প্রিয় হুমায়ূন
রফিক মুহাম্মদবাংলাদেশের সোনার ছেলে দেশ জোড়া এক নামহিরে মোতি পান্না দিয়েও হয় না যে তার দাম।তার সৃষ্টি অমূল্য ধন বিশ্বজগৎ সেরালক্ষ কোটি প্রাণের মাঝে করছে
অনিন্দিতা গোস্বামী, পশ্চিমবঙ্গ
যেক’জন লেখকের লেখা পড়ে মনে মনে লেখক হওয়ার সাধ জাগে তার মধ্যে সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ অন্যতম। দুই বাংলায়ই তিনি সমান জনপ্রিয়। কলকাতা বইমেলার বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে যখন ঢুকি দেখি থরে থরে তার বই সাজানো। যেদিকে তাকাই দেখি নন্দিত নরক, সকল কাঁটা ধন্য করে, লীলাবতী, শ্রেষ্ঠ হিমু, নীল পদ্ম, কত কত বই। যেন বিরাট বটবৃক্ষের মতো তিনি বিভিন্ন স্টলগুলোকে ছেয়ে ফেলেছেন। তাতেই খানিক মালুম পাওয়া যায় তিনি এপার বাংলায়ও কতখানি জনপ্রিয়।
যদিও জনপ্রিয়তাই সাহিত্যের একমাত্র মাপকাঠি নয় এবং অতি বিদ্বজ্জনেরা জনপ্রিয় নামক শব্দটিতে খানিক নাসিকা কুঞ্চনই করেন তথাপি বলতে দ্বিধা নেই জনগণের প্রিয় হবার জন্যই কিন্তু যা কিছু নান্দনিক আয়োজন। এমনকি মানুষ নিজেকেও সাজায় অপরের চোখে সুন্দর হবার জন্য। আর এই সাজানোতে যে যত দক্ষ সে তত বড় শিল্পী, ঈশ্বরও তো তার সাধের পৃথিবীকে তিল তুলসী দিয়ে সাজিয়েছেন একটু একটু করে, সাহিত্যিকও তার প্রসার সাজিয়েছেন বাচাল পৃথিবীর চালচিত্র নির্মাণে। আর এখানেই হুমায়ূন আহমেদের দক্ষতা। সত্যিই তার লেখার মাধ্যমেই বিনা আয়াসেই এক হয়ে গিয়েছে দুই বাংলা। তার নানান লেখা নিয়ে মত দেবেন নানান জনে আমি শুধু তার হিমু নিয়ে দুটি কথা কই, ওলো সই।
মানুষের মনের আজন্ম ইচ্ছার নাম হিমু, হিমালয়, আকাশ নয় হিমালয় বিরাট অথচ যা ছোঁয়া যায়, আয়ত্তের মধ্যে আয়ত্তের বাইরে না। ইচ্ছে করলেই যেমন হয়ে ওঠা যায় মহাপুরুষ। আসলে এমন পুরুষ বুঝি পাওয়া ভার যে কৈশোরে বা যৌবনের প্রারম্ভে হতে চায়নি হিমু এমন মেয়েও বুঝি মেলা ভার যে প্রেমে পড়েনি হিমুর। যেমনি তার চরিত্র তেমনি তার নির্মাণে লেখকের গঠন শৈলী। অসামান্য তার বাচনভঙ্গি। যেন চোখের ওপর নেমে আসা এক গাছি চুল ফু দিয়ে উড়িয়ে দেয়া। শুধু কথার মায়াজাল, গল্প নেই সেভাবে কোনো, নেই কোনো শুরু অথবা শেষ, শুধু স্বপ্ন দেখানো। ছোট ছোট মুড়কির দানার মতো খেলতে খেলতে আঘাত করা সমাজের ক্ষতগুলোয়, প্রচলিত ঘুণধরা সমাজ ব্যবস্থায়। ঠিক কোথা দিয়ে যে আঘাত আসবে কেউ বুঝতে পারছে না, ব্যাটসম্যানকে বোকা বানাতে বানাতে হঠাৎ করে একটা ক্যাচ। তত্ত্বের কচকচানি নেই তবু তত্ত্ব কথাই। সামান্য একটু উদাহরণ দেবার লোভ সামলাতে পারছি না। বিশাল জিপে চলার আনন্দই আলাদা। নিজেকে রাজপথের রাজা মনে হয়। সিএনজি বেবিট্যাক্সি দেখামাত্রই চাপা দিতে ইচ্ছা করে। বিশেষ করে সেই সব সিএনজি যার পেছনে লেখাÑ আমি ছোট আমাকে মেরো না। আরে ব্যাটা, ছোট বলেই তো মার খাবি। বড় ছোটকে মারবে এটা জগতের নিয়ম। ংঁৎারাধষ ভড়ৎ ঃযব ভরঃঃবংঃ বড় ভরঃ, ছোট না। পশ্চাৎদেশে সাইনবোর্ড লাগিয়ে লাভ হবে না, ছোটকে মার খেতেই হবে। কোনো গভীর কান্না নেই, শোক নেই, আছে এক অদ্ভুত নির্লিপ্ততা। পড়তে পড়তে ক্যামুর আউট সাইডারের কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে ক্যালিগুলাকে। হিমুর বাবা কি অবলীলায় হত্যা করেছিল পোষা টিয়া পাখিকে কিংবা তার মাকে। কী ভয়ঙ্কর দর্শন অথচ কি সহজভাবে বলা, যেন এক হ্যাঁ হ্যাঁ ফ্যা ফ্যা করা লোক হিমু, যার কোনো কাজই নেই, যে একটা মিথ্যার জাহাজ, যার কিনা পরজন্মে মানুষের গাড়ি হয়ে জন্মানোর সুযোগ থাকলে পাজেরো গাড়ি হয়ে জন্মাতে ইচ্ছা করে সে-ই কেমন অবলীলায় বলে ফেলে মৃত মানুষকে দেখতে যাওয়া অর্থহীন। এখানে দেখাটা হয় একতরফা। একদল দেখে, অন্যজন তাকিয়ে থাকেÑ দেখে না। জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে যারা থাকে তাদের দেখতে বড় ভালো লাগে। এরা তখন অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলে। হুমায়ূন আহমেদের বাচনভঙ্গি তার হিমু চরিত্রটির প্রভাব দুই বাংলার পরবর্তী প্রজন্মের বহু লেখকের লেখার মধ্যেই দেখতে পাই। হয়তো একটা ঘরানাই তৈরি করে গেছেন তিনি। বোহেবিয়ানিজম যে মুক্তির খোঁজে তাবৎ দুনিয়া, এক মন কেমন করা বন্ধনহীন জীবন। রবীন্দ্রনাথের অতিথি গল্পের তারাপদ, বিভূতিভূষনের অপু যে ঘরানার পূর্বসূরি সেই ঘরানাতেই শহুরে স্মার্ট প্রলেপ লাগিয়েছিল হিমু তার হলুদ পাঞ্জাবির মতোই। অতি কথন হয়তো কখনো ক্লান্তি আনে ঠিকই কিন্তু তারপরও যা থেকে যায় তা হলো নির্মল পবিত্র এক অনুভূতি, যে অনভূতির জোরে অপরের মঙ্গল কামনার প্রার্থনা করা যায় মন থেকে। আর ঠিক এখানেই হিমুর জয়, সে নিজের নির্লিপ্ত বজায় রেখেও সন্ধান করে অন্যের আনন্দের।
আর সেটা সে করে সবার সঙ্গে একসারিতে থেকে দোষ, গুণ, পাপ, পুণ্যে মাখামাখি হয়ে। লেখক অতি দক্ষতায় তার সৃষ্ট চরিত্রকে মহাপুরুষ বানিয়ে তোলেননি। শক্তিশালী তিন সংখ্যার মতোই তিনি তার লেখা আর তার পাঠককুল এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে যুক্ত।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।