনারে কী হয়েছে তা নিয়ে কোনো মহলই কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। এমনিতে হয়তো করার কোনো প্রয়োজনও নেই। বাস্তবতা হলো, সাবেক বিচারপতি যে সময়ের উল্লেখ করেছেন সে সময়ে বিচারপতিসহ অনেককেই বঙ্গভবনে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে পদত্যাগপত্র নেয়া হয়েছিল বলে পরে জানা গেছে। বর্তমান প্রধান বিচারপতি এমন এক সময়ে ডিনারে দাওয়াত পেয়েছেন যখন কার্যত তিনি প্রচ- চাপের মুখে রয়েছেন। তার ডিনারে আইনমন্ত্রীর পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীও ছিলেন। নির্দিষ্ট মেহমানদের উপস্থিতি এবং সাবেক বিচারপতির বক্তব্য মিলে জনমনে থাকা নানামাত্রিক আশঙ্কাকে অমূলক মনে করার কোনো কারণ নেই। চলমান বাস্তবতায় আরেকজন সাবেক প্রধান বিচারপতি বলেছেন, অবসরে গিয়ে দেড় বছর পর রায় লেখা এবং রায় পরিবর্তন করা ফৌজদারি অপরাধ। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের বর্তমান সংকটের মূল ত্রয়োদশ সংশোধন যে রায়ের ওপর ভিত্তি করে সেটি দেয়া হয়েছিল অবসরে যাওয়ার পর এবং লিখিত রায় ঘোষিত রায়ের থেকে পরিবর্তিত। সে বিবেচনায় এ প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, ১/১১-এর সরকার যেভাবে দেশ থেকে রাজনীতিকে নির্মূল করতে চেয়েছে বর্তমান প্রক্রিয়া কি তার চেয়ে আলাদা কিছু?
স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত দেশে গণতন্ত্র, সংবাদপত্র ও সাংবাদিকরা কম আক্রান্ত হননি।বহুদলীয় মতকে নির্মূলকরণে যেমনি রাজনীতিবিদদের ওপর নানামুখী চাপ এসেছে, তেমনি সাংবাদিকদের ওপরও সরকারি দলে যেতে নানা চাপ ছিল। আবার সবার ওপর চাপ এসেছে এ কথাও বোধহয় সঙ্গত নয়। স্বাধীন বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র নিধনের প্রথম প্রয়াশ বাকশালের বিরোধিতা রাজনীতি অঙ্গনে সক্রিয় ছিল। যেভাবেই হোক অনেকেই সেদিন এই একদলীয় নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। সেদিন একদিকে একশ্রেণীর সাংবাদিক যেমনি দল বেঁধে ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে বাকশালে যোগ দেয়া তথা চাকরির নিশ্চয়তার জন্য হন্যে ছিলেন তেমনি অনেকেই এসব থেকে নিজেকে বিরত রেখেছেন। চাপ আসা চাপ থাকা না থাকার মধ্যবর্তী কিছু বিষয় আছে সে আলোচনা আজকে বড় নয়। এখানেই কৌশল বা সততার নানা প্রসঙ্গ রয়েছে। পাকিস্তানের আইউব সরকারবিরোধী একটি দৈনিকের পেশাগত সততার প্রসঙ্গে পূর্ব অলোচনার পুনরাবৃত্তি করছি। লেখা হয়েছে, গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বইখাতা হাতে মধ্য বয়সী একদল যুবক হাত উঁচাইয়া কিছু বলিতে বলিতে এলাকা প্রদক্ষিণ করিয়াছে। বোঝা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মিছিল লিখতে মানা ছিল। তারা তা লেখেননি অথচ যা লিখেছেন তাতে কিছু বাকিও থাকেনি। এ ধরনের অনেক কৌশলের কথা অনেক প্রবীণ সাংবাদিকের মুখেও শুনেছি। সে যাই হোক আজ প্রসঙ্গ উঠেছে বোধ-বিশ্বাসের। সে কারণেই প্রয়োজন শিক্ষা নেওয়ার।
রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘হায় বুদ্ধিহীন মানব হৃদয়, ভ্রান্তি কিছুতেই ঘুচে না। যুক্তিশাস্ত্রের বিধান বহু বিলম্বে মাথায় প্রবেশ করে। প্রবল প্রমাণকে অবিশ্বাস করে মিথ্যা আশাকে বাহুপাশে জড়াইয়া ধরে যখন নাড়ি কাটিয়া পলায়ন করে তখন চেতন হয়। দ্বিতীয় ভ্রান্তির পাশে পড়িবার জন্য চিত্ত ব্যাকুল হইয়া ওঠে।’ আজ যারা উপলব্ধির দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছেন তাদের যদি সত্যিই বোধোদয় হয়ে থাকে এবং দ্বিতীয় ভ্রান্তি থেকে নিষ্কৃতি পেতে যদি কোনো সদিচ্ছা থাকে তাহলে অবশ্যই সব দলের অংশগ্রহণভিত্তিক নির্বাচন নিশ্চিত করতে একটি গ্রহণযোগ্য সরকার প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক হতে হবে। সেটাই হবে ভুল থেকে নেয়া প্রকৃত শিক্ষা।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।