Inqilab Logo

শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

ট্রাম্প কি করবেন, এখন সেটাই দেখার বিষয়

প্রকাশের সময় : ১৩ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুনশী আবদুল মাননান
ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। ইলেকটোরাল ভোটের ৫৩৮টির মধ্যে তিনি পেয়েছেন ২৯০টি। নির্বাচিত হওয়ার জন্য প্রয়োজন ছিল ২৭০টি ভোট। তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটন পেয়েছেন ২২৮ ভোট। ট্রাম্পের এই বিপুল বিজয়কে অবিশ্বাস্য, অভাবনীয় বলে অভিহিত করা হয়েছে। সকল জনমত জরিপ ও পর্যবেক্ষকদের তাবৎ ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণ করে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন বার্তাসংস্থা ভোট গ্রহণের কয়েক ঘণ্টা আগেও বলেছিল, হিলারির বিজয় অবশ্যম্ভাবী। কেউ কেউ বলেছিল, তার বিজয়ের সম্ভাবনা ৯০ শতাংশ। কিন্তু ফলাফল প্রকাশের মাঝ পথেই দেখা গেল, সকল জল্পনা-কল্পনা, অনুমান, ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণ করে ট্রাম্পই বিজয়ী হতে যাচ্ছেন। গণনা শেষে দেখা গেল, ট্রাম্পের পক্ষে নীরব বিপ্লব হয়ে গেছে। অনেকেই এই বিপ্লবকে ‘শ্বেত বিপ্লব’ বলে অভিহিত করেছেন। তার বিজয় রীতিমতো বিস্ময়কর।
ডোনাল্ড ট্রাম্প এই অবাক করা বিজয়ের মধ্য দিয়ে কেবল চার বছরের জন্য হোয়াইট হাউসের চাবি ও কর্তৃত্বই লাভ করেননি, একই সঙ্গে তার দল রিপাবলিকান পার্টি কংগ্রেসের উভয় কক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে। নিরঙ্কুশ ক্ষমতা বলতে যা বুঝায়, তা এখন ট্রাম্প বা রিপাবলিকান দলের হাতে। পপুলার ভোট অবশ্য ট্রাম্পের চেয়ে হিলারিই বেশি পেয়েছেন। ট্রাম্প পেয়েছেন ৫ কোটি ৯১ লাখ ৩৩ হাজার ৩৯৮ ভোট। আর হিলারি পেয়েছেন ৫ কোটি ৯২ লাখ ৯৪ হাজার ৬৪৯ ভোট। হিলারির এই ১ লাখ ৬১ হাজার ২৯১ ভোট বেশি পাওয়া কোনো কাজেই আসেনি। কারণ, ইলেকটোরাল ভোট ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় বলা হয়, ঞযব রিহহবৎ ঃধশবং ধষষ. অর্থাৎ কোনো অঙ্গরাজ্যে ইলেকটোরাল ভোট যিনি বেশি পাবেন তিনিই ওই অঙ্গরাজ্যের সব ইলেকটোরাল ভোট পেয়েছেন বলে গণ্য হবে।
দীর্ঘ ১৮ মাসের প্রচার-প্রচারণায় যিনি অবশ্যম্ভাবীভাবে বিজয়ী হবেন বলে বলা হয়েছে, সেই হিলারি ক্লিনটন কেন এমন শোচনীয়ভাবে হারলেন এবং যার বিজয়ের সম্ভাবনা একেবারেই ছিল না, সেই ডোনাল্ড ট্রাম্প এই বিশাল বিজয় অর্জন করলেন, তা নিয়ে এখন বিশ্বজুড়েই আলোচনা-পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের বৃহত্তর অংশের রক্ষণশীলতা এবং নারীর প্রতি অসম ও বিদ্বেষমূলক মনোভাব নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে বলে অনেকের ধারণা। মুখে যতই তারা উদারতা ও সমতার কথা বলুন না কেন, অন্তরে তাদের বাসা বেঁধে আছে নারীবিদ্বেষ ও কূপম-ূকতা। তারা চাননি কোনো নারী যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হোন। তাদের এই অনীহা-অনিচ্ছার কারণে হিলারি প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হওয়ার ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারেননি। বলা হচ্ছে, হিলারি ওবামার সমর্থকদের কাছে টানতে পারেননি। ফ্লোরিডা, পেনসিলভেনিয়া, ওহাইও, আইওয়াÑ এই চারটি অঙ্গরাজ্য ওবামার দখলে ছিল। তার বিজয়ের পেছনে এই চার অঙ্গরাজ্যের বড় ভূমিকা ছিল। এ চারটি অঙ্গরাজ্যই ছিনিয়ে নিয়েছে ট্রাম্প। অঙ্গরাজ্যগুলোতে ইলেকটোরাল ভোটের সংখ্যা ৭৩টি। এ ভোটগুলো হিলারি পেলে তিনিই জিততেন। ট্রাম্প পেয়েছেন, তাই তিনিই জিতেছেন। অনেকেরই ধারণা ছিল, আফ্রো-আমেরিকান ও লেটিনো ভোটারদের একচ্ছত্র সমর্থন পাবেন হিলারি। কিন্তু ধারণা অনুপাতে সে সমর্থন তিনি পাননি। হিলারির ই-মেইল নিয়ে শেষ দিকে যে খেলাটি হয়, সেটা তার সম্পর্কে বিরুপ ধারণা সৃষ্টি করে ভোটারদের অনেকের মধ্যে। যদিও শেষে বলা হয়, হিলারির কোনো দোষ নেই; কিন্তু তার ক্ষতি যা হওয়ার আগেই হয়ে যায়। এ ছাড়া ডেমোক্রেটিক পার্টি ও রিপাবলিকান পার্টির বিজয়ের ধারাবাহিকতাও হিলারির পক্ষে ছিল না। দেখা যায়, পরপর দুই টার্মের বেশি কোনো দলই বিজয়ী হতে পারেনি। দুই টার্মের পরে দল-বদল হয়েছে। এটাও হয়তো ভোটারদের মধ্যে কাজ করে থাকতে পারে। তারা ডেমোক্রেটদের শাসনের পরিবর্তন চেয়েছে।
স্বাভাবিক কারণেই হিলারির ক্ষেত্রে যা নেতিবাচক পয়েন্ট হিসাবে কাজ করেছে, ট্রাম্পের ক্ষেত্রে তা ইতিবাচক পয়েন্ট হিসাবে ভূমিকা রেখেছে। নির্বাচনে ট্রাম্পের টার্গেট গ্রুপ ছিল সংখ্যাগরিষ্ট শেতাঙ্গরা। তিনি শেতাঙ্গ সুপ্রিমেসির কথা বলেছেন, যা শেতাঙ্গদের বিশেষভাবে তার পক্ষে ভোট দিতে উজ্জীবিত করেছে। তিনি কালোদের বিরুদ্ধে, হিস্পানিকদের বিরুদ্ধে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। এসব বলে তিনি বর্ণবাদকে ও সাম্প্রদায়িকতাকে তাতিয়ে দিয়েছেন। শেতাঙ্গরা হয়তো ভেবেছে, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে যুক্তরাষ্ট্র শেতাঙ্গ সুপ্রিমিসি প্রতিষ্ঠিত হবে এবং যাবতীয় ক্ষেত্রে তারা প্রাধান্য লাভ করবে। ট্রাম্প একইসঙ্গে ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ বলে প্রচার চালিয়ে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান শীর্ষে নেয়ার কথা বলেছেন। এটা যুক্তরাষ্ট্রের তরুণদের অনুপ্রাণিত করেছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, শেতাঙ্গ বর্ণবাদ ও আমেরিকান জাতীয়তাবাদের সঙ্গে দরিদ্র গ্রামীণ নাগরিকদের উন্নয়নের কথাও ট্রাম্প বলেছেন। এতে তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে থাকা অর্ধশিক্ষিত-অশিক্ষিত গ্রামীণ শেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী ব্যাপকভাবে ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন। তাদের মধ্যে বর্ণবিদ্বেষ ও নারীবিদ্বেষ এখনো প্রাথমিক স্তরে রয়েছে।
ট্রাম্প ভোটের রাজনীতিতে জেতার জন্য এমন পরিকল্পনা ও পন্থা অবলম্বন করেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের এতদিনের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বিরোধী। এটা তার বিজয় নিশ্চিত করেছে বটে, তবে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজকে বহুধাবিভক্ত অসহিষ্ণু, বিশৃংখলার পথে টেনে নিয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় অখ-তাকে পর্যন্ত হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, ভাংচুর ইত্যাদির মতো নজিরবিহীন ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। ‘ট্রাম্প আমাদের প্রেসিডেন্ট নন’, বিক্ষুব্ধ মানুষের কণ্ঠে এমন কথাও শোনা গেছে। অর্থনীতির ক্ষেত্রেও একটা নেতিবাচক প্রবণতা প্রত্যক্ষ করা গেছে। শেয়ার বাজারে ধস নেমেছে, মুদ্রামূল্য হ্রাস পেয়েছে এবং বড় বড় ধনকুবের মাথায় হাত পড়েছে। একদিনেই তারা ৪১ বিলিয়ন ডলার খুইয়েছেন। আগামীতে পরিস্থিতি কি হবে বা কি দাঁড়াবে, ভবিতব্যই বলতে পারে।
ট্রাম্প নির্বাচনী ও প্রচারণার সময় অনেক প্রতিশ্রুতি, অঙ্গীকার ও ঘোষণা দিয়েছেন। এখন সেগুলো বাস্তবায়নের পালা। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর বাস্তবায়ন করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে বিরাট প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বলাবাহুল্য, তিনি সামাজিক মূল্যবোধ ও রাজনৈতিক শিষ্ঠাচারে আঘাত করেছেন, বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর ব্যাপারে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী প্রদর্শন করেছেন। এই পটভূমিতে তিনি কি করতে পারবেন, এখন সেটাই দেখার বিষয়। তিনি নারী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছেন। সমাজের বিভিন্ন স্তরের সম্মানিত ব্যাক্তিদের সম্পর্কে যাচ্ছেতাই বলেছেন। এমন কি নিজ দলের নেতাদেরও তিনি ছেড়ে কথা বলেননি। এসব কারণেই তিনি প্রেসিডেন্ট হোন, এটা অনেকেই চাননি। তারা না চাইলেও তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। এটাই সত্য ও বাস্তব। খুব সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তিনি কি প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি, সৈন্য সংখ্যা বাড়ানো, শ্রমজীবী মানুষের বর্ধিত সুবিধা প্রদান, শিল্পায়ন, অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা, অভিবাসীদের বিতাড়ন, নতুন অভিবাসী না নেয়া, মুসলমানদের প্রবেশ রোধ, মেক্সিকোর সীমান্তে দেয়াল তোলা এবং তার খরচ মেক্সিকোর কাছ থেকে আদায় করা, চীন, জাপান ও মেক্সিকোর পণ্যের প্রবেশ সীমিত করাসহ উচ্চ শুল্ক আরোপ, ন্যাটো ভেঙ্গে দেয়া, বিপিটি বা নাফটা চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন, জাতিসংঘ ও জলবায়ু তহবিলে অনুদান হ্রাস, রাশিয়ার সঙ্গে একযোগে আইএস দমন ইত্যাদি করতে পারবেন?
তিনি অর্থনীতিকে তরুপের তাস হিসাবে ব্যবহার করেছেন। অনেকের জানা, ২০০৮ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি খুব ভালো যাচ্ছে না। বারাক ওবামা বিগত আট বছরে অর্থনীতি চাঙ্গা করার জন্য অনেক কিছু করেছেন এবং লক্ষ্যণীয় সাফল্যেও এ ক্ষেত্রে এসেছে। তারপরও হাজার হাজার কারখানা বন্ধ রয়েছে, বহু মানুষ বেকার হয়ে পড়েছেন, এক তৃতীয়াংশের বেশী মানুষ দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে রয়েছেন। এই অবস্থাটি তিনি তার পক্ষে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছেন। বারবার বলেছেন, অর্থনীতি ধ্বংসের পথে। তা রক্ষা করতে হবে। তিনি অর্থনীতিতে রক্ষণশীলতা প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন, শিল্প-কারখানা গড়ার কথা বলেছেন, বেকারত্ব দূর করার কথা বলেছেন, বলেছেন, তিনি দ্রুতই এহেন অবস্থার অবসান ঘটাতে পারবেন। সাধারণ মার্কিনীদের একটা ক্ষোভ আছে; তারা মনে করে, অভিবাসীরা তাদের মুখের গ্রাস কেড়ে খাচ্ছে। কম দামের পণ্য প্রবেশের ফলে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠছে না বলে তাদের বেকার থাকতে হচ্ছে। ট্রাম্প তাদের এই মনোভাব নিরীক্ষণ করে অভিবাসন বন্ধ বা হ্রাস, চীন, জাপান ও মেক্সিকোর পণ্য প্রবেশ হ্রাস ও শুল্ক আরোপ, মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল তোলার মুখরোচক অঙ্গীকার ও ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব কাজ করতে গেলে হিতে বিপরীত হবে এবং যুক্তরাষ্ট্র ফের ৩০-এর দশকের মতো মহামন্দার শিকার হবে। সাধারণভাবেও বুঝা যায়, অভিবাসীরা জিডিপিতে যে কয়েক শতাংশ অবদান রাখে, অভিবাসী আগমন বন্ধ হলে, সেটা বন্ধ হয়ে যাবে। উচ্চ মজুরী দিয়ে শ্রমিক নিয়োগের ক্ষমতা উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীদের নেই, যাতে তারা নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে তুলবেন। ফলে বেকারত্ব হ্রাসের সম্ভবনা ক্ষীণ। অন্যদিকে চীন, জাপান ও মেক্সিকোর সঙ্গে লড়াই করার সক্ষমতাও যুক্তরাষ্ট্রের নেই। ওইসব দেশ থেকে কমমূল্যে যে সব পণ্য পাচ্ছে মার্কিনীরা তা সীমিত হলে কিংবা শুল্ক বাড়ালে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় এখনকার তুলনায় অনেক গুণ বেড়ে যাবে। ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নেই, হার্বাট ক্লার্ক হুবার যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট তখন অর্থনীতিতে সংরক্ষণবাদী নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল। হুবারের সেই নীতির কারণে মার্কিন অর্থনীতি প্রথমে এবং পরে বিশ্ব অর্থনীতি মহামন্দার ভয়াবহ শিকার হয়েছিল। ট্রাম্প হুবারের জুতা পায়ে দিয়েই পথ হাঁটতে চেয়েছেন। এর ফল কি হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয় এবং এ কারণেই মার্কিন অর্থনীতিবিদরা যারপরনাই উদ্বিগ্ন। নোবেল বিজয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ পল ক্রগম্যান তার এক তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় নানা দিক তুলে ধরে চরম হতাশা ব্যক্ত করেছেন। চূড়ান্ত মন্তব্যে তিনি বলেছেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা দিগন্তে একটি বৈশ্বিক মন্দার মেঘ দেখতে পাচ্ছি। সেই মেঘমালার শেষ প্রান্ত এখনো দৃষ্টির বাইরে। আমি মনে করি, নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা সেই মেঘ মোকাবিলায় ভাগ্যবান হতে পারতাম। কিন্তু যেমন অর্থনীতিতে তেমনি সব ক্ষেত্রে একটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গেছে মঙ্গলবার রাতে।’
অনেকই মনে করছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও তার ফলাফল ব্রেক্সিটের মতই আরেকটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্ঠিকারী ঘটনা। উভয় ক্ষেত্রেই জনগণের ‘গণতন্ত্রবোধ’ প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে ব্রিটেনের থাকা-না থাকার বিষয়টি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছিল। আর এটা হয়েছিল ক্ষমতার রাজনীতির কারণে। শেষ পর্যন্ত এ নিয়ে গণভোট হলে এবং তাতে ব্রেক্সিটপন্থীরা বিজয়ী হলে ব্রিটেনে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। লাখো লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে এসে ধ্বনি তুলেছিলঃ গণভোট মানি না মানি না। তখন ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মধ্যেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল। অনেকেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভবিষ্যত নিয়ে শংকা প্রকাশ করেছিলেন। এখনো ব্রেক্সিট নিয়ে তুমুল বিতর্কের পাশাপাশি সে শংকা বিদ্যমান রয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পরও সে দেশে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ যেমন দেখা দিয়েছে তেমনি নানা ক্ষেত্রে শংকাও দেখা দিয়েছে। মার্কিন জনগণের বিবেকবান, বুঝমান, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন অংশ ট্রাম্প নির্বাচিত হোন, চাননি। তার বিজয়ের মধ্য দিয়ে যে বিপদ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য রয়েছে তা তারা আগেই অনুভব করেছিলেন। এজন্যই বিক্ষোভ ও মানিনা মানিনা ধ্বনি হচ্ছে। বিশ্বে মার্কিন মিত্র বলে কথিত দেশগুলো চায়নি ট্রাম্প বিজয়ী হোন। এখন যুক্তরাষ্ট্রেই কেবল নয়, গোটা বিশ্বেই এক ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। রাশিয়া ও ভারতের পক্ষ থেকে তাকে উষ্ণ অভিনন্দন জানানো হয়েছে। ইসরাইল থেকে ‘প্রকৃত বন্ধুর’ স্বীকৃতি পেয়েছেন ট্রাম্প। বিশ্বের অন্যান্য দেশ কিন্তু মোটেই কোনো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেনি। জাতিসংঘ, ন্যাটো এবং চীন, মেক্সিকোসহ বিভিন্ন দেশ অপেক্ষায় আছে ট্রাম্প প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেয়ার পর কি করেন, তা দেখার জন্য। যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসীরা, সেখানকার মুসলমানসহ বিশ্বের মুসলমানরাও শংকার মধ্যে রয়েছেন। কালোরাও ভালো নেই। এমতাবস্থায়, ট্রাম্প কি করবেন সেটাই এখন বড় বিবেচ্য বিষয়। যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে যে বিভাজন ও হুমকি দেখা দিয়েছে, সেটা মিটাতে না পারলে পরিণতি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। বহির্বিশ্বে যে শংকা ও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের একান্ত স্বার্থেই তার অবসান হওয়া জরুরি। এ দিকে যথাযথ নজর না দিলে যুক্তরাষ্ট্র বিচ্ছিন্নতার মুখে পতিত হতে পারে।
বিজয়ের পর ট্রাম্প যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার সুর সম্পূর্ণ আলাদা। সেটা একটা আশার সঞ্চার করেছে। তিনি বলেছেন, তিনি সকলের প্রেসিডেন্ট, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। যুক্তরাষ্ট্রকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে তার শ্রেষ্ঠত্ব নিশ্চিত করাই তার লক্ষ্য। এই বক্তব্য ইতিবাচক ও সমর্থনযোগ্য। বলা হয়ে থাকে, রাজনীতির মাঠে ভোটের জন্য অনেকেই অনেক কিছুই বলেন। কিন্তু বিজয়ী হওয়ার সে সবের হুবহু বাস্তবায়ন কেউ করতে পারেন না। করা সম্ভবও নয়। ট্রাম্পও অনেক কিছু বলেছেন, সে সব প্রতিশ্রুতি, অঙ্গীকার ও ঘোষণা ষোল আনা বাস্তবায়ন করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। দেখা গেছে, ধর্ম, বর্ণ ও জাতিগত সংখ্যালঘু ও নারীদের সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন ভোটের আগে, ভোটের পরে তার কণ্ঠে এ সবের কিছুই শোনা যায়নি। খবর পাওয়া গেছে, তার ওয়েবসাইট থেকে মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্য সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এটা ইতিবাচক লক্ষণ।
ট্রাম্প কেবল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টই নন, পৃথিবীর সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান ব্যক্তিও বটে। তার দায়িত্ব কতটা বিরাট ও ব্যাপক সেটা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্বের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন প্রতিটি মানুষ আশা করে, যুক্তরাষ্ট্র ও তার জনগণের জন্য যা কল্যাণকর ও মঙ্গলজনক, তিনি তাই করবেন। বিশ্বের শান্তি, নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য যা প্রয়োজন, তিনি তাই করবেন। বাংলাদেশের মানুষ স্বভাবতই কামনা করে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের যে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক রয়েছে, তা অব্যাহত থাকবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ট্রাম্প কি করবেন
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ