Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিষেধাজ্ঞা মোকাবেলায় রাশিয়ার পরিকল্পনা কী? কতোটা প্রভাব পড়বে রুশ অর্থনীতির ওপর

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ৩:৪৩ পিএম

ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দুটো এলাকাকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রেসিডেন্ট পুতিন লুহানস্ক ও দোনেৎস্কে রুশ সৈন্য পাঠানোর নির্দেশ দেয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং তাদের আরো কিছু মিত্র দেশ রাশিয়ার ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন ২০১৪ সালে যেসব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল এবারের নিষেধাজ্ঞাগুলো হবে তার চেয়েও বড় এবং কঠোর। তিনি বলেছেন, রাশিয়া যদি আরো অগ্রসর হয় তাহলে তারাও আরো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে প্রস্তুত। এধরনের নিষেধাজ্ঞার কোনো প্রভাব কি আসলেই পড়ে রাশিয়ার ওপর? এনিয়ে বিবিসির ক্রিস মরিসের প্রতিবেদন:

এই মুহূর্তটির জন্য কয়েক বছর ধরে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে রাশিয়া। এর আগে ২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের একটি অংশ ক্রাইমিয়া দখল করার জন্য সেখানে সৈন্য পাঠানোর পর তাদের ওপর প্রথম দফায় আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। এবং ওই ঘটনা থেকে রাশিয়া গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিক্ষা গ্রহণ করেছে। এর পর থেকেই রাশিয়া আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা মোকাবেলার জন্য কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে এমন এক রুশ অর্থনীতি গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে যার ওপর নিষেধাজ্ঞার তেমন একটা প্রভাব পড়বে না। প্রেসিডেন্ট পুতিন হয়তো বাজি ধরতে পারেন যে, পশ্চিমা দেশগুলো যতোটা অনুমান করেছিল, তার দেশ তার চেয়েও বেশি সময় ধরে এসব নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে টিকে থাকতে পারবে।

আন্তর্জাতিক রিজার্ভ: এবছরের জানুয়ারি মাসের মধ্যে রুশ সরকারের আন্তর্জাতিক রিজার্ভের পরিমাণ রেকর্ড পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। বৈদেশিক মুদ্রা এবং স্বর্ণের এই রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬৩ হাজার কোটি ডলার। বিশ্বের সব দেশের তুলনায় রাশিয়ার এই রিজার্ভ চতুর্থ বৃহত্তম যা রুশ মুদ্রা রুবলের পতন ঠেকিয়ে একে চাঙ্গা রাখতে একটা উল্লেখযোগ্য সময় পর্যন্ত ব্যবহার করা হতে পারে।

 

উল্লেখ্য যে বর্তমানে রাশিয়ার বৈদেশিক মুদ্রার মাত্র ১৬% ডলারে রাখা। পাঁচ বছর আগেও এর পরিমাণ ছিল ৪০%। অন্যদিকে রাশিয়ার বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় ১৩% রাখা চীনা মুদ্রা রেনমিনবিতে। এসবই পরিকল্পিতভাবে করা এবং এটা করে হয়েছে আমেরিকার নেতৃত্বে রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে, তা থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য।

'রাশিয়া যখন দুর্গ': এছাড়া রাশিয়ার অর্থনৈতিক কাঠামোতেও বড় ধরনের কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে দেশটি বৈদেশিক ঋণ ও বিনিয়োগের ওপর তাদের নির্ভরতা কমিয়েছে। একই সাথে তারা পশ্চিম বাজারের বাইরে নতুন নতুন দেশের সঙ্গে বাণিজ্যের সুযোগ সম্ভাবনাও যাচাই করে দেখেছে। তাদের নতুন এই কৌশলের একটি বড় অংশ হচ্ছে চীন। আন্তর্জাতিকভাবে অর্থ লেনদেনের ব্যাপারেও রাশিয়া তাদের নিজস্ব একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য ইতোমধ্যে প্রাথমিক কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে।

বিশ্বজুড়ে অর্থ লেনদেনের জন্য বর্তমানে সুইফট নামের যে আর্থিক যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু রয়েছে, তা থেকে রাশিয়াকে বের করে দেওয়া হলে দেশটি যাতে বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ে, সেজন্য তারা আগে থেকেই এসব পদক্ষেপ নিয়ে রেখেছে। পশ্চিমা দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কসমূহ এই সুইফট তদারকি করে থাকে।

এছাড়া রাশিয়া তার বাজেটেও কাটছাঁট করে এনেছে- প্রবৃদ্ধির বদলে এখন তারা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকেই বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এর ফলে রাশিয়ার অর্থনীতি গত এক দশকে প্রতি বছর গড়ে এক শতাংশেরও কম হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এই প্রক্রিয়ায় দেশটি আগের তুলনায় আরো বেশি আত্ম-নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। ‘রাশিয়া যা করছে এর মধ্য দিয়ে কার্যত তারা বিকল্প এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলছে যাতে তারা পশ্চিমা বিশ্বের সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞার আঘাত সামাল দিতে পারে,’ বলেন করিওলিস টেকনোলজিসের প্রধান নির্বাহী রেবেকা হার্ডিং।

কৌশলগত স্বার্থ: রাশিয়ার জন্য এটা এক বিপদজনক খেলাও হয়ে উঠতে পারে। দেশটির প্রধান প্রধান ব্যাঙ্ক, বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় ব্যাঙ্কগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে রাশিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে প্রেসিডেন্ট পুতিন হয়তো আরো একটা হিসেব কষে দেখেছেন এবং তা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কৌশলগত ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থ। উল্লেখ করা যেতে পারে যে কিছু কিছু দেশের জন্য রাশিয়ার তেল ও গ্যাস শিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা অন্য কিছু দেশের তুলনায় সহজ।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন তার প্রাকৃতিক গ্যাসের ৪০% পেয়ে থাকে রাশিয়ার কাছ থেকে। আর ব্রিটেন ৩% গ্যাসের জন্য রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল। ইউক্রেনের দুটো অঞ্চলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে রাশিয়ার স্বীকৃতির পর জার্মানি নর্ড স্ট্রিম ২ গ্যাস পাইপলাইনের অনুমোদন স্থগিত করেছে। এটা রাশিয়ার জন্য ক্ষতিকর, তবে এর ফলে পশ্চিম ইউরোপে জ্বালানির মূল্যের উপরেও জার্মানির এই সিদ্ধান্তের প্রভাব পড়বে।

ধনী শাসকশ্রেণীর ওপর নিষেধাজ্ঞা: রাশিয়ার সমগ্র অর্থনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ না করে কতিপয় প্রভাবশালী ধনী ব্যক্তিকে টার্গেট করে তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে কি তার প্রভাব বেশি হবে? প্রেসিডেন্ট পুতিন যৌক্তিক কারণেই তার নামে বিদেশে অর্থ কিংবা সম্পদ রাখবেন না। কিন্তু তার ঘনিষ্ঠ অত্যন্ত ধনী ব্যক্তিদের একটি নেটওয়ার্ক তার হয়ে সেই কাজটা করতে পারেন।

‘২০১৪ সালের পর থেকেই এধরনের অলিগার্ক বা ধনী শাসক শ্রেণির কয়েকজন ব্যক্তির ওপর কিছু নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে। কিন্তু সেসব যে খুব একটা কার্যকরী হয়েছে তা বলা যাবে না। কিন্তু এসব নিষেধাজ্ঞা যদি তাদের বিরুদ্ধে আরো বেশি সুনির্দিষ্ট করে আরোপিত হয়, শুধুমাত্র তখনই কিছু পরিবর্তন ঘটবে,’ বলেন লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের অধ্যাপক তমিলা লানকিনা।

এক্ষেত্রে লন্ডন একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। এখানকার আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে বিশ্বের বড় বড় কোম্পানির সম্পর্ক রয়েছে। বাড়িঘর বা প্রপার্টি ব্যবসাতেও রয়েছে বিনিয়োগ। এছাড়াও এর কিছু রাজনৈতিক প্রভাবও আছে। ব্রিটিশ সরকার এর মধ্যেই রাশিয়ার পাঁচটি ব্যাঙ্ক এবং বিশেষ তিনজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তবে দুর্নীতি-বিরোধী গ্রুপ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, ‘শুধুমাত্র লন্ডনের প্রপার্টি ব্যবসাতেই রাশিয়ার বিনিয়োগের পরিমাণ ১৫০ কোটি পাউন্ড। এর বেশিরভাগই এসেছে তৃতীয় একটি দেশে (অফশোর) রাখা অর্থ থেকে। ‘পশ্চিমা দেশের সরকারগুলো এর মাধ্যমে শুধু রাশিয়ার লোকজনেরই ক্ষতি করছে না, তারা তাদের নিজেদের জনগণেরও ক্ষতি করছে,’ বলেন অধ্যাপক লানকিনা।

কতোটা কার্যকর হবে: পশ্চিমা নেতারা এটা পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে গত কয়েকদিনে যেসব নিষেধাজ্ঞার কথা ঘোষণা করা হয়েছে সেগুলো সম্ভাব্য পদক্ষেপগুলোর প্রথম কয়েকটি ধাপ। কিন্তু রাশিয়ার ওপর এই চাপ আরো উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ানো হতে পারে। কিন্তু রাশিয়াকে তাদের পথ পরিবর্তনের জন্য বাধ্য করতে এসব নিষেধাজ্ঞা কি যথেষ্ট হবে?

নিষেধাজ্ঞার যে কিছু প্রভাব আছে তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। তবে রাশিয়ার মতো বৃহৎ অর্থনীতির ওপর এধরনের নিষেধাজ্ঞা এর আগে কখনো প্রয়োগ করা হয়নি। সেকারণে রাশিয়ার ওপর আরোপিত এসব নিষেধাজ্ঞা কার্যকরী করতে হলে পশ্চিমা দেশগুলোকে দীর্ঘ সময় ধরে কঠোরভাবে লেগে থাকতে হবে। সূত্র: বিবিসি বাংলা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ