পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
গ্রীষ্মকাল আসার আগেই চট্টগ্রামের পাহাড়ি খরস্রোতা নদীগুলো শুকিয়ে পানি তলানিতে : মারাত্মক দূষণে বিষিয়ে উঠেছে কর্ণফুলী
ফল-ফসল মৎস্যসম্পদ পরিবেশ প্রকৃতিতে বিপর্যয় : নদ-নদীর মরণদশায় সেচের পানির সঙ্কটে কৃষকের মাথায় হাত
ভ্রুণের মধ্যেই নদীকে মেরে ফেলা হচ্ছে’ : প্রফেসর ড. মনজুরুল কিবরীয়া
সবেমাত্র ফাল্গুন মাস। চৈত্র, বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ গ্রীষ্মকাল আসার আগেই চট্টগ্রামের খরস্রোতা পাহাড়ি অববাহিকার নদীগুলো শুকিয়ে গেছে। পানির প্রবাহ প্রায় তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। ধু ধু বালুচরে ঢাকা পড়েছে নদ-নদী। এখানে-সেখানে ভরাট নদীর বুকে ধুলোবালি উড়িয়ে কিশোর-যুবকদের খেলাধুলায় মেতে থাকতে দেখা যায়। শুষ্ক মৌসুম শুরু হতে না হতেই বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান নদ-নদী, খালগুলোতে বিস্তীর্ণ এলাকায় পানি শুকিয়ে চর পড়ে গেছে। চরের জমিতে শাক-সবজি, ফল-মূল, বাদাম ছাড়াও বিষাক্ত, পরিবেশঘাতী তামাক চাষ হচ্ছে। ঘাস, উলুবন, আগাছায় ছেয়ে গেছে নদীর চরের জমি। অনেক চর ও পলিমাটির জমিতে বসতঘরসহ অবৈধ বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে উঠছে। ক্ষীণ ধারায় বইছে নদী। বিশুদ্ধ খাবার পানি এবং সেচের পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে।
পার্বত্য অববাহিকা তথা বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রবাহিত প্রধান নদ-নদী হচ্ছে কর্ণফুলী, মাতামুহুরী, হালদা, সাঙ্গু, ফেনী, ইছামতী, মুহুরী, ডলু, ধুরং, গজারিয়া ইত্যাদি। উজানে পার্বত্যাঞ্চলে নদ-নদীসমূহের উৎসস্থলে ঝরণা, খাল-ছরাগুলোতে পানির প্রবাহ অনেকটাই শুকিয়ে গেছে। এতে করে এসব নদীর পানির ধারা শুকিয়ে ক্ষীণ হয়ে গেছে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের এক ডজনেরও বেশি নদ-নদীর যেদিকে চোখ যায় শুধুই ধু ধু বালুচর। নাব্যতা হারিয়ে ফেলায় নদ-নদীতে ট্রলার-নৌকা-সাম্পান, নৌযান আটকে যাচ্ছে। জেলেরা সারাদিন জাল ফেলেও তেমন মাছ পাচ্ছে না। অবাধে পাহাড় কাটা, বন-জঙ্গল ধ্বংস, নদী ভরাট, দূষণ, সবধরনের বর্জ্য ডাম্পিং ও তীরভূমি বেদখলের পরিণামে চট্টগ্রাম অঞ্চলের নদ-নদীর প্রাাকৃতিক স্বাভাবিক প্রবাহ প্রায় অবরুদ্ধ।
কৃষি-খামার, ফল-ফসলের সেচকাজ, মৎস্যসম্পদ, পরিবহন, পর্যটনসহ সামগ্রিকভাবে পরিবেশ-প্রকৃতির উপর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়েছে। নদীগুলোর তলদেশ ব্যাপক ভরাট হয়ে গেছে। নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে নেই খনন কাজ। আগামীতে ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। মূল নদ-নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ার ফলে নদীর সাথে যুক্ত চট্টগ্রাম অঞ্চলে খাল-ছরা, বিল ও জলাশয়ের ভূগর্ভস্থ পানির স্তরেও টান ধরেছে। পানির রিজার্ভ দ্রæত কমতে শুরু করেছে। এতে করে পরিবেশ-প্রতিবেশ হয়ে উঠেছে রুক্ষ। হাজার হাজার হেক্টর জমি অনাবাদী পড়ে আছে সেচ সঙ্কটের মুখে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে তিন ফসলা চাষ হতো এমন বিস্তীীর্ণ জমি আবাদ হচ্ছে দো-ফসলা। দো-ফসলা জমিতে এক ফসল ফলানোই কঠিন হয়ে পড়েছে। এবার আগেভাগেই নদ-নদীর মরণদশায় পানির সঙ্কটে কৃষকের মাথায় হাত।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের নদ-নদীর মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪ হাজার ১৪০ কিলোমিটার। মোট নদ-নদী ও উপনদীর সংখ্যা ৭শ’। দেশের ৪টি নদ-নদী অববাহিকা হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা-পদ্মা, মেঘনা এবং দক্ষিণ-পূর্ব পার্বত্য অববাহিকা। পার্বত্য অববাহিকার নদ-নদীগুলো মূলত বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহিত। এবার গ্রীষ্ম মওসুম আসার আগেই চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাহাড়ি নদীগুলো স্বাভাবিক গতিধারা হারিয়ে অনেক স্থানে বইছে খাল-ছরা কিংবা নালার মতো। উঁচু-নিচু টিলাময় চট্টগ্রাম অঞ্চলে ইতিমধ্যে খরার পদধ্বনি দেখা দিয়েছে। পার্বত্য জেলাগুলোতে বিশেষ করে দক্ষিণ চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান অঞ্চলে নৌপথে যাত্রী এবং মালামাল পরিবহনে সঙ্কট তৈরি হয়েছে নদীগুলো একযোগে নাব্যতা হারানোর কারণে।
পার্বত্য অববাহিকার নদ-নদী বিশেষজ্ঞ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. মনজুরুল কিবরীয়া গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, পাহাড়ি সবগুলো নদী শুকিয়ে গেছে। এর মূল কারণ বন ধ্বংস। পাহাড়ে গাছপালা ফাঁকা। জুম চাষের জন্য পাহাড়ে আগুন দেয়া হচ্ছে। ঝরণাগুলো শুকিয়ে গেছে। নদীগুলোর উৎস দুই পাহাড়ের মাঝখানে গিরিখাদ। সেখানে পাহাড়িরা বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ ও সেচ প্রকল্প করছে। ভ্রæণের মধ্যেই নদীকে মেরে ফেলা হচ্ছে। এসব কারণে কর্ণফুলী, হালদা, সাঙ্গু, মাতামুহুরী নদী পানিশূণ্য হয়ে গেছে। নদীগুলোকে শুকিয়ে বর্জ্যরে ভাগাড়ে পরিণত করা হয়েছে। ফেনী নদীর পানি ভারত যথেচ্ছ তুলে নিয়ে যাচ্ছে। সাঙ্গু নদীর উজানে ব্যাপকভাবে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। পাহাড়ি নদীগুলোর উৎস ও গতিপথে হাজার হাজার একর জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে। বিষিয়ে উঠেছে নদীর পরিবেশ।
ভাগাড়ে পরিণত কর্ণফুলী
কর্ণফুলী নদী বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। এটি দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদী। প্রধান সমুদ্র বন্দরের ধারক। নদীটির গতিপথের দৈর্ঘ্য ৩২০ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৪৫৩ মিটার। গতিপথ সাপের মতো আঁকাবাঁকা। কর্ণফুলী নদী ভারতের লুসাই পাহাড় থেকে উৎসারিত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গার কাছে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। এখানেই দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর গড়ে উঠেছে হাজার বছরের পথ পরিক্রমায়।
সাড়ে ৫শ’ ছোট-বড় শিল্প-কারখানা, দেশি-বিদেশি জাহাজ কোস্টার নৌযান ট্রলারের বিষাক্ত বর্জ্য-ময়লা-জঞ্জাল ও আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে কর্ণফুলী নদী। ক্রমেই বিষিয়ে উঠেছে পানি। নদীর পানির স্বাভাবিক রঙ, গন্ধ ও স্বাদ আর অবশিষ্ট নেই। ৭০ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত চট্টগ্রাম নগরীর বিশাল অংশের নগর-বর্জ্যরে ঠিকানা কর্ণফুলী। বিলুপ্ত হচ্ছে এ নদীর হাজারো জীববৈচিত্র্য। এককালে হরেক প্রজাতির চিংড়িসহ সুস্বাদু মাছের খনি কণফুলী নদী এখন প্রায় মাছশূন্য হয়ে পড়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের জরিপ মতে, কর্ণফুলী নদীতে মিঠা পানির ৬৬ প্রজাতির, মিশ্র পানির ৫৯ প্রজাতির এবং সামুদ্রিক পরিযায়ী ১৫ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেতো। ব্যাপক নদীদূষণের কারণে ইতোমধ্যে মিঠাপানির অন্তত ২৫ প্রজাতির এবং মিশ্রপানির ১০ প্রজাতির মাছ এখন বিলুপ্তপ্রায়। এছাড়া আরও ১০ থেকে ২০ প্রজাতির অর্থকরী মাছ বিপন্ন তালিকায়।
ফেনী নদী : খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার গোড়ায় উৎপত্তি হওয়া ফেনী নদী ১৫৩ কিলোমিটার গতিপথে খাগড়াছগিসহ চট্টগ্রাম ও ফেনীর সীমানা দিয়ে প্রবাহিত। নদীর অপর প্রান্তে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। নদীটির গড় প্রস্থ ১৫৯ মিটার। পাহাড়ি অববাহিকার অন্যতম খরস্রোতা ফেনী নদী খুব দ্রæতই সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। এর কারণ খাগড়াছড়ির রামগড়, চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি-মীরসরাই সীমান্ত বরাবর নদীটির গতিপথ ঘেঁষে ভারত শতাধিক পাম্পহাউজ স্থাপন করে অবিরাম ফেনী নদীর পানি তুলে নিচ্ছে। ওপারে সেচ সুবিধায় কাজে লাগাচ্ছে। তাছাড়া বিভিন্ন স্থানে বেপরোয়া বালু উত্তোলনের ফলে নদীটির স্বাভাবিক প্রবাহ বিপর্যস্ত। এরফলে স্বাভাবিক খরস্রোতা হারিয়ে ফেনী মরা নদীতে পরিণত হচ্ছে। সেচকাজ, চা আবাদসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পড়েছে এর বিরূপ প্রভাব।
মাতামুহুরী নদী : পার্বত্য বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত ২৩৮ কিলোমিটার দীর্ঘ নদী মাতামুহুরী। এটি চকরিয়া হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। পাহাড়ি খরস্রোতা মাতামুহুরী নদীতে জেগেছে ধু ধু বালুরচর। সুস্বাদু মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। ফসল সেচে সঙ্কট বাড়ছে। উজানে পাহাড় ও বনাঞ্চল ধ্বংসের কারণে এ নদী সঙ্কটাপন্ন। নদীর বুকে পরিবেশঘাতী তামাক চাষ হচ্ছে।
সাঙ্গু নদী : বান্দরবান ও চট্টগ্রাম জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত ২৯৪ কি.মি. দীর্ঘ পাহাড়ি খরস্রোতা নদী সাঙ্গুর গতিপথে বিশাল অংশজুড়ে বালুচর। এ নদীর দখল, দূষণ ও ভরাট বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুই জেলার লাখ লাখ মানুষের চাষাবাদ, জীবন-জীবিকা, প্রাকৃতিক সম্পদ, পর্যটন, পরিবহন, জীববৈচিত্র্যের সাথে সাঙ্গু নদী জড়িয়ে আছে।
হালদা নদী : খাগড়াছড়ি থেকে উৎসারিত এ নদী চট্টগ্রামের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ১০৬ কি.মি. গতিপথ নিয়ে কর্ণফুলী মোহনায় মিশেছে। হালদা এশিয়ায় মিঠাপনির প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র। এ নদীকে সরকার ‘বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ’ ঘোষণা করেছে। হালদায় রুই, কাতলা (কার্প) জাতীয় বড় মাছের ডিম ও রেণু থেকে উৎপন্ন শত শত কোটি টাকার পোনা প্রতিবছর সমগ্র দেশে মাছ চাষে ‘বীজ’ হিসেবে পৌঁছে যায়। হালদার উৎস ও গতিপথে দূষণ, ভরাট মারাত্মক আকারে অব্যাহত রয়েছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।