পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
রাজধানীর ভাটারা এলাকায় রিকশার গ্যারেজে কাজ করেন হারুন মিস্ত্রি। দৈনিক ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় তার। আগে এই টাকা দিয়েই সংসার চালালেও এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ায় খরচ কমানোর চেষ্টা করছেন। ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় আমিষ খাওয়া বন্ধ করার পাশাপাশি ছেলের স্কুলে যাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছেন তিনি। হারুনের স্ত্রী চম্পা আক্তার বলেন, ঘর ভাড়া, চার জনের খরচ মিলিয়ে আর কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। এজন্য খাবারের তালিকায় কাটছাট করতে বাধ্য হয়েছেন। পড়ালেখা করালে খাতা, কলম, স্কুলে গেলে আরও কিছু খরচ আছে। এগুলো এখন আর সামর্থে কুলাতে পারি না। খাবারই জুটাতে পারি না তাহলে ছেলে-মেয়েকে পড়াবো কিভাবে?
ঠাকুরগাঁওয়ের মহলবাড়ি গ্রামের রমিজউদ্দিনের ছেলে মহলবাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। বাবা ভাটা শ্রমিক পড়াশুনার খরচ বহন করতে না পারায় এখন বাবার সাথেই ইট ভাটাতে কাজ করছেন। রাজধানীর পুরান ঢাকায় করোনাকালে কর্মহারা হন সিফাতের বাবা। এরপর থেকেই স্কুল ছেড়ে নিমতলীর পুরনো কম্পিউটার মেরামতের দোকানে কাজ করছে মাধ্যমিকে পড়া সিফাত।
এই চিত্র এখন শুধু হারুন দম্পত্তি, রমিজ উদ্দিন কিংবা সিফাতের নয়, সারাদেশের হাজার হাজার নি¤œবিত্ত পরিবার আর্থিক দুরবস্থার কারণে সঙ্কটে পড়েছেন। টান পড়েছে সংসারের খরচে। আয় না বাড়লেও তাল দিয়ে বেড়েছে ব্যয়। করোনাকালেই বিনোদন, ফ্যাশন (কাপড়-চোপড়), প্রসাধনীতে ব্যয় কমিয়েছে নি¤œ-মধ্যবিত্তরা। এবার হাত দিচ্ছে হচ্ছে খাবারে। সেটিতেও তাল মেলাতে না পারলে সন্তানের পড়াশুনা বন্ধ করে পাঠানো হচ্ছে কাজে। করোনার আর্থিক প্রভাব এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি নি¤œ ও মধ্যবিত্তরা। এরই মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় তাদের ক্ষেত্রে মরার উপর খাড়ার ঘাঁ হিসেবে দেখা দিয়েছে। ফলে একদিকে যেমন বাড়ছে ঝরে পড়া শিক্ষার্থী। অন্যদিকে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীই পড়াশুনা শেষ না করেই প্রবেশ করছে কর্মক্ষেত্রে।
করোনার সময়ে দেশের অনেক কিন্ডারগার্টেন এবং নন-এমপিও স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। এসকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের একটি অংশ স্থায়ীভাবে ঝরে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। দেশে বাংলা মাধ্যমের কিন্ডারগার্টেন আছে ৪০ হাজার। এর বেশিরভাগই প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এরমধ্যে করোনার সময়ে আর্থিক দুরবস্থার কারণে ১০ হাজার স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসেসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, করোনা সময় অনেক প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তবে গতমাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পর অনেক স্কুলই আবার চালু হচ্ছে।
শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ২০ ভাগ শিক্ষার্থী এরই মধ্যে ঝরে পড়েছে। তবে এখনো যারা আসছে তাদের বেশিরভাগই ভর্তি ও বেতন মওকুফের আবেদন করছেন। প্রায় প্রতিটি শিক্ষার্থীরই অভিভাবকের একই কথা যে, আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, অনুরোধ করছেন বেতন ও ভর্তি ফি কমানোর জন্য। এখনো ৬০ ভাগ শিক্ষার্থীই তাদের জানুয়ারি-ফেব্রæয়ারি মাসের বেতনও পরিশোধ করেননি বলে জানান তিনি।
ইউনেস্কো জানিয়েছে- মহামারী চলাকালে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে স্কুল বন্ধ থাকা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭০ লাখ শিশুর পড়াশোনা ব্যাহত হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিস, ইউনিসেফ ও বিশ্বব্যাংক-এর সহায়তায় গেøাবাল এডুকেশন এভিডেন্স অ্যাডভাইজরি প্যানেলের (জিইইএপি) নতুন এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নি¤œ ও মধ্যম আয়ের দেশ এবং নি¤œ আর্থ-সামাজিক অবস্থানে থাকা শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উচ্চ-আয়ের দেশগুলোর তুলনায় স্কুলগুলো গড়ে বেশি দিন বন্ধ ছিল, স্কুল বন্ধের সময় শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ বলতে গেলে পায়নি বা পেলেও খুব কম পেয়েছে এবং সংকটের চ্যালেঞ্জগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নিতে অভিযোজন প্রক্রিয়াও ছিল কম। দূরশিক্ষণ প্রচেষ্টার কার্যকারিতা যে তুলনামূলকভাবে কম সে বিষয়ে ক্রমেই তথ্য-প্রমাণ মিলছে। তথ্য অনুযায়ী, স্কুল বন্ধ থাকার কারণে শিশুদের পড়াশোনা ও সামগ্রিক কল্যাণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে, যার পরিণাম আগামী কয়েক দশক ধরে অনুভূত হবে।
নরসিংদী জেলার মনোহরদীর শুকুন্দী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. মোস্তফা কামাল বলেন, দ্বিতীয় দফা বন্ধের পর প্রতিষ্ঠান খুলে দিলে শিক্ষার্থীরা স্কুলে ফিরছে। করোনা মহামারির আগের সময়ে যেভাবে পুরোদমে লেখাপড়া চলমান ছিলো আমাদের এখানে এখন সেভাবেই স্কুলগুলোতে পাঠদান চলছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকও এর ব্যতিক্রম নয়। করোনাকালে ছাত্রদের একটি বড় অংশই কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেন। আর ছাত্রীদের বিয়ের হারও ছিল উল্লেখযোগ্য। জানা যায়, কুড়িগ্রাম সদর উপজেলায় ঝরে পড়েছে ১ হাজার ৯৪৬ জন শিক্ষার্থী। যাদের বেশিরভাগই শিশুশ্রমে জড়িয়ে পড়েছে। উলিপুর উপজেলার দলদলিয়া ইউনিয়নের দলদলিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মোন্নাফ আনছারি জানান, করোনার বন্ধের পর প্রথম দফায় বিদ্যালয় খুললে কয়েকদিন অনুপস্থিতির কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যায় অনেকের বিয়ে হয়ে গেছে। কেউবা কাজে যোগ দিয়েছে।
দিনাজপুরের ফুলবাড়ী বঙ্গবন্ধু সরকারি কলেজের এক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নতুন করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পর থেকেই শিক্ষার্থীর উপস্থিতি সংখ্যা হাতে গোনা কিছু। অনেক শিক্ষার্থীকে ক্লাসে পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, আমরা যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি। বেশিরভাগই কাজে যোগ দিয়েছে। এদেরকে ফেরানো কঠিন।
এদিকে করোনা শুরুর পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রেও ব্যাপক প্রভাব পড়ে। প্রয়োজনীয়সংখ্যক শিক্ষার্থী পাচ্ছে না বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। স্নাতক-স্নাতকোত্তরে মোট আসনের প্রায় অর্ধেকই খালি থাকছে। এর মধ্যে প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে পেছনের সারিতে থাকা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের ওপর যে মানসিক ও আর্থিক চাপ পড়েছে সেটি তাদের ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারি প্রভাব ফেলবে। কেউ কেউ হয়তো অর্ধশিক্ষিত হয়ে কর্ম ক্ষেত্রে প্রবেশ করছে, অনেকেই আবার নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বেসরকারি সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) বলছে, করোনায় বাংলাদেশ দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৪২ শতাংশ হয়েছে। আগে এটা ছিলো ২০.৫ শতাংশ। চরম দরিদ্র অবস্থার মধ্যে আছেন ২৮.৫ শতাংশ মানুষ। করোনায় বাল্য বিয়েও বেড়েছে। এই সবগুলোর অভিঘাতই পড়েছে শিক্ষার উপর। বাংলাদেশে সাধারণভাবে প্রাথমিক পর্যায়ে ড্রপআউট শতকরা ১৭ ভাগ। মাধ্যমিক পর্যায়ে ৩৭ ভাগ। করোনার প্রভাবে এটা বাড়বে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক প্রফেসর ড. সিদ্দিকুর রহমান মনে করেন, যাদের তথ্য প্রযুক্তির সুবিধা ছিলো তারা অনলাইনে ঠিকমত শিখতে পারেনি। যাদের ছিলোনা তারা তো শিখেইনি। আর এই দেড় বছর ঘরে থাকার কারণে অনেকের লেখাপড়ার প্রতি অনাগ্রহ তৈরি হয়েছে। করোনায় স্কুল পড়ুয়া মেয়েকে ঘরে বসিয়ে না রেখে অনকে বিয়ে দিয়ে তাদের শিক্ষাজীবন শেষ করে দিয়েছে। ফলে এসব নিয়ে পরিকল্পিতভাবে কাজ না করলে ড্রপআউট ঠেকানো যাবেনা।
করোনার কারণে কি পরিমাণ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে তার সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে নেই জানিয়ে এক কর্মকর্তা বলেন, অনেক আগে থেকেই এটির তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের একটি সেল এটি নিয়ে কাজ করছে।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, মহামারীকালে বিশ্বের অন্য যে কোনো জায়গার মতো বাংলাদেশেও নজিরবিহীন মাত্রায় লাখ লাখ শিক্ষার্থীর পড়াশোনা ব্যাহত হয়েছে। এই শিশুদের ভবিষ্যৎ এবং বর্তমানে তাদের সার্বিক কল্যাণের স্বার্থে পড়াশোনার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য বিনিয়োগ করা এবং সব শিশু যাতে স্কুলে ফিরে আসে এবং পড়াশোনা চালিয়ে যায় তা নিশ্চিত করা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমরা মিশ্র শিক্ষার দিকে অগ্রসর হচ্ছি এবং সরকার তার অংশীদারদের সহযোগিতায় সেই লক্ষ্য পূরণে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ।
সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, দ্রব্যমূল্যের যে পরিস্থিতি সেটা আরও বেশ কিছুকাল থাকবে। বৈশ্বিক যে মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে তার একটা প্রতিক্রিয়া আমাদের এখানে আছে। প্রতিক্রিয়াটা আরও কিছুদিন থাকবে সেই আশঙ্কা করা যায়।
তিনি বলেন, সরকার যেটা করতে পারে সেটা হচ্ছে যে, কভিডের শুরুর দিকে সরকার যেমন ৩২ লাখ পরিবারকে দেয়া হয়েছিল। এ সময়েও চাইলে সেরকম কিছু ক্যাশ সাপোর্টের কথা ভাবতে পারে। নির্দিষ্ট সংখ্যক পরিবার সেটা যদি ৫০ লাখেরও বেশি হয়, তাহলে আরও ভালো। যাদের ডেটা আছে, এ ধরনের পরিবারগুলোকে যদি সল্পমূল্যে পণ্য সরবরাহ অথবা ৩০ কেজি চাল বা ক্যাশ সাপোর্টও দিতে পারে। তাহলে অন্তত সাময়িকভাবে হলেও বাড়তি ব্যয় কমানোর সুযোগ তৈরি হবে।
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এই পরিস্থিতির মধ্যে মধ্যবিত্ত সবসময়ই চাইবে খরচের মাত্রা যতটা সম্ভব ন্যূনতম মাত্রায় বা সীমিত রাখা যায়, সেদিক থেকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে তাকে যতটা সাশ্রয়ী করা যায়, সেদিকে গুরুত্ব দেয়া। পাশাপাশি শিক্ষাসংক্রান্ত বিষয়ে সরকার স্কুলে বেতন ভাতাদি সেগুলো যদি মাস দু-তিনের জন্য স্থগিত রাখা এবং পরবর্তীতে কয়েকটা স্টেপে যদি এটা আদায় করা যায়-তাহলে হয়তো শিক্ষার্থীদের উপরে বেতনের কারণে যে স্কুলে না যাওয়া সেটা কিছুটা হলেও রহিত করা যায়। এ ধরনের উদ্যোগও সরকার চিন্তা করতে পারে।##
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।