Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পাল্টে যাচ্ছে ৩৬ নদীবন্দর

চিলমারী বন্দরের কাজ শেষ হচ্ছে জুনেই পণ্য পরিবহন খরচ কমবে নদীপথে যোগাযোগ বাড়বে

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ২৯ মার্চ, ২০২২, ১২:০০ এএম

নদীমার্তৃক বাংলাদেশের নদীপথের বেহালদশা। ভারতের ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মা-যমুনা-আত্রাই-মহানন্দাসহ অনেক নদীতে পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। তিস্তা চুক্তি ঝুলিয়ে রাখায় শুকিয়ে গেছে উত্তরাঞ্চলের অসংখ্য নদী। এর মধ্যেই সরকার দেশের নদী পথের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে মহাপ্রকল্প গ্রহণ করেছে। দেশের ৩৬টি নদীবন্দর আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। চিলমারী বন্দরসহ কয়েকটি নৌবন্দরের কাজ চলছে। নদী বন্দরগুলো আধুনিকায়ন হলে দেশের নৌপথে যোগাযোগ ব্যবস্থার বিপ্লব ঘটবে। নৌপথে দেশ-বিদেশে পণ্য আনা নেয়ায় খরব কমবে এবং নদী পথের ব্যবহার বেড়ে যাবে।
জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক ইনকিলাবকে বলেন, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে আমরা প্রায় ৫০টি নদীবন্দর ঘোষণা করতে পারব। ১০ রুটে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। নতুন করে চালু করতে যাওয়া হচ্ছে দাউদকান্দি ও সোনামোড়ায়। এ ছাড়াও এখন রাজশাহীকে টার্গেট করা হয়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ খনন করে আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ নৌপথগুলোর সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এসব বন্দরে আছে যন্ত্রচালিত নৌযান অবতরণ, যাত্রী ও পণ্য ওঠানামার সুবিধা। আগামীতে আরো বৃদ্ধি করা হচ্ছে।
স্বাধীনতার পর মাত্র ৫টি নদীবন্দর নিয়ে নৌপথে শুরু হয় যাত্রী ও পণ্য পরিবহন। বর্তমানে যা দাঁড়িয়েছে ৩৬টিতে। এসব বন্দরে আছে যন্ত্রচালিত নৌ-যান অবতরণ, যাত্রী ও পণ্য ওঠানামার সুবিধা। এবার নতুন যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক নৌ-বাণিজ্যে আমূল পরিবর্তনের মেগা প্রকল্পে কাজ বাস্তবায়ন করেছে সরকার।
৩৬টি নদীবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শেষ হলে পাল্টে যাচ্ছে নদীবন্দরের দৃশ্য। দেশের ১০ রুটে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। নতুন করে চালু করতে যাওয়া হচ্ছে দাউদকান্দি ও সোনামোড়ায়। এ ছাড়া রাজশাহীকে টার্গেট করা হয়েছে। এদিকে আগামী ২০২৪ সালের মধ্যে ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ খনন করে আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ নৌপথগুলোর সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। আগামী বছর জুনে কুড়িগ্রামের চিলমারী বন্দরের কাজ শেষ হলে বছরে ৩ কোটি ২৫ লাখ যাত্রী ও দেড় লাখ টন পণ্য পরিবহন সম্ভব হবে। নতুন সংযোগ তৈরি হবে ভারতের আসাম, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে সংযোগ। অপরদিকে পাবনার নগরবাড়ী নদীবন্দর দিয়ে তৈরি হবে ৩০ লাখ টন পণ্য পরিবহনের সুযোগ।
বিআইডব্লিউটিএর প্রধান প্রকৌশলী (ড্রেজিং) মো. আবদুল মতিন ইনকিলাবকে বলেন, সারাদেশে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক নৌ-বাণিজ্যে আমূল পরিবর্তনের মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ দ্রুত শেষ হচ্ছে। আগামী জুনের কুড়িগ্রামের দুধকুমার নদীবন্দর প্রকল্প এবং চিলমারী বন্দরের কাজ শেষ হবে।
নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ফেরি ও কোস্টাল এবং কার্গো সার্ভিসের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ নৌপথে বছরে ২২ কোটি ৫০ লাখ যাত্রী ও ২ কোটি ৫০ লাখ যানবাহন পরিচালিত হয়। প্রতি এক টন পণ্য পরিবহনে প্রতি কিলোমিটারে সড়কপথে সাড়ে ৪ টাকা, রেলপথে আড়াই টাকার বিপরীতে নৌপথে খরচ ১ টাকারও কম। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে ঢাকা নদীবন্দর দিয়ে যাত্রী পরিবহন হয়েছে ৫ কোটি ৩৫ লাখ ৫২ হাজার জন। একই সময় এ বন্দর দিয়ে পণ্য পরিবহন হয়েছে ৫৮ দশমিক ৫২ লাখ টন।
২০১৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুড়িগ্রামের চিলমারীকে নদীবন্দর হিসেবে ঘোষণা করেন এবং অন্যান্য নদী ও সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে এর সংযোগ স্থাপনের বিষয়ে জোর দেন। সে অনুসারে ২০১৬ সালের ৮ ডিসেম্বর এ-সংক্রান্ত বাংলাদেশ গেজেট প্রকাশিত হয়। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিআইডব্লিউটিএ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে ২৩৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। নির্দিষ্ট সময়ে বাস্তবায়ন হলে ও চুক্তি অনুসারে নৌ-চলাচল শুরু করলে ৫৯ বছর পর চালু হবে আসাম-নেপাল-ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের নৌ-চলাচল। ব্রহ্মপুত্র নদের উপকূল ঘেঁষে গড়ে ওঠা চিলমারী নদীবন্দরে একসময় ভিড়ত বড় বড় নৌকা ও জাহাজ। মালপত্র খালাস করা হতো, আবার জাহাজে নতুন করে মালপত্র ভরে পাড়ি জমাত অন্য বন্দরে। ব্রিটিশ আমলে আসাম ও মেঘালয় রাজ্যের সঙ্গে বাণিজ্যের অন্যতম মাধ্যম ছিল চিলমারী বন্দর। কয়েক দশক ধরেই বাণিজ্যের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ব্যবহূত হওয়া এ নৌপথ রাজনৈতিক কারণে বন্ধ হয়ে যায় ১৯৬৫ সালে। বন্দরটি চালু থাকাকালীন বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের নৌপথ হিসেবে ব্যবহার করা হতো যমুনা নদীকে। কুড়িগ্রামের চিলমারী হয়ে বাহাদুরাবাদ, সিরাজগঞ্জ থেকে দুদিকে চলে যেত নৌপথটি। একটি নৌপথ গড়াই নদী হয়ে ও অন্যটি চাঁদপুর ও বরিশাল হয়ে ভারতের দুটি বন্দরে যেত। ফলে দেশে একটি শক্তিশালী নৌ-রুট চালু ছিল। কিন্তু চিলমারী বন্দরটি বন্ধ হওয়ার পর থেকেই দেশের নৌ-রুট তার জৌলুস হারাতে শুরু করে।
দীর্ঘ সময় পর এবার চিলমারী বন্দর চালুর উদ্যোগ নিল সরকার। কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী উপজেলার রমনা ও জোড়গাছ ঘাট এলাকা, রাজিবপুর উপজেলার রাজিবপুর ঘাট ও নয়ারহাট ঘাট এলাকা এবং রৌমারী উপজেলার রৌমারী ঘাট এলাকায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। রংপুর বিভাগের অপেক্ষাকৃত সুবিধাবঞ্চিত কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার কিছু এলাকার নৌ-পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে চিলমারী এলাকায় বন্দর অবকাঠামো সুবিধাদি নির্মাণ করা হবে। বন্দরটি চালু হলে চিলমারী এলাকায় বছরে পরিবাহিত প্রায় ৩ লাখ ২৫ হাজার যাত্রী ও দেড় লাখ টন মালপত্রের সুষ্ঠু ও নিরাপদ ওঠানামা নিশ্চিত হবে। পাশাপাশি নৌ-বাণিজ্য ও অতিক্রমণ প্রটোকলের আওতায় ভারতের আসাম এবং নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে যোগাযোগব্যবস্থা প্রবর্তনে অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
প্রকল্পের আওতায় ক্যাপিটাল ড্রেজিং করা হবে ৩৩ লাখ ঘনমিটার, তীর রক্ষা ৭৮৫ মিটার, স্টিল জেটি নির্মাণ ৩৭৯ দশমিক শূন্য ৮ বর্গমিটার, অ্যাপ্রোচ রোড নির্মাণ ১০৯ দশমিক ৯০ বর্গমিটার, অভ্যন্তরীণ পোর্ট রোড ৩ হাজার ৯৪ বর্গমিটার, আরসিসি পেভমেন্ট ইন্টারনাল পোর্ট রোডসহ ১০ হাজার বর্গমিটার, আরসিসি জেটি অ্যান্ড এক্সেস ব্রিজ ২ হাজার ৪৮০ বর্গমিটার, সিডিসহ র্যাম্প ৪৫৯ বর্গমিটার, স্টিল স্পাড ৩৯টি ও পন্টুন পাঁচটি। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে চিলমারী এলাকায় একটি আধুনিক নদীবন্দর স্থাপিত হবে।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিলে ভারত ও নেপালের সঙ্গে বাণিজ্যের অন্যতম মাধ্যম হতে পারে চিলমারী বন্দর ও নৌপথটি। কেননা, নৌপথে পণ্য পরিবহন খরচ সড়কপথের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। আবার নৌপথে পণ্য পরিবহন করলে পরিবেশ রক্ষা ছাড়াও পণ্যের গুণগত মান ধরে রাখা সম্ভব হয়। এছাড়া নদীর দুইপারে শিল্প ও নৌপথের উন্নয়ন হলে জ্বালানি সাশ্রয়ী পণ্য পরিবহন, প্রবৃদ্ধিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি দেশের সবুজ অর্থনীতি আরো বেগবান হবে।
ঢাকা নদীবন্দর পরিচালক মো. গুলজার আলী ইনকিলাব বলেন, প্রায় ১৩টি সেতু রয়েছে ঢাকার চারপাশে। এগুলো পর্যায়ক্রমে রিমুভ করা হবে। বর্তমানে যে বেড়িবাঁধটি রয়েছে, সেটিও প্রসারিত করা হবে। এমন অবস্থায় দেশের নদীবন্দরগুলোর সক্ষমতা বাড়িয়ে আন্তর্জাতিক নৌবাণিজ্যের পরিধি বাড়াতে মেগা প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। ১ হাজার ২৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে আশুগঞ্জ অভ্যন্তরীণ নৌবন্দরে টার্মিনাল, জেটি এবং ওয়াকওয়ে নির্মাণ, ৫১৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে পাবনার নগরবাড়ীতে নৌবন্দরে পাকা জেটি, নদীতীর রক্ষা অবকাঠামো তৈরি, ২৩৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ব্যয়ে চিলমারী নদীবন্দর নির্মাণ প্রকল্প, ঢাকা নদীবন্দরে ১ হাজার ১০ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ চলছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ