Inqilab Logo

বুধবার ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১, ০৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দুদকের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন

আন্তর্জাতিক আর্বিট্রাল ট্রাইব্যুনালে নিষ্পত্তির পর অনুসন্ধান!

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:০০ এএম

মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লি:-এর পরিচালনা পর্ষদ সরকারের ৬শ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে! আপাতঃ চমকপ্রদ এমন ‘অভিযোগ’ লুফে নিয়ে দুদকের ‘বাছাই কমিটি’ অনুসন্ধানের সুপারিশ করে। তৎকালীন কমিশনও বিষয়টি অনুসন্ধানের জন্য নবম গ্রেডের একজন কর্মকর্তাকে (সহকারি পরিচালক) নিয়োগ (স্মারক নং-০০.০১.০০০.৫০৩.২৬.২৮৪.১৯-২৮৮৩০ তাং-২১/৭/১৯খ্রি.) দেয়। অনুসন্ধান শেষে কর্মকর্তা সম্প্রতি এ বিষয়ে মামলা রুজুরও সুপারিশ করেছেন। তথ্য নির্ভরযোগ্য সূত্রের।
সূত্রটি জানায়, জমাকৃত এ প্রতিবেদনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটিই চেপে যাওয়া হয়েছে। যা পরবর্তীতে দুদককে বড় কোনো আইনগত প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারে। সেটি হচ্ছে, অভিযোগটি ইতোমধ্যেই একটি ‘আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সালিস’-এর মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে। ২০০১ সালের ‘সালিস আইন’-এর আওতায় এ সালিসের (আদেশ নং-১৫, তারিখ-২০/০৯/২০২০) রায় হয়। আর্বিট্রেটর হিসেবে রায়টি দিয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের তিন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত ‘আন্তর্জাতিক আর্বিট্রাল ট্রাইব্যুনাল’। অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কেএম হাসানের নেতৃত্বে গঠিত ট্রাইব্যুনালে অপর দুই সদস্য হলেন, আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান এবং আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দীন চৌধুরী। গুরুতর অথচ উচ্চ পর্যায়ের ট্রাইব্যুনালে নিষ্পত্তিকৃত এই ‘আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিরোধ’টিকেই দুদক অনুসন্ধানের ‘বিষয়বস্তু’ হিসেবে বেছে নেয়।
তবে আইনজ্ঞরা বলছেন, বিষয়টি যেহেতু আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিরোধ এবং উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন আন্তর্জাতিক আর্বিট্রাল ট্রাইব্যুনালে নিষ্পত্তিকৃত সেহেতু এটি স্পর্শকাতর। বিষয়টিকে ‘অনুসন্ধানের বিষয়বস্তু’ হিসেবে নির্বাচন করার আগে আইনগত দিক বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়েছে কি না-সেই প্রশ্ন তোলা যায়। কারণ ‘সালিস আইন-২০০১’ এর ৭ ধারায় আর্বিট্রেশন ট্রাইব্যুনাল’কে ব্যাপক এখতিয়ার দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘সালিস চুক্তির কোনো পক্ষ অপর কোনো পক্ষের বিরুদ্ধে উক্ত চুক্তির অধীনে সালিসে অর্পণে সম্মত কোনো বিষয়ে আইনগত কার্যধারা রুজু করিলে, বর্তমানে প্রচলিত অন্য কোনো আইনে যাহাই থাকুক না কেন, এ আইনের বিধান ব্যতীত অন্য কোনো আইনগত কার্যধারার শুনানীর এখতিয়ার আদালতের থাকিবে না।’
এ এখতিয়ার বলেই সরকারি মালিকানাধীন ‘মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি (এমজিএমসিএল)’ এবং বহুজাতিক কোম্পানি ‘জার্মানিয়া ট্রেস্ট কনসোর্টিয়াম (জিটিসি)’র মধ্যে আর্বিট্রেশন হয়েছে। আর্বিট্রাল ট্রাইব্যুনালে এমজিএমসিএল’র উত্থাপিত আর্বিট্টেশনের বিষয়বস্তুগুলোর মধ্যে ছিলো-মধ্যপাড়া কঠিন শিলা প্রকল্প থেকে পাথর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা, লিকুইডেটেড ড্যামেজের হার, স্টোন ডাস্টের হার, এ সংক্রান্ত আর্থিক ক্ষতি, বকেয়া বিদ্যুৎ বিল, চুক্তি বহির্ভূত শিলা উৎপাদন ইত্যাদি। আর্বিট্টেশনে এমজিএমসিএল’র পক্ষে নিজস্ব যুক্তি তুলে ধরা হয়। পাল্টা যুক্তি এবং তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয় জিটিসি’র পক্ষ থেকেও। পক্ষে-বিপক্ষে উত্থাপিত বিষয়গুলো আলোচনা-পর্যালোচনা শেষে উভয়পক্ষে আপস-মীমাংসা হয়। এর ভিত্তিতে আদেশ দেন আর্বিট্টেশন ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের আদেশকে সম্মান জানিয়ে এমজিএমসিএল-জিটিসি’ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তির ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলেছে। এমজিএমসিএল কিংবা জিটিসি নতুন কোনো অভিযোগ আর্বিট্টেশন বোর্ডে উত্থাপন করেনি। যদিও আর্বিট্টেশন বোর্ডের সিদ্ধান্ত না মানলে যেকোনো পক্ষ সালিস আইন-২০০১ এর ৪৮ ধারা অনুযায়ী হাইকোর্টে আপিলের বিধান রয়েছে। এছাড়া আইনের ৪২ (১),৪২(২) অনুযায়ী সালিসী রোয়েদাদ বাতিলের আবেদনও করতে পারেন যেকোনো পক্ষ। সে ক্ষেত্রে পক্ষগণকে অবশ্যই আইনের ৪৩ ধারার (সালিসী রোয়েদাদ বাতিলের কারণ) শর্তগুলোও পূরণ করতে হবে। আর্বিট্রাল ট্রাইব্যুনালের আদেশ নিয়ে উভয়পক্ষ সন্তুষ্ট থাকলেও কোনো পক্ষভুক্ত না হলে সংক্ষুব্ধ কেবল দুদক। সংস্থাটি আর্বিট্রাল ট্রাইব্যুনালের আদেশে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ২০১ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের ২ নং আইনের ৫(২) ধারা খুঁজছে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিরোধ সালিশে অভিজ্ঞ আইনজীবী ব্যারিস্টার আকবর আমীন বাবুল বলেন, দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিক যেকোনো বাণিজ্যে দুই বা ততোধিক পক্ষ থাকে। পক্ষগণের মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে যৌক্তিক বিরোধও থাকতে পারে। এ ধরনের বিরোধ মীমাংসার লক্ষ্যে আর্বিট্রেশন অ্যাক্ট-২০০১ করা হয়। এ আইনের ৩৯ (১) ধারায় আর্বিট্রেশন ট্রাইব্যুনালের ‘স্ট্যাটাস’ নির্দিষ্ট করা আছে। সে অনুযায়ী আর্বিট্রেশন জাজমেন্ট পক্ষগণ মানতে বাধ্য।
এতে বলা হয়েছে, কোনো সালিস চুক্তির ধারাবাহিকতায় সালিসী ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রদত্ত রোয়েদাদ চূড়ান্ত হবে এবং এটি পক্ষগণ এবং তাদের মাধ্যমে বা অধীনে দাবিদার যে কোনো ব্যক্তির ওপর বাধ্যকর হবে। কিন্তু দুদকের কার্যক্রম মনে হতেই পারে যে, সংস্থাটি সম্ভবত আন্তর্জাতিক আর্বিট্রাল ট্রাইব্যুনালের আদেশে সংক্ষুব্ধ। এ কারণে হয়তো মনে করছে এটি তারা মানতে বাধ্যও নয়।
লন্ডন বারের এ প্রাক্টিশনার আরো বলেন, আর্বিট্রাল ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে যাওয়ার কোনো সুযোগ দুদকের নেই। এটি সংস্থাটির জুরিসডিকশনও নয়। যদি থাকে তাহলে কেবল পক্ষগণের কেউ সরাসরি উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারেন।
বাংলাদেশি এই আইনজীবী বলেন, দুদকের বিবেচনায় জাতীয় স্বার্থ প্রাধান্য পাওয়া উচিৎ। আর্বিট্রেশন ট্রাইব্যুনাল হচ্ছে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন একটি কোর্ট। সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে তিনজনের আদালত এ রায় দিয়েছেন। দুদক কি সেই জাজমেন্টের অ্যাকশন বোঝে? যদি বুঝেই থাকে তাহলে কি সংস্থাটির ৩ বিচারপতির বিরুদ্ধে যেতে চান? স্মরণ রাখা উচিৎ, দুদকের অপরিণত ও ভুল সিদ্ধান্তের কারণেই ঘটেছে ‘জাহালম-কাণ্ড’।
এ বিষয়ে দুদকের সাবেক মহাপরিচালক ও অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ মো: মঈদুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি স্পর্শকাতর। সেই দৃষ্টিতেই দুদকের এটি দেখা উচিৎ।
এদিকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিরোধ নিয়ে দুদকের অনুসন্ধানকে অনেকটা ‘ছেলেখেলা’ বলে আখ্যা দিয়েছেন সংস্থাটির অভিজ্ঞ ও সিনিয়র কয়েকজন কর্মকর্তা। তাদের একজন নাম প্রকাশ না করে বলেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তি বিষয়ে আন্তর্জাতিক আর্বিট্রায়াল ট্রাইব্যুনালে নিষ্পত্তিকৃত বিষয় অনুসন্ধান যোগ্য কি না-এটি আগে বাছাই কমিটির বোঝা উচিৎ ছিলো। কমিটি যদি আইনগত দিক বিচার-বিশ্লেষণ করে অনুসন্ধানের মতামত দিয়ে থাকে তাহলে কমিশনের উচিৎ বাণিজ্য আইন,আন্তর্জাতিক চুক্তি আইন, এ ধরণের অনুসন্ধানের পূর্ব-অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং ভালো ইংরেজি জানা সিনিয়র কর্মকর্তাদেরকে দিয়ে অনুসন্ধান করানো। ইন্সপেক্টর লেবেল (উপ-সহকারি পরিচালক) কিংবা নবম গ্রেডের কর্মকর্তা (সহকারি পরিচালক)কে এরকম সিরিয়াস অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া কতটা যথার্থ হয়েছে-ফলাফলই বলে দেবে। ই.ও. (অনুসন্ধান কর্মকর্তা) এবং আই.ও. (তদন্ত কর্মকর্তা) নিয়োগে দুদকে কোনো আইনি কাঠামো নেই। কাকে কোন ফাইলটি দিলে প্রত্যাশিত ফলাফল আসবে কমিশনকে সেটি ঠিক করতে হয় আন্দাজের ওপর। এখন কমিশন যদি ‘অভিপ্রায়াধীন প্রতিবেদন’ প্রত্যাশা করে-তাহলে ভিন্ন বিষয়। সে ক্ষেত্রে কমিশন প্রত্যাশিত প্রতিবেদন প্রাপ্তিতে সুচতুর কৌশল প্রয়োগ করতে পারে।
নাম প্রকাশে আপত্তি জানিয়ে সংস্থাটির আরেক অভিজ্ঞ কর্মকর্তা বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ এর ১৯ ও ২২ ধারা এবং কমিশন বিধিমালা ২০০৭ এর ২০ ধারা এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬০ ধারা অনুযায়ী কমিশনের চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে উপ-সহকারি পর্যায়ের কর্মকর্তা পর্যন্ত যেকোনো অনুসন্ধান-তদন্ত করতে পারেন। এবং অনুসন্ধানের পর অভিযোগের প্রেক্ষিতে মামলা কিংবা নথিভুক্তির সুপারিশ করাও কোনো বিষয় নয়। বিষয় হচ্ছে,অনুসন্ধান-তদন্তের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সাহস, কর্মদক্ষতা,পূর্ব অভিজ্ঞতা, শিক্ষা,ইন্টেলিজেন্সির প্রয়োগ কতখানি হলো। অতীতের কমিশন সাবেক মন্ত্রী,বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, প্রভাবশালী রাজনৈতিক ও পদমর্যাদার ব্যক্তিদের অনুসন্ধান-তদন্তে অনেক বিচার-বিচেনা করে কর্মকর্তা নিয়োগ করতেন। তাদের দেয়া প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বিচারে দোষীরা সাজা পেয়েছেন। নির্দোষ ব্যক্তিগণ অব্যাহতি পেয়েছেন। এ চর্চাটাই মানুষ দুদকের কাছে আশা করে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দুদক

২৫ জানুয়ারি, ২০২৩
৪ জানুয়ারি, ২০২৩
২৮ নভেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ