Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ফসলের উৎপাদন কমছে

ক্রমেই ছোট হচ্ছে চলনবিল প্রতিবছর গড়ে বিলের আয়তন কমছে ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ

সিরাজগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা : | প্রকাশের সময় : ২২ মার্চ, ২০২২, ১২:০৩ এএম

পূর্বেকার সেই চলনবিল এখন আর নেই। ক্রমে ক্রমে এর আয়তনসহ সব সুবিধা হ্র্রাস পেতে শুরু করেছে। মাছের গুতোয় যে চলনবিলে নৌকা চলতে পাড়ত না, সেই চলন বিল এখন মৎস্যশূন্য হতে চলেছে। একই সঙ্গে শস্যভাণ্ডার নামের সেই পরিচিত শস্য উৎপাদনে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে পানি শূন্যতায়। ফলে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে এখন চলনবিল তার অতীত ঐতিহ্য হারাতে বসেছে।

রাজশাহী বিভাগের ৬ জেলার ১ হাজার ৮৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে ছিল চলনবিল। বর্তমানে পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ-এই তিন জেলার ১০টি উপজেলার, ৬২টি ইউনিয়নের ১ হাজার ৬০০ গ্রাম নিয়ে বৃহত্তর চলনবিল। বিলে রয়েছে ২১টি নদ-নদী, ৭১টি নালা-খাল ও ৯৩টি ছোট বিল।

ইম্পিরিয়াল গ্যাজেটিয়ার অব ইন্ডিয়ার তথ্যমতে, ১৮২৭ সালে জনবসতি এলাকা বাদ দিয়ে চলনবিলের জলমগ্ন অংশের আয়তন ছিল ৫৫০ বর্গমাইল বা ১ হাজার ৪২৪ বর্গকিলোমিটার। ১৯০৯ সালে চলনবিল জরিপের এক প্রতিবেদনে এই আয়তন দেখানো হয় ১৪২ বর্গমাইল। হিসাব অনুযায়ী, ৮২ বছরে চলনবিলের আয়তন কমেছে ৪০৮ বর্গমাইল। উইকিপিডিয়া ও বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে, বর্তমানে চলনবিলের আয়তন ১৬৮ বর্গকিলোমিটার। এই হিসাবে ১৯০৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পরবর্তী ১১২ বছরে চলনবিলের আয়তন কমেছে ১৯৯ বর্গকিলোমিটার। প্রতিবছর গড়ে বিলের আয়তন কমছে ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ।

চলনবিল রক্ষা আন্দোলন কমিটির তথ্যমতে, ১৯১৪ সালে ঈশ্বরদী-সিরজগঞ্জ রেললাইন চলনবিলকে দ্বিখন্ডিত করে। ২০০১ সালে হাটিকুমরুল-বনপাড়া ৫৫ কিলোমিটার মহাসড়ক ও ১৯৮০ সালে বাঘাবাড়ি-তাড়াশ বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ চলনবিলের পানি প্রবাহ চরমভাবে বাধাগ্রস্থ করে। এরপর থেকে চলনবিলে একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছর থেকে ২০০৯-১০ অর্থ বছর পর্যন্ত সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৫ বছরে চলনবিলে ১ হাজার ১৮৮ দশমিক ৫ কিলোমিটার পাকা সড়ক, ১১৩টি সেতু, ৮৫৫টি কালভার্ট, ৯০টি গ্রোথ সেন্টার ও ২১টি স্লুইসগেট নির্মাণ হয়েছে।

কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) পানাসি প্রকল্পের তথ্য অনুসারে, চলনবিলের পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ অংশে ২১টি নদ-নদীর অধিকাংশই এখন ভরাটের দিকে। বর্তমানে বড়াল নদ মরা খালে পরিণত হয়েছে। বিলে ৭১টি খাল ও নালা রয়েছে। যার দৈর্ঘ্য ৪১০ কিলোমিটার। প্রায় ৬৬ হাজার ২৪০ জন কৃষক এসব খাল ও নালা থেকে সেচের পানি পেতেন। বর্তমানে ৩৬৮ কিলোমিটার পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে। যা মোট নালা ও খালের ৯০ দশমিক ২৪ শতাংশ। বাকি ৪২ কিলোমিটার নালা ও খাল পুনরায় খনন করে নাব্যতা ফেরানোর কাজ চলছে।
বিএডিসির পানাসি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক সাজ্জাদ হোসেন ভুঞা বলেন, বিলের পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হওয়ায় প্রতিবছর বর্ষায় নদ-নদী, নালা ও খালে ৮ থেকে ১৬ ফুট পর্যন্ত পলি জমছে। এতে প্রতি ১০ বছর অন্তর গড়ে ১২ ফুট পর্যন্ত নালা-খাল ভরাট হচ্ছে। এতে ভূ-উপরিস্থ পানি সংরক্ষণ না থাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। একদিকে মৎস্য সম্পদ বিলুপ্ত ও অন্যদিকে সেচের পানি না পেয়ে কৃষক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন।

পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ জেলা মৎস্য অফিসের তথ্যমতে, ২৫ বছরে চলনবিলে মাছের উৎপাদন কমেছে ৭২ দশমিক ৫ শতাংশ। গড় উৎপাদন কমেছে ১২ দশমিক ১ শতাংশ। প্রতিবছর উৎপাদন কমেছে ৩ শতাংশ।

মার্চ মাসে কয়েক দফা চলনবিল ঘুরে দেখা গেছে, বিশাল জলরাশির চলনবিল এখন পানিশূন্য। চলছে ফসলের আবাদ। বিলের চাটমোহর অংশে বড়াল নদে পানি নেই। কচুরিপানা ও ময়লা আবর্জনায় ঠাসা। উপজেলার বিলচলন ইউনিয়নের হান্ডিয়াল বোথর মাঠ। পানির জন্য হা–হুতাশ কৃষকের। মাঠের পর মাঠ আবাদ হয়েছে বোরো ধান।

চাটমোহর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বলেন, একদিকে ভূ-উপরিস্থ পানি না থাকা, অন্যদিকে ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণেই পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। সংকট মোকাবিলায় আপাতত মাটি খুঁড়ে কিছুটা নিচে সেচযন্ত্র বসিয়ে পানি তুলতে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমাতে কৃষককে বোরো আবাদে অনুৎসাহিত করা হচ্ছে। চলনবিল রক্ষা আন্দোলন কমিটির সদস্যসচিব এস এম মিজানুর রহমান বলেন, চলনবিল রক্ষায় প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। পরিকল্পনা, ভূমি, কৃষি, পনি সম্পাদ, নৌ, স্থানীয় সরকার, মৎস্য ও পরিবেশসব মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে সঠিক পরিকল্পনায় কাজ করতে হবে। অপ্রয়োজনীয় ব্রিজ-কালভার্ট ও স্লুইসগেট অপসারণ করতে হবে। বাণিজ্যিক পুকুর খনন বন্ধ করতে হবে। তবেই চলনবিল প্রাণ ফিরে পাবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ফসলের উৎপাদন কমছে

২২ মার্চ, ২০২২
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ