ড. মুহাম্মাদ সিদ্দিক
৭ই নভেম্বর ১৯৭৫ একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ দিবস বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে। তবে এটা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। কতকগুলো দুঃখজনক ঘটনার পরিণতি ছিল এটা। গত বছর (৭ নভেম্বর ২০১৫) দেশ টিভিতে এ দিবস নিয়ে একটা আলোচনা অনুষ্ঠান চলছিল তাতে অনেকের সঙ্গে জাসদ নেতা মাহবুব কামালও ছিলেন। তার মন্তব্য গুরুত্বের দাবি রাখে। আসলে জাসদই তো ছিল এই ঘটনার ইতিহাসের প্রধান নায়ক। তিনি বলেন : ‘৭ নভেম্বর ছিল ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের চেইন রিএকসন।’ ৭ নভেম্বর রাত ১২.১ মিনিটে স্টাইক হবে, প্রস্তুত থাকবে সবাই (তিনি হাত দিয়ে গুলি করা দেখালেন)। তবে এটা ছিল সিপাহীর অভ্যুত্থান। জাসদ জনগণকে আনতে পারে নাই। তাহেরকে বোঝানো হয়েছিল আদমজী থেকে, অন্যত্র থেকে হাজার হাজার, লাখ লাখ লোক আসবে। তা হয় নাই। ... জিয়া-জাসদ ইউনাইটেড ফ্রন্ট নব্বই ঘন্টা টিকেছিল। ... ওসমানী সহযোগিতা করেন জিয়াকে ‘কনসলিডেট’ করতে। আওয়ামী লীগ যে বলে এটা মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবসÑ এটা ভুল ধারণা। ... ৭ নভেম্বরের পর অন্তত বাইশটা কুঁদেতা হয়েছিল।’
একই অনুষ্ঠানে সাংবাদিক মঞ্জরুল ইসলাম মন্তব্য করেন, ‘১৯৭২ সালে বিল্পবী সৈনিক সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। জাসদ সামরিক বাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।’
মহিউদ্দিন আহমদ লেখেন, ‘তাহের এবং লে. কর্নেল জিয়াউদ্দিন দুজনেই মনে করতেন, বাংলাদেশ ভারতের তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।’ ‘জাসদের উত্থানপতন অস্থির সময়ের রাজনীতি, (পৃঃ ১৫১)। জিয়া যে তাহেরের সঙ্গে কিছু যোগাযোগ রাখতেনÑ এই বিষয়টিও অন্যতম কারণ হতে পারে...। বঙ্গবন্ধু ইন্ডিয়ার তাঁবেদার ছিলেন না, তা গবেষণাভিত্তিক প্রমাণ করা যায়। আর জাসদও সম্পূর্ণ ইন্ডিয়াবিরোধী, তা নয় প্রমাণিত। বরঞ্চ ইউরোপীয় পিটার কাস্টার, ইন্ডিয়ার অনেক দল ও নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সিরাজুল আলম খান ও অন্যরা যোগাযোগ রাখতেন। সাবেক তথ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ড. আবু সাঈদ চব্বিশ টিভির এক অনুষ্ঠানে (৭ নভেম্বর ২০১৫) বলেন যে, সেই সময় পিটার কাস্টার আশি লাখ টাকা খরচ করেন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় যা জাতিকে বিভক্ত করে।
মহিউদ্দিন আহমদ লেখেন যে, ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানকারী জিয়ার বাসভবনের ড্রয়িংরুমের ফোন লাইন কেটে দিলেও শয়নকক্ষের ফোন ঠিকছিল, যার মাধ্যমে জিয়া কর্নেল তাহেরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন (পৃ: ২০৩)।
৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় জাসদের পার্টি ফোরামের ইমার্জেন্সি স্টাডিং কমিটির বৈঠক বসে ঢাকার কলাবাগানের এক বাসায়। এই কমিটির সদস্য ছিলেন সিরাজুল আলম খান প্রমুখ। কর্নের তাহের সরকারি চাকরিতে থাকায় এ কমিটিতে ছিলেন না। তবে তিনি কমিটির সভায় থাকতেন। তাহের উপস্থিত সবাইকে জানান, জিয়া টেলিফোনে তাঁকে বাঁচানোর অনুরোধ করেছেন। কিছুক্ষণ পর সেনাবাহিনীর একজন তরুণ কর্মকর্তা আসেন সিভিল পোশাকে। তিনি একটা চিঠি তাহেরকে দেন যা নাকি জিয়ার লেখা। এতে লেখা ছিল ইংরেজিতে : ‘আমি বন্দী, আমি নেতৃত্ব দিতে পারছি না। আমার লোকেরা তৈরি তুমি যদি নেতৃত্ব দাও, আমার লোকেরা তোমার সঙ্গে যোগ দেবে।’ এই তথ্য মহিউদ্দিন আহমদ দিয়েছেন ‘খয়ের এজাজ মাসুদের সঙ্গে আলাপচারিতা উল্লেখ করে (পৃ: ১৯৩ ও ২২৬)।
রাতে জিয়ার যে ভাষণ সেনানিবাসে রেকর্ড করা হয় তা ৭ নভেম্বর সকালে রেডিওতে প্রচার করা হয়। এতে তিনি বলেছিলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জনগণ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ, আনসার এবং অন্যদের অনুরোধে আমাকে সাময়িকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ও সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হয়েছে। জিয়ার ভাষণে জাসদ, গণবাহিনী বা তাহেরের নাম ছিল না। তবে সেদিন সন্ধ্যায় বিচারপতি সায়েম বেতার ও টেলিভিশনের ভাষণে রাষ্ট্রপতি হিসাবে বলেন, “রাষ্ট্রপতি স্বয়ং প্রধান সাময়িক প্রশাসন হবেন।”
৭ নভেম্বর ৭৫-এ জিয়া যে পূর্ণ সিএমএলএ হতে পারেন নাই, এটাই প্রমাণ করে যে তিনি পূর্ণ নায়ক ছিলেন না সেইদিন সেইসব ঘটনাবলীর জন্য। তাঁর স্ত্রী তো সাংঘাতিকভাবে বাধা প্রদান করেন বাসা থেকে বের হয়ে সিপাহীদের সঙ্গে যেতে। তাকে এক প্রকার ধরেই নিয়ে যাওয়া হয়। এরই নাম তকদির।
এম এ হামিদ তার ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’ বইয়ে বলেছেনে যে কর্নেল তাহের জিয়াকে “ক্ষমতাহীন পুতুল-স¤্রাট (পৃ. ১৪৪) বানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা তো জিয়া বেঁচে থাকলে।” এম এ হামিদ নিজেই লিখিছেন, “(৭ নভেম্বর ৭৫) অভ্যুত্থানের পরপরই মধ্যরাতে তাহের ও জিয়া গদি দখলের প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে লিপ্ত হন। ঐ সময় দু’জনের যে কোনও একজন নিহত হতে পারতেন। আশপাশে ছিল অস্ত্রের ঝনঝনানি।” (পৃ. ১৪১)। জিয়া যদি সেদিন এলিফ্যান্ট রোডে বা রেডিও স্টেশনে বা শহীদ মিনারের যেতেন, তাহলে অস্ত্রের “ঝনঝনানি”তে তাঁর জীবন বিপন্ন হতে পারত। তাকে রুশ বিপ্লবের লেনিন-পূর্ব নেতা ক্রেনস্কির মত ব্যবহার করা হত।
মহিউদ্দিন আহমদের (বিএলএফের সদস্য হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা, অধুনালুপ্ত দৈনিক জনকণ্ঠের সহকারী সম্পাদক ও বিশিষ্ট জাসদ নেতা বই “জাসদের উত্থানপতন অস্থির সময়ের রাজনীতি”। ইতিহাসের বেশ কিছু রয়েছে এতে। তিনি একজন প্রত্যক্ষদর্শী নেতা। তাঁর সাড়া জাগানো বই “জাসদের উত্থানপতন অস্থির সময়ের রাজনীতি।” এতে সে সময়ের অনেক কথাই রয়েছে। মহিউদ্দিন আহমদ বলেন যে, ড. আনোয়ার হোসেন লেখেন, “ঢাকা শহর গণবাহিনীর অধিনায়ক আমি। সরাসরি হাসানুল হক ইনুর অধীনে। তার কাছ থেকেই দলীয় নির্দেশ পেতাম। সে সময় ঢাকায় আমার নেতৃত্বে গণবাহিনীর প্রায় ছয়শত নিয়মিত সদস্য।” লে. জেনারেল মঈনুল হোসেন, ২০০৩ এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা পৃ: ৪৩) (মহিউদ্দিন, আহমদ পৃ: ২২২)।
যাই হোক তাহের তথা জাসদ ৭ নভেম্বর শুরু করলেও নীতিগত পার্থক্যের জন্য তাহের জিয়া পৃথক হয়ে যান। ইতিহাস তার তকদিরের দিকে চলে। লে. কর্নেল এম এ হামিদ (অব:) লেখেন,
“৯ তারিখ (নভেম্বর ৭৫) জিয়াউর রহমান বিভিন্ন ইউনিটের জেসিও এবং এনসিওদের সাথে বেশ কিছু মিটিং করলেন। তাদের অনুরোধ করলেন, সৈনিকদের ব্যারাকে ফিরে আসার এবং অস্ত্র জমা দেয়ার জন্য বুঝিয়ে বলতে। তাদের দাবি-দাওয়া আস্তে আস্তে মানা হবে। জেসিওরা শান্ত হলেও সিপাহীরা অশান্ত থেকেই গেল। জিয়া তাদের দাবি-দাওয়া না মানাতে তারা বিদ্রোহী মনোভাব নিয়ে ঠায় বসে রইল। বিভিন্ন দিকে তারা মিটিং করতে থাকল। জিয়া সুকৌশলে জেসিও এবং এনসিওদের তার কাছে ভেড়াতে সচেষ্ট হলেন।”
“ঐ সময় একমাত্র জিয়া ছাড়া আর সব কমান্ড-চ্যানেল ভেঙ্গে যায়। আর্মি চিফ অব স্টাফ জেনারেল জিয়া সরাসরি জেসিও এমনকি সিপাই প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করছিলেন। টু-ফিল্ডের সুবেদার মেজর আনিসুল হক চৌধুরী এই সময় জিয়ার পাশ থেকে সৈনিকদের বোঝাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।”
“সারাদিন কোন বড় রকম হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেনি। অবশ্য পুরো দিন ক্যান্টিনমেক্টে কোন অফিসারও ছিলেন না। অফিস কাজকর্ম ছিল সম্পূর্ণ বন্ধ। সর্বত্র বিরাট অচলাবস্থা। অরাজকতা। অফিস, ব্যারাক সিপাহীদের দখলে। বিপ্লবীরা সর্বত্র ঘুরে ফিওে সৈনিকদের উত্তেজিত করছিল। দাবি-দাওয়ার প্রচুর লিফলেট সর্বত্র বিতরণ কর ছিল।”
“অবাক ব্যাপার। ঢাকা শহরে ছিল সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা। সাধারণ মানুষ অনেকেই ক্যান্টিনমেন্টের এই অস্বাভাবিক ঘটনার কথা টেরও পায়নি। ঐদিন বিকেলে জাসদের একটি বিজয় মিছিল ও মিটিং অনুষ্ঠিত হল বায়তুল মোকাররমে। জিয়ার নির্দেশে পুলিশ গুলি চালিয়ে তা ভেঙ্গে দিল। বিভ্রান্ত জনগণ। একবার শোনে সেপাহী বিপ্লব। জাসদের বিপ্লব। আবার দেখে জাসদের মিটিংয়ে গুলি। আসর ব্যাপার কি? (পৃ-১২৫)
মূল্যায়ন : ৭ নভেম্বর জাতীয় ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিবস। যদিও জিয়াউর রহমান এই দিবসের মধ্যপন্থী। তবে তিনি এর নায়ক ছিলেন না। কেউ কেউ আবার তাকে খলনায়ক বলে। এ অপবাদ মোটেও ঠিক নয়। এটা ঠিক যে জাসদ ১৯৭৩ সাল থেকে নানা চেষ্টা চালিয়েছে একটা কিছু করার। এতে তারা দেশী-বিদেশী (যেমন পিটার কাস্টার) সাহায্য নিয়েছে কিন্তু প্রত্যেকবারেই ব্যর্থ হয়েছে। বলা হয় ১৮ থেকে ২২টা কুঁদেতা হয়েছে। কর্নেল ড. ওলি তো আগেই বলেছেন যে, এর সবগুলোর পিছনে জাসদ।
জাসদের ভুল তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ তাদের এই ব্যর্থতার জন্য দায়ী। জাসদ মৌলবাদী কম্যুনিস্ট বিপ্লবের আদর্শে উজ্জীবত। তারা মনে করে যে যেন বাংলাদেশ রাশিয়া, কিউবা বা উত্তর কোরিয়ার মত বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত। অথচ তা নয়। ঐসব দেশে খৃষ্ট ধর্ম দুর্বল, কম্যুনিজম অগ্রসরগামী আদর্শ। মুসলিম দেশে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। বঙ্গবন্ধু পর্যন্ত তাঁর “অসমাপ্ত আজীবনী”তে স্পষ্ট করেছেন “আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হল আমরা মুসলমান। আর একটা হল আমরা বাঙালি” (পৃষ্ঠা ৪৭) আসলে জিয়া তো এই লাইন ধরে এগিয়ে জনপ্রিয়তা পেলেন। জাসদ এই অবস্থান নেয় নাই। তারা ইউরোপের জার্মানীতে আবিষ্কৃত আদর্শ যা জার্মানীতে এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয় নাই, তাকে সামনে আনার চেষ্টা করে। জনগণ তা গ্রহণ করে নাই। জিয়া বঙ্গবন্ধুর দেয়া ইঙ্গিত নিয়ে এগিয়ে গিয়ে সফলকাম হন। জিয়া নিহত হয়েছেন কিন্তু ব্যর্থ হন নাই। মাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষের আবেগের সঙ্গে একাত্ম না হলে রাজনৈতিক সফলতা মরীচিকা হতে বাধ্য। জিয়ার সম্পর্ক ছিল মাটির সঙ্গে।
লেখক: ইতিহাসবিদ, গবেষক, সাবেক কূটনীতিক।