আবদুল আউয়াল ঠাকুর
ঐতিহাসক কাল থেকে যে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের লড়াই শুরু হয়েছিল, আরো সুনির্দিষ্ট করলে পলাশী বিপর্যয় উত্তর যে অস্তিত্বের সংকট দানা বেঁধেছিল তার প্রাথমিক সমাপ্তি ঘটেছিল বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে বিজয়ের মধ্যদিয়ে। এ বিজয় আমদের জাতিসত্তা বিকাশের পথ উন্মুক্ত করে দিলেও পূর্ণতা দিতে পারেনি। অস্তিত্বের সংকট কাটিয়ে উঠতে হাঁটতে হয়েছে আরো অনেকটা পথ। সে পথে প্রাণ দিতে হয়েছে অনেককে। জীবনপণ করা এ লড়াইয়ের মধ্যদিয়েই অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশ। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ’৪৭ পরবর্তীকালে ভাষাকে কেন্দ্র করেই জাতীয় সত্তার লড়াই বেগবান হয়েছিল। ভাষা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের গোড়ায় রয়েছে, আপন সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। সোজা কথায় বলা যায়, যে তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে আমাদের স্বাধীনতার মূল সনদ রচিত হয়েছে তা হলো ভোট, ভাত ও সংস্কৃতি রক্ষার অধিকার। সত্যি এই যে, তিন দাবিতেই চলেছে ’৪৭ পরবর্তী রাজনৈতিক আন্দোলন। এভাবেই দেখা যাবে ৬৯-এর গণআন্দোলনকে। এ অঞ্চলে মানুষ নির্বিঘেœ কথা বলতে চায়, তারা তাদের পছন্দের মানুষকে একটা ভোট দিতে চায় এবং নিজস্ব সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখতে চায়। এ জন্যই তারা আন্দোলন করেছিল। স্বৈরতান্ত্রিকতার বুটের নীচে আটকা পড়েছিল এদেশের মানুষের মৌলিক অধিকার। আর সে কারণেই ফুসে উঠেছিলেন তারা। আসাদ, মতিউরের রক্তের বিনিময়ে সেদিন স্বৈরতন্ত্রের বিদায় হলেও মানুষ গণতন্ত্র পায়নি। লড়াইটা তাই থেমে যায়নি। এগিয়েছে অনেক দূর। একজন ভাষা মতিনের সেদিনে সিদ্ধান্ত পাল্টে দিয়েছিল ইতিহাসকে। রাস্তায় নেমে পড়েছিল ছাত্ররা মায়ের ভাষা তথা জাতীয় সংস্কৃতি রক্ষার লড়াইয়ে। রাজপথে রক্ত ঝরেছে মায়ের বুখ খালি হয়েছে, আখেরে মুক্তি এসেছে। একজন মওলানার নেতৃত্বে সেদিন জনতা মাঠে নেমে পড়েছিল। জনতা মুক্তি পেয়েছিল। একটি ঘোষণা সেদিন জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সেদিন মেজর জিয়া জাতির প্রাণে যে আশার সঞ্চার করেছিলেন তার রেশ এবং সুর পুনরায় ধ্বনিত হয়েছিল ৭ নভেম্বর জাতীয় স¦াধীনতার চেতনায় গণতন্ত্র সংহতকরণের এক দুর্দমনীয় বেগে। দেশের আপমর জনতা শ্রেণী, পেশা নির্বিশেষে রাস্তায় নেমে পড়েছিল স্বাধীনতার পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে। তাই ৭ নভেম্বর আমাদের জাতীয় জীবনে এক অনন্য উচ্চতার এক দিন। এবারের বাস্তবতায় এ দিবসটির তাৎপর্য ও গুরুত্ব অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে ভিন্ন মাত্রিকতার। এ কথাও এখানে বলা দরকার যে চেতনা ও বোধ বিশ্বাস নিয়ে জাতি স্বাধীনতার রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে নিজেদের উৎসর্গ করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল কার্যত সে বিজয় যেদিন এল তখন তার পূর্ণ স্বাদ জাতি উপভোগ করতে পারেনি। এ নিয়ে একটা চাপা ক্ষোভ জাতির অভ্যন্তরে ছিলই। সে বিবেচনায় ৭নভেম্বর জাতি বোধকরি সেই উৎসব করতেই রাস্তায় নেমে পড়েছিল। সে কারণেও ৭ নভেম্বর তথা জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস এক অবিস্মরণীর মাত্রায় রয়েছে।
সাধারণ অর্থে ৭ নভেম্বর দিনপঞ্জির একটি তারিখ ছাড়া আর কিছুই নয়। দিনমাস এভাবেই গড়ায়। জাতির জীবনে কখনো কখনো এমন এমন কোন দিন আসে বা অপরিহার্য হয়ে ওঠে যখন তা সময়কে ছাড়িয়ে যায়। যুগ যুগ ধরে আত্ম পরিচয়ের উৎস অনুসন্ধানে এসব দিনকে স্মরণ করে। বোধ-বিশ্বাস ইতিহাস, ঐতিহ্যকে ঝালিয়ে নেয়ার প্রয়োজনে। ৭ নভেম্বর জাতিসত্তার শেকড়ে গ্রথিত সেরকম এক তারিখ। অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদেই এদিন সমন্বিত চেতনার বিস্ফোরণ হয়েছিল। ৭ নভেম্বর অলিখিত সংবিধানের সুনির্দিষ্ট তারিখ। ’৭২ সালে রচিত সংবিধানে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা মৌলিক স্তম্ভ হিসেবে লিপিবদ্ধ থাকলেও ’৭৪-এর বাকশাল গঠন করে গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়া হয়েছিল। বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামে পরদেশী সংস্কৃতিতে ভেসে যাচ্ছিল আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্যম-িত সাংস্কৃতির উত্তরাধিকার। ভাষা আন্দালনের মাধ্যমে যে অর্জন আমরা করেছিলাম তা প্রকৃত বিবেচনায় হুমকির মুখে পড়েছিল রাষ্ট্রযন্ত্রের অবিমিশ্রকারিতার কারণে। আজো যদি সে প্রেক্ষিত সামনে নিয়ে আলোচনা করা যায় তাহলে বলতেই হবে আমাদের সংস্কৃতি এক নীলনকশার শিকার। বিদেশি অপসংস্কৃতির নিগড়ে আটকা পড়েছে আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য। আকাশ সংস্কৃতির করাল গ্রাসে নিপতিত হয়েছে আমাদের সমৃদ্ধ ঐকিহ্য। সে বিবেচনা করলে ’৫২-এ ভাষা শহীদরা যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রাণ দিয়েছেন আজ সে সূত্র ধরে একটি দেশ থাকলেও জাতীয় সংস্কৃতি আক্রান্ত। সে কারণেও এবারে ৭ নভেম্বর অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
গণতান্ত্রিক অধিকারে সর্বনি¤œ স্তর হচ্ছে নির্বিঘেœ ভোট প্রদানের অধিকার। আজ সেই অধিকার বিলুপ্ত। জনগণের ভোট ছাড়াই প্রায় প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীনভাবে নির্বাচিত হচ্ছেন সংসদ সদস্যরা। ভোটের অধিকারের কথা, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা বললেই হতে হচ্ছে জঙ্গি। এটা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূলমন্ত্র ছিল না। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর বাংলাদেশে প্রথম যে ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেখান থেকেই কারচুপির যাত্রা শুরু। বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে একদিকে বিজয়ের আনন্দ সমভাবে ভাগ করা গেল না। তার উপর যে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এতবড় সংগ্রাম হল তাও প্রথম ধাক্কাতেই মার খেল। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে জাতি মারাত্মক দুটি আঘাত পেল। একে জাতীয় জীবনের এক বড় ধরনের কলঙ্ক তিলক বলে অভিহিত না করে কোন উপায় নেই। ’৭৩-এর নির্বাচনে যতটুকু গণতন্ত্র ছিল তাও ব্যবচ্ছেদিত হলো ’৭৪ সালে একদলীয় সরকার ব্যবস্থায়। এরপরের অলোচনা অর্থহীন। পরবর্তী সময়ের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যাবে, ’৭৫-এর পরিবর্তনের পরও দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা বহাল ছিল। দেশে বেসামরিক শাসন কার্যকর ছিল। প্রেসিডেন্ট ছিলেন খন্দকার মোস্তাক আহমেদ। সংসদও বহাল ছিল। সে অবস্থা বেশি দিন চলেনি। ৩ নভেম্বর খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান হয়। তারপর দ্রুত দৃশ্যপট বদলাতে থাকে। দেশ নিপতিত হয় গভীর অন্ধকারে। ৪ থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে কার্যত কোন সরকার ছিল কিনা তা বোঝার উপায় ছিল না। গোটা দেশ ছিল থমথমে। ঢাকাস্থ ভারতীয় কূটনীতিক অপহরণের চেষ্টা হয়েছিল। সব মিলে জাতীয় স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব যখন কার্যকর হুমকির মুখে পড়েছিল তখনই সিপাহী জনতা মিলিত আল্লাহু-আকবার ধ্বনিতে জাতীয় মুক্তির নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছিল। কারান্তরাল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। জনগণ সেদিন যে বোধ বিশ্বাস নিয়ে আনন্দে উৎদ্বেলিত হয়েছিল তার মূলে ছিল স্বাধীনতার মূল চেতনা। জনগণের নন্দিত নেতা হিসেবে ক্ষমতার বলয়ে ফিরে এসেছিলেন সেই জিয়া যার কণ্ঠে জাতি শুনেছিল স্বাধীনতার ঘোষণা। সিপাহী জনতার এই সম্মিলিত শ্লোগানে হাতে হাত ধরে যে নতুন বার্তা পৌঁছে দেয়া হয়েছিল কার্যত তারই প্রতিফলন ঘটেছিল পঞ্চম সংশোধনীতে আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা স্থাপনের মধ্যদিয়ে। অনেকেই মনে করেন, এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে পূর্ণতা এসেছিল। সময়ের পরিবর্তনে সেই সংশোধনী বাতিল করে আল্লাহর উপর অবিচল আস্থাকে সংবিধানের অংশ থেকে বাদ দিয়ে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সৃষ্টি করা হয়েছে নতুন বাস্তবতা। আর সে কারণেই ৭ নভেম্বরের আলোচনা এবং এর গুরুত্ব অনুধাবন জরুরি হয়ে পড়েছে। জাতীয় সংস্কৃতি ও গণতন্ত্র রক্ষায় ৭ নভেম্বরে আবেদন এখনো চিরঞ্জীব।
’৭১-এর রক্তাক্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্যদিয়ে যে স্বতন্ত্র স্বাধীন রাজনৈতিক পরিচিতি অর্জিত হয়েছে তার ভিত রচিত হয়েছিল ঐতিহাসিক কাল থেকে। সুনির্দিষ্ট দিন, তারিখ উল্লেখ করা না গেলেও এটা সহজেই অনুমান করা যায় যে, বাংলায় যখন মুসলমানদের আগমন ঘটেছিল সেই সময়ে ইসলামী সাম্যবাদ বর্ণবাদে নির্যাতিত মানুষকে যেভাবে সম্মোহিত করেছিল তার কোন তুলনা আজও নেই। এই আলোচনা যে আরোপিত নয়, সে কথা আধুনিককালের সাহিত্যিকরাও স্বীকার করছেন। সাহিত্য ইতিহাসে এর সুনির্দিষ্ট উল্লেখ রয়েছে। সাহিত্যিক উপন্যাসিকরা যে স্বীকৃতি দিয়েছেন তার বাস্তবতা আমাদের সমাজে এখনও বিদ্যমান। লিখে বা বলে বোঝাবার প্রয়োজন নেই যে, একই ভাষার দাবিদার হওয়া সত্ত্বেও দুই অংশের সমাজ মানস গঠনের প্রক্রিয়ার মধ্যে ঐতিহাসিককাল থেকেই ভিন্নতা রয়েছে। এই ভিন্নতার সূত্র যে ধর্মীয় সাংস্কৃতিক চেতনাবোধের মধ্যে বিকশিত হয়েছে তাতেও বোধকরি বিন্দুমাত্র সন্দেহ করার কোন অবকাশ নেই। সুতরাং জাতি হিসেবে আমাদের মধ্যে যে ধর্মীয় সংস্কৃতিক বোধ বিশ্বাস কাজ করেছে এবং করে আসছে তাকে আলাদা করে দেখার কোন সুযোগ নেই। এই ভাবনার সাথে অনেকে আমাদের ঐতিহাসিক এবং অনিবার্যতায় চলে আসা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের একধরনের সাংঘর্ষিকতার তত্ত্ব প্রচার করে থাকেন। তারা বলতে চান বা বোঝাতে চান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের মধ্যে যে ‘উদার অসম্প্রদায়িক’ চেতনার জন্ম হয়েছে তা ঐতিহাসিককাল থেকে বিকাশপ্রাপ্ত চেতনার বিপরীতে অবস্থান করছে। বাস্তবতা হচ্ছে, প্রস্তুতি পর্ব থেকে আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য যে অসম্প্রদায়িক চেতনাবোধেই রয়েছে তার ধারাবাহিকতাতেই আমাদের স্বাতন্ত্র্যবোধের জন্ম হয়েছে এবং এটাই হচ্ছে বর্ণবাদ ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং আধিপত্যবাদ বিরোধী জাতীয় বৈশিষ্ট্য। কার্যত এটাই আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের মূল বৈশিষ্ট্য। এই চেতনাবোধের পূর্ব স্বীকৃতি হিসেবে অনেকে ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গকে উল্লেখ করে থাকেন। ইতিহাস থেকে যদি উদাহরণ নেয়া যায়, তাহলে অবশ্যই বলতে হবে বর্তমানে যে সাম্প্রদায়িক প্রসঙ্গের উত্থাপন করা হচ্ছে তার কোন সূত্র ধরে সে সময় পূর্ববাংলা ও আসামকে আলাদা করা হয়নি। যা করা হয়েছিল তাহলো কোলকাতা কেন্দ্রিকতার বিরুদ্ধে এ অঞ্চলের মানুষের যে এক ধরনের আস্থার সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছিল তাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা হয়েছে। এখানেও ধর্মীয় সংস্কৃতির সম্পৃক্ততার প্রসঙ্গ রয়েছে। ব্রিটিশরা যেভাবে ঢাকাকেন্দ্রিক সীমানা নির্ধারণ করেছিল তাতে যদি সাম্প্রদায়িকতা না থেকে থাকে তাহলে বর্তমান সময়ে সে প্রসঙ্গ উঠছে কেন? পাকিস্তানের যে রাষ্ট্রকাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেক্ষেত্রে তৎকালীন পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অঙ্গীভূত হয়েছিল কার্যত কোলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু রাজনীতিবিদদের কারণে। সুতরাং পাকিস্তানের অংশ হবার সাথে যে চেতনাবোধের প্রশ্ন তোলা হয় তার সাথে প্রকৃতপক্ষে মৌলিক বোধ-বিশ্বাসের সাংঘর্ষিকতা যুক্ত করার পক্ষে কোন তথ্য-উপাত্ত নেই। সে কারণেই পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামো থেকে নিজেদের স্বাধীনতার প্রসঙ্গকে জাতীয় ইতিহাস ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবার কোন অবকাশ নেই। সঙ্গতভাবেই বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামে যে কালচারের অনুপ্রবেশ করানোর চেষ্টা হয়েছে তা যে আমাদের জাতীয় চেতনাবোধের সাথে সাংঘর্ষিক সে কথা নতুন করে উল্লেখের কোন প্রয়োজন নেই বিধায় ৭ নভেম্বরের সিপাহী জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লবে মগ্নস্থ হবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
কোন সাংবিধানিক ফর্মে সিপাহী জনতার বিপ্লব অনুষ্ঠিত হয়নি, হতে পারেনি হতে পারার কথাও নয়। সাংবিধানিকভাবে জাতীয় সংসদে মাত্র কয়েক মিনিটের আলোচনায় বাকশাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ফলে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ বিদূরিত হয়েছিল। আর এই ধারণা যে অগণতান্ত্রিক ছিল সে রায় প্রকাশিত হয়েছিল জনতার আদালতে। কেন সাংবিধানিক পদ্ধতিতে গণতন্ত্র রক্ষা করা যায়নি এ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনার অবকাশ এখানে নেই। একথা বোধহয় বলা যায়, গণতান্ত্রিক বিশ্বে সরকার পরিবর্তনে যে পদ্ধতি রয়েছে সেক্ষেত্রে জনগণের অংশগ্রহণের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভও থাকে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে যদি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়কে বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে দেখা যাবে এখানে মৌলিকভাবে আস্থার সঙ্কট গুরুতর আকারে প্রতীয়মান। বর্তমান সময়ে অথবা এর আগেও নির্বাচনকালীন সময় নিয়ে যে বিতর্ক হয়েছে এবং হচ্ছে মূলত সেখানে আস্থার প্রসঙ্গ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এই সঙ্কটকে যদি সাংস্কৃতিক দিক থেকে দেখা যায়, তাহলে বলতে হবে সিপাহী জনতার বিপ্লবের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী এবং উত্তরাধিকারীরা যেখানে আল্লাহর উপর আস্থাশীল সেখানে অন্যদের আল্লাহর উপর আস্থাশীল হতে আপত্তি রয়েছে। এই সঙ্কট রাজনৈতিকভাবে এখন গুরুতর আকার ধারণ করেছে। ৭ নভেম্বর থেকে জনগণ আল্লাহর উপর আস্থার যে প্রসঙ্গকে তাদের ম্যান্ডেট বলে রায় দিয়েছে সেখান থেকে পিছু হটার কোন অবকাশ নেই।
৭ নভেম্বরের ম্যান্ডেট নিয়ে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন। সেই সূত্রেই বলা যায়, জনগণের সম্মিলিত ম্যান্ডেটই তার মূল শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। আর এর পেছনে রয়েছে আল্লাহর প্রতি অবিচলের আস্থা। সে কারণেই তিনি প্রবর্তন করেছিলেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদÑ যেখানে জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য সম্বলিত সকলকে এক স্রোতে লীন করেছিলেন এবং ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও স্বাধীন বাংলার নাগরিক এবং ভারতের নাগরিকদের আলাদা করে চেনার উপায় ছিল। কার্যত যা ট্যারিটরিয়াল স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সীমানা হিসেবেই বিবেচিত ছিল। আল্লাহর উপর আস্থাশীল হওয়াতে যাদের আপত্তি তাদের কিন্তু এই দিনটি পালনেও আপত্তি রয়েছে। এপ্রকৃত বিবেচনায় ৭নভেম্ববর পালনের মধ্যদিয়ে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বা সে সময়কে যতটা সম্মান প্রদর্শন করা হয় তার চেয়ে বেশি আমরা ইতিহাস, ঐতিহ্যের প্রতি আমাদের দায়ের স্বীকৃতি দেই। চেতনায় প্রত্যাবর্তন করি। একথা বলা হয়তো বেশি নয় যে, নিজস্ব ঐতিহ্য উত্তরাধিকার এবং সংস্কৃতির সংরক্ষণ করা না গেলে জাতীয় স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রক্ষা নিতান্তই কঠিন। এবারে যখন ৭ নভেম্বর পালিত হচ্ছে তখন দেশে ভিন্ন রাজনৈতিক বাস্তবতা বিরাজ করছে। যে গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করা হয়েছে প্রকারন্তরে আজ তা বিলুপ্ত। রনাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের একে একে বিতর্কিত করে তোলা হচ্ছে। জনগণের মধ্যে নানা প্রক্রিয়ায় বিভাজন রেখা টেনে দেয়া হয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যস্থাপনা বলতে গেলে বিদূরিত। একধরনের স্বেচ্চাচারিতা স্থান করে নিয়েছে বা নিতে যাবার প্রবণতা সক্রিয় রয়েছে। দেশে রাজনৈতিক বন্ধ্যাত্ব বিরাজমান। ‘৭৪-এর বন্ধ্যাত্ব অবসান হয়েছিল ৭ নভেম্বরের সিপাহী জনতার ঐক্যতানে। এবারের বন্ধ্যাত্ব অবসানে রাজনৈতিক ঐক্য ও সমঝোতার প্রতি সকল মহল গুরুত্ব দিলেও কার্যত তা কতটা সকলে মনে স্থান করে নিতে পেরেছে তা এখনো স্পষ্ট নয়। ৭নভেম্বর জাতীয় স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক শক্তির যে উন্মেষ ঘটেছিল আজ সেই চেতনার পূর্ণ বহিঃপ্রকাশ আবশ্যকীয় হয়ে উঠেছে। সরকার যাই বলুক, গণতন্ত্র মূল্যবোধভিত্তিক জাতীয় সংস্কৃতি রক্ষায় জনগণ ঐক্যবদ্ধ। ৭ নভেম্বরের চেতনায় সমর্পিত হওয়ার মধ্য দিয়েই ভোটও ভাতের অধিকার এবং জাতীয় সংস্কৃতি রক্ষা করা সম্ভব।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।