Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গমের দাম যুদ্ধের অজুহাতে বাড়ছে

পণ্য আমদানি প্রক্রিয়া স্বাভাবিক রয়েছে : খাদ্য সচিব মজুদ রয়েছে ২ লাখ ২৩ হাজার মেট্রিক টন সরকারের বাজার মনিটরিং জোরদার করা প্রয়োজন : ড. মোস্তাফিজুর রহমান

রফিক মুহাম্মদ | প্রকাশের সময় : ৫ মার্চ, ২০২২, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশের বাজারে এবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের উত্তাপ এসে লেগেছে। এর আগে ব্যাবসায়ীরা নানা অজুহাতে বিভিন্ন পণ্যে দাম বাড়িয়েছেন। এবার তারা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাতে আমদানি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করছেন। এর মধ্যে ভোজ্য তেলের বাজারে চলছে চরম অস্থিরতা। এর বাইরে রাশিয়া এবং ইউক্রেন থেকে যেসব পণ্য আমদানি করা হয় সেগুলোর দামও যুদ্ধের অজুহাতে ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে দিয়েছেন। এর মধ্যে গম হলো উল্লেখযোগ্য। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দেশে সব পণ্যের আমদানি স্বাভাবিক রয়েছে। যুদ্ধের কারণে গম বা অন্য কোন পণ্যের আমদানিতে এখনো কোন প্রভাব পড়েনি। তাই বাজারে দাম বাড়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। তারপরও এক শ্রেণির ব্যবসায়ী যুদ্ধের অজুহাতে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।

দেশে মোট চাহিদার প্রায় ৮০ ভাগ গম বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি হয়। এর মধ্যে রাশিয়া, ইউক্রেন, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, তাঞ্জানিয়া, কেনিয়া ও আর্জেন্টিনা থেকে গম আমদানি হয়। এসব দেশের মধ্যে শুধুমাত্র দুটি দেশে যুদ্ধ লেগেছে। বাকি দেশ থেকে চাহিদার বিপরীতে গম আমদানি হচ্ছে। যুদ্ধ শুরুর পর শুধু রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে জাহাজীকরণ বন্ধ রয়েছে। তবে আগে থেকে জাহাজীকরণ হওয়া পণ্য আমদানি হচ্ছে। এক্ষেত্রে এত তাড়াতাড়ি দেশে গমের বাজারে প্রভাব পড়ার কথা নয় বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
বর্তমানে দেশে গমের চাহিদা ৫৫ লাখ মেট্রিক টন। এ চাহিদার বিপরীতে গত বছর দেশে গম উৎপাদন হয়েছে ১২ লাখ মেট্টিক টন। আর গম আমদানি হয়েছে প্রায় ৫৩ লাখ মেট্রিক টন। সে হিসাবে দেশে মোট সরবরাহকৃত গমের পরিমাণ ৬৫ লাখ মেট্রিক টন। যা মোট চাহিদার চেয়েও ১০ লাখ টন বেশি।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, বর্তমানে (২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) দেশে ১৯ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে। এর মধ্যে চাল ১৭ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন এবং গম ২ লাখ ২৩ হাজার মেট্রিক টন।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নাজমানারা খানুম গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য মজুদ রয়েছে। এ ছাড়া আমদানি প্রক্রিয়াও স্বাভাবিক রয়েছে। তাই কোনো পণ্যেরই দাম বাড়ার কারণ নেই। আমরা গভীরভাবে বাজার মনিটর করছি। কেউ যদি কারসাজির মাধ্যমে পণ্যের দাম বৃদ্ধি করে তাহলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের (এফএও) এক সেমিনারে বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশে চাল, গম, আলু, ডাল ও ভুট্টার যে মজুদ আছে তা দিয়ে চলতি বছরের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।
সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে (২০২০-২১) দেশে চাল ও গম আমদানি হয়েছে প্রায় ৬৬ লাখ ৫৩ হাজার মেট্রিক টন, যা গত চার দশকের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। আমদানীকৃত খাদ্যশস্যের এক-চতুর্থাংশ চাল, বাকিটা গম। এই আমদানি ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় প্রায় সাড়ে ৩ শতাংশ বেশি। এর আগে দেশে চার দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ খাদ্যশস্য আমদানি হয়েছিল ২০১৭-১৮ অর্থবছরে। ওই বছর দেশে খাদ্যশস্য আমদানি হয়েছিল ৯৭ লাখ ৭৪ হাজার টন।

বাংলাদেশে যে হারে ধানের উৎপাদন বেড়েছে সে হারে গম উৎপাদন বাড়েনি। প্রতিবছরই চাহিদা বাড়লেও সে অনুপাতে বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না পণ্যটির উৎপাদন। আবহাওয়াজনিত কারণে কয়েক বছর ধরে উৎপাদন ১১-১২ লাখ টনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। তাই আমদানীকৃত খাদ্যশস্যের বেশির ভাগই রয়েছে গমের দখলে। গত অর্থবছরে গম আমদানি হয়েছে ৫২ লাখ ৯৯ হাজার ৮৫০ টন।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) থেকে চলতি সপ্তাহে বিশ্বের খাদ্যশস্যের উৎপাদন ও আমদানির চিত্র নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সংস্থাটির হিসাব বলছে, বিশ্বের যে কটি দেশে সবচেয়ে দ্রুত হারে গমের আমদানি বাড়ছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। পাঁচ বছর আগেও গম আমদানিতে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ১০ দেশের তালিকার বাইরে ছিল বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ এই তালিকায় পঞ্চম দেশ।
দেশে পর্যাপ্ত গম আমদানি এবং মজুদ থাকার পরও যুদ্ধের অজুহাতে ব্যবসায়ীরা আগেভাগেই দাম বাড়াচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, কারসাজি করে, গুজব তৈরি করে যদি দাম বাড়ানো হয়, সেক্ষেত্রে নেওয়া হবে কঠোর ব্যবস্থা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত সপ্তাহে বাজারে গমের দাম ছিল মণপ্রতি এক হাজার ১২০ টাকা। ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে মণপ্রতি গম বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ২২০ থেকে এক হাজার ২৩০ টাকা। অর্থাৎ এক সপ্তাহের ব্যবধানে গমের দাম বেড়েছে মণপ্রতি ১০০ টাকা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, যুদ্ধ শুরুর আগে মানভেদে আন্তর্জাতিক বাজারে টন প্রতি গমের দাম ছিল ৩০০ থেকে ৩৬০ ডলার। যুদ্ধ শুরুর পর কানাডা-অস্ট্রেলিয়াসহ শীর্ষ গম উৎপাদনকারী বিভিন্ন দেশ দাম বাড়িয়ে ৪০০ থেকে ৪৫০ ডলার করেছে।

তবে কাস্টম ও আমদানির সঙ্গে জড়িত সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সূত্র জানায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে তার প্রভাব দেশের গমের বাজারে এখনো পড়েনি। এর মধ্যে আবার বর্তমানে ইউক্রেন-রাশিয়া ছাড়া অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি স্বাভাবিক রয়েছে। এছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে যুদ্ধের আগে যেসব গম জাহাজীকরণ হয়েছে, সেগুলো আমদানির প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এত তাড়াতাড়ি দাম বাড়া মানে এটি ব্যবসায়ীদের এক ধরনের কারসাজি।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ব্যবসায়ীরা সুযোগ পেলেই জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। এখন রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাতে ইতোমধ্যে তেল, গমসহ আমদানি নির্ভর বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে। যদি এটা দীর্ঘ সময় থাকে তবে সমস্যাটাও সুদূরপ্রসারী হতে পারে। রাশিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে। সেগুলোর সঙ্গে আবার বাংলাদেশের বিভিন্ন সম্পর্ক আছে। এই যুদ্ধ দীর্ঘদিন চললে সমগ্র বিশ্বকে একটা বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে। এটা খুবই বিপজ্জনক। সারা বিশ্বের অর্থনীতির ক্ষেত্রে, ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে, জিনিসপত্র পাঠানোর ক্ষেত্রে সমস্যার বিস্তৃতি ঘটাতে পারে। বাংলাদেশে পর্যাপ্ত মজুদ এবং সরবরাহ থাকার পরও ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াচ্ছে। সরকারের বাজার মনিটরিং ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে এটা হচ্ছে। তাই সরকারকে বাজার মনিটরিং আরও জোরদার করতে হবে।



 

Show all comments
  • Md Hakim ৫ মার্চ, ২০২২, ২:৩২ এএম says : 0
    এগুলি হচ্ছে অসাধু সিন্ডিকেটের লোকদের কাজ ,গম তো প্রতিদিন আমদানি করা হয় না হয়তো বছরে একবার দুবার বিদেশ থেকে আমদানি করা হয় কিন্তু যুদ্ধ লাগলো আজ আট দিন ,এই মুহূর্তে যুদ্ধের বরাত দিয়ে আটা-ময়দার দাম বাড়ানো ,এখানে কি সরকারের কোন করণীয় নাই ?নাকি আমরা সাধারন মানুষ না খেয়ে মরবো আর সরকারের কর্তাব্যক্তিরা হাসি ঠাট্টায় মগ্ন থাকবে সাধারণ জনগনকে নিয়ে
    Total Reply(0) Reply
  • MD Jahangir Khan ৫ মার্চ, ২০২২, ২:৩৩ এএম says : 0
    যুদ্ধ ছাড়া বাংলাদেশের সবকিছুর দাম বাড়তি যুদ্ধের কোন প্রয়োজন হয় না তার আগেই সব কিছুর দাম বেড়ে যায় বাংলাদেশে চোরের জন্য বিখ্যাত বাংলাদেশ দুর্নীতিবাজ
    Total Reply(0) Reply
  • MD Saiful Islam ৫ মার্চ, ২০২২, ২:৩৩ এএম says : 0
    এগুলো বলে আপনারা বাড়ার আগে বাড়িয়ে দিচ্ছেন
    Total Reply(0) Reply
  • Zihan Ali Pollob ৫ মার্চ, ২০২২, ২:৩৩ এএম says : 0
    এবার বুঝতে পারবে রাশিয়ার গুরুত্ব সারা বিশ্ব শুধু সামরিক সেক্টরের নয় বিশ্বের খাদ্য ভান্ডার ও রাশিয়া
    Total Reply(0) Reply
  • Sk Ashraful Asa ৫ মার্চ, ২০২২, ২:৩৪ এএম says : 0
    কি হবে ভাই,মেট্রোরেল,পদ্মাসেতু। যদি জিবনী না বাঁচে, যদি নিজের সন্তানের ক্ষুধার্থ দেখতে হয়,যদি মাস শেষে ঔষধ কেনার টাকা না থাকে,যদি সন্তাকে স্কুলে না পড়াতে পাড়ি,,,এ উন্নয়ন আমাদের কি কাজে আসবে,,,??সত্য হচ্ছে এটাই যে,সরকার যদি জনগনের ভোটের আশা করতো,তা হলে অবশ্যই পদক্ষেপ নিতো,সে যে সরকারি হোক না কেনো,,কিন্তু আমাদের দেশে তো জনগনের ভোটের প্রয়োজন নেই,তাই এটাই হবে আমাদের সাথে।নিরবে কন্নাছাড়া জনগনের কি বা করার আছে।।।
    Total Reply(0) Reply
  • Imran Selim ৫ মার্চ, ২০২২, ২:৩৫ এএম says : 0
    বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা সুযোগ খুঁজে কি ভাবে দ্রব্যমূল্যে বাড়ানো যায়। দ্রব্যমূল্যের সাথে যুদ্ধ করে সাধারণ মানুষ দিশেহার।
    Total Reply(0) Reply
  • Redwan Ahmed ৫ মার্চ, ২০২২, ২:৩৫ এএম says : 0
    রমযানের আগে তেলের দাম বাড়বে না, এ কথা বলেছি দুই দিন আগে।এ কথা বলতে না বলতেই গেছেকাল আবার বেড়েছে সয়াবিন তৈলের দাম।নিত্যপ্রয়োজনীয় পন্যের মূল্য এখন আকাশচুম্বী।
    Total Reply(0) Reply
  • Alamin Pondit shuvo ৪ মে, ২০২২, ১০:৪২ এএম says : 0
    আমাদের যাত্রাবাড়ী মাতুয়াইল এলাকায় গমের কেজি 38 টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে,এর একটা তীব্র প্রতিবাধ জানানো দরকার,আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষন করছি,,আপনারা যতো দ্রুত সম্ভব এই সমস্যার সমাধান করবেন।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ