হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
কামরুল হাসান দর্পণ
বাংলাদেশে হতদরিদ্রের সংখ্যা কমেছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশে ২ কোটি ৮০ লাখ হতদরিদ্র লোক ছিল। চলতি অর্থবছরে তা কমে হয়েছে ২ কোটি। গত অর্থবছর শেষে অতি দারিদ্র্য হার মোট জনসংখ্যার ১২.৯০ শতাংশে নেমেছে। ২০০৯-১০ অর্থবছর শেষে এ হার ছিল ১৮.৫০ শতাংশ। এ সুসংবাদ গত ৩ অক্টোবর প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। গত ২৫ অক্টোবর পরিকল্পনামন্ত্রী এক সংবাদ সম্মেলনে আরেকটি সুসংবাদ দিয়েছেন। সুসংবাদটি হচ্ছে, গত অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭.১১ শতাংশ। এই প্রথমবারের মতো জিডিপি তার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করেছে। বাজেটের সময় এ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৭.০৫। সার্বিক অর্থনীতির সংক্ষিপ্ত এ চিত্র তুলে ধরা হলো এ কারণে যে, যে কারো মনে হতে পারে, আমাদের দেশ তরতর করে উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের মানুষ খেয়েদেয়ে বেশ সুখে-শান্তিতে বসবাস করছে। আমরা একটি সুখী দেশ। অবশ্য সুখী দেশের তালিকায় বাংলাদেশ বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, শত অভাব-অনটনের মধ্যেও বাংলাদেশের মানুষ আল্লাহর দরবারে শোকরিয়া আদায় করে। যত খারাপ অবস্থায়ই থাকুক, তারা সে অবস্থানকে মেনে সুখী হতে চেষ্টা করে। এ ধরনের দেশ বিশ্বে বিরল। মানুষের এই সুখী হওয়ার ভাব সরকারগুলো বেশ ভালোভাবেই কাজে লাগায়। অর্থনৈতিক উন্নতি যতটা না করে, মানুষের সুখী হওয়ার চেষ্টাকে পুঁজি করে তা আরও ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে কৃতিত্ব জাহির করার প্রবণতা সরকারের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরেই রয়েছে। বিগত কয়েক বছর ধরে সরকারের এ প্রবণতা অত্যন্ত প্রবল আকার ধারণ করেছে। এক জিডিপির হার বৃদ্ধি নিয়ে কত তর্ক-বিতর্ক! সরকার যতই বাড়িয়ে বলে, বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য দেশি-বিদেশি সংস্থা এবং অর্থনীতিবিদরা তার বিপরীত কথা বলে। তারা সরকারের অর্জিত এবং লক্ষ্য নির্ধারিত জিডিপির সাথে বরাবরই দ্বিমত পোষণ করে আসছে। সাধারণ মানুষের পক্ষে অর্থনীতির জটিল বিষয় বোঝা মুশকিল। তবে তারা জিডিপির সংখ্যাটা ভালোই বোঝে। সরকার যে সংখ্যা উপস্থাপন করে এবং এর সাথে দ্বিমত পোষণকারীরা যে সংখ্যাটি বলে, তার পার্থক্য বুঝতে তাদের অসুবিধা হয় না। ফলে সরকারের দেয়া হিসাবের সাথে তাদের অধিকাংশই দ্বিমত পোষণ করে। এর কারণ, তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা আর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য তাদের চেয়ে সরকার বা অন্য কোনো সংস্থার ভালো জানার কথা নয়। তবে এটাও ঠিক, কে যে কিসে কতটা সুখী হয়, তা বোঝা দুষ্কর। সুখ পরিমাপ করার মতো যন্ত্র পৃথিবীতে এখনো আবিষ্কার হয়নি। এটা একটা হাইপোথেটিক্যাল বা ধারণা প্রসূত ব্যাপার। বড় কথা হচ্ছে, যার জ্বালা সেই জানে বা যার সুখ সেই বোঝে। তবে কোনো সরকার কখনই মানুষের দুঃখের কথা স্বীকার করতে চায় না। সে কেবল মানুষের সুখই চোখে দেখে। মানুষের দুঃখ দেখা মানে তার ব্যর্থতা প্রকাশ হয়ে পড়া। এটা সে দেখবে কেন?
দুই.
সরকারের কথাবার্তা এবং পরিসংখ্যান উপস্থাপন থেকে বোঝা যায়, দেশ এবং দেশের মানুষ এখন উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে। এতই উন্নয়ন যে সরকার ঘোষণা করে দিয়েছে, দেশ এখন নি¤œ আয়ের দেশ থেকে নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। কাগজে কলমে বা মুখের কথায় অনেক কিছুই হতে পারে। বাঘ-ভাল্লুক, হাতি-ঘোড়া বা ভয়ঙ্কর জন্তুও মেরে ফেলা যেতে পারে। মুহূর্তে পুরো পৃথিবীও ঘুরে আসা যেতে পারে। তবে বাস্তবে এসব কাজ যে কত কঠিন, যারা করতে গিয়েছেন বা করতে চান, তারাই কেবল উপলব্ধি করতে পারেন। মাথাপিছু আয়ের কথাই ধরা যাক। গত বছর সরকার ঘোষণা করেছিল, দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ১৩১৪ ডলার। ছয় মাস না যেতেই তা বাড়িয়ে ১৪৬৬ ডলার ঘোষণা করে। এ নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। অর্থনীতিবিদদের অনেকেই একে ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এ কথাও বলেছেন, যে বেকার তার আয় হয় কীভাবে! যাই হোক, সরকারের হিসাব দেয়ার কাজ দিয়েছে। কে মানল, আর কে মানল না, তাতে কিছু যায় আসে না। আবার সরকারই গত ২৫ অক্টোবর ঘোষণা দিয়েছে, মাথাপিছু আয় ১ ডলার কমে ১৪৬৫ হয়েছে। তাতেই বা কি আসে যায়! এ নিয়ে কথা বললেই কি, না বললেই কি! অর্থনীতিবিদ তো বটেই একজন সচেতন ব্যক্তিও জানেন, শূন্যের কোনো দাম না থাকলেও একটি ‘শূন্য’ টাকার কম-বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অনেক বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়। যেমন ১০০০০০ (এক লাখ) থেকে যদি একটি শূন্য বাদ দেয়া হয় বা কমে যায়, তবে তা মুহূর্তে ১০,০০০ (দশ হাজার) টাকায় পরিণত হয়। অর্থাৎ ৯০ হাজার টাকা হাওয়া হয়ে যায়। অবশ্য বাদ দেয়া আর কমে যাওয়ার বিষয়টি একেবারে আলাদা হলেও অর্থনীতিতে দশমিক এক শতাংশ কমে যাওয়া অনেক বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তেমনি মাথাপিছু গড় আয় থেকে যদি এক ডলার কমে যাওয়ার অর্থ, ষোল কোটি মানুষের আয় থেকে ষোল কোটি ডলার বা প্রায় ১২৮০ কোটি টাকা (এক ডলার আশি টাকা ধরে) বা তার চেয়ে বেশি টাকা কমে যাওয়া। হিসাবটির হেরফের বেশ বড় ধরনের। এ থেকে প্রতীয়মাণ হয়, সরকারের ঘোষিত এবং পরবর্তীতে সংশোধিত মাথাপিছু আয়ের হিসাবটি বেশ গরমেলে। সরকারও সহজেই বলে দিতে পারে, গড় আয়ের হিসাব একটু হেরফের হতেই পারে। সচেতন ও সাধারণ মানুষও মনে করতে পারে, সরকারের উন্নয়নের ফল্গুধারা বইয়ে দেয়ার কথা প্রতিষ্ঠিত করতেই এ ধরনের হিসাব দেয়া হয়েছে। সাধারণত গড় আয় না বাড়লেও তা যে স্থানে থাকে, সেখানেই স্থির থাকার কথা। কমে যাওয়ার কথা নয়। যদি কমে যায়, তবে ধরে নিতে হবে, মানুষের ও দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা যে ভালো নয়, তা সরকারের হিসাবের বাইরে দৃষ্টি দিলেই বোঝা যায়। সরকার বার বার বলছে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। ক্রয়ক্ষমতা কীভাবে বেড়েছে, তার কোনো হিসাব পাওয়া যায় না। সরকারের উচিত অন্তত গড় হিসাব হলেও এ হিসাবটা দেয়া। যদি যুক্তি দিয়ে বলা হয়, মানুষ তো কিনছে। তাদের কেনাকাটা থেমে নেই। এর বিপরীতে এ কথাও বলা যায়, বাঁচতে হলে এবং ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতে হলে যত কষ্ট এবং টানাপড়েন থাকুক না কেন মানুষকে কেনাকাটা করতেই হবে। ভিক্ষা করে হলেও ভিক্ষুক কেনাকাটা করে। তা না হলে তার জীবন চলবে না। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারের উন্নয়নের কথার গতির সাথে তাল মিলিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ স্বচ্ছন্দে কিনতে পারছে কিনা? স্বাদ-আহ্লাদ বা আনন্দ-বিনোদন বা শৌখিনতার বাইরে মানুষ তার প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে পারছে কিনা? অবশ্য বেশ কয়েক বছর আগে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় সমালোচনার মুখে সরকারের সাবেক একজন মন্ত্রী অনেকটা বিরক্ত হয়েই বলে ফেলেছিলেন, ‘কম খান’। এখন দেখা যাচ্ছে, পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে এসে ঠেকেছে, মানুষকে বাধ্য হয়েই তার কথামতো চলতে হচ্ছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা যদি বেড়েই থাকে, তাহলে বড় বড় শপিং মল এমনকি হকার্স মার্কেটগুলোতে দোকানদারদের বনি-বাট্টা করতে তীর্থের কাকের মতো কেন বসে থাকতে হচ্ছে? তাদের বেচা-কেনা কেন তলানিতে ঠেকেছে। দিনের স্বাভাবিক সেল কেন কমে গেছে? এমন অনেক দোকানি রয়েছে, যারা দুই-তিন দিন পর বনি করে। এ পরিস্থিতি কি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির পরিচয় দেয়? বড় বড় শপিং মলে দোকান রয়েছে এমন অনেক ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে তাদের হতাশার কথা শুনেছি। তাদের এক কথা, ‘ভাই, ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা খুব খারাপ। কেবল ভর্তুকি দিয়ে কোনো রকমে টিকিয়ে রেখেছি। এভাবে আর কতদিন টিকিয়ে রাখতে পারব, জানি না। ইতোমধ্যে দুটি দোকানের মধ্যে একটি ছেড়ে দিয়েছি।’ বড় শপিংমলগুলোর বাইরে হকার্স মার্কেটের দোকানদারদের সাথেও কথা বলেছি। কথা বলেছি এ কারণে যে, বড় শপিং মলগুলোতে কেনাকাটা কমে গেলে নিশ্চয়ই হকার্স মার্কেটে বিক্রি বাড়ার কথা। কারণ বড় শপিংমলে কেনাকাটার সক্ষমতা হারিয়ে মানুষের হকার্স মার্কেটমুখী হওয়ার কথা। এ হিসাবে সেখানে বেচাকেনা বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক। এই লক্ষ্য নিয়ে, হকার্স মার্কেটের বেশ কয়েকজন দোকানদারের সাথে যখন কথা বলি, তখন তারাও হতাশা প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, ‘ভাই, স্বাভাবিক বেচাকেনা দূরে থাক, বনি করতেই দিন পার হয়ে যায়।’ সবাই একমত হবেন কিনা জানি না, তবে যারা খোঁজখবর রাখেন, তারা বাজার অর্থনীতির এই করুণ চিত্র নিশ্চিতভাবেই জানেন। হ্যাঁ, ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। তা একটি শ্রেণির ক্ষেত্রে। আমরা যদি, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ধনীক শ্রেণি এবং নব্য বড়লোক হওয়াদের কথা ধরি, তবে ভিন্ন কথা। তাদের ক্রয়ক্ষমতা আকাশচুম্বী বেড়েছে। এখন সরকার যদি তাদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধিকে বাকি সব মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি বলে গৌরব করে, তবে বলার কিছু নেই। সরকার যদি মনে করে এরাই জনগণ, তাতেও বলার কিছু নেই। সরকারের ওপর তো কেউ নেই। সরকারের কথা বা সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
তিন.
এবার দেশের সার্বিক বিনিয়োগ চিত্রের দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। সরকার দেশের অর্থনীতি ব্যাপক চাঙ্গা এবং উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে চলেছে বলে বারবার বলছে। সরকারের এ কথার গতির সাথে তাল মিলিয়ে যদি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ গতি পেত, তবে এর চেয়ে আনন্দের আর কিছুই হতো না। সরকারকেও জনগণ অকুণ্ঠচিত্তে বাহবা দিত। বাস্তবতা হচ্ছে, অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন, বিনিয়োগ ক্ষেত্রে কী করুণ দশা চলছে! বিনিয়োগ বলতে কিছু নেই। অথচ সরকারের উন্নয়নের তুর্কিনাচের সাথে যদি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তাল মেলাতো, তাহলে বিনিয়োগে ক্ষেত্রটি সয়লাব হয়ে যাওয়ার কথা। তা যে হচ্ছে না, ব্যাংকগুলোর করুণ চিত্র থেকে সহজেই বোঝা যাচ্ছে। এ চিত্র বুঝতে খুব বেশি জ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই। সবাই জানেন, ব্যাংকের মূল কাজ হচ্ছে, আমানতকারীর কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে তা ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানাসহ বিভিন্ন খাতে সুদের বিনিময়ে ঋণ দেয়া। সেই সুদ দিয়েই ব্যাংক নির্দিষ্ট হারে আমানতকারীদের আমানতের সুদ বা লাভ দেয় এবং ব্যাংকের কার্যক্রম পরিচালনা করে। আমানতকারী যখন দেখে ব্যাংক তাদের আমানতের সুদ কমিয়ে দিয়েছে এবং ব্যাংকের সার্ভিস চার্জসহ বিভিন্ন চার্জের নামে তাদের আমানত থেকে অর্থ কেটে নিচ্ছে, তখন তাদের বুঝতে বাকি থাকে না ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা কি। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন ব্যাংক বিভিন্ন গোপন চার্জের নামে আমানতকারীর আমানত কাটতে কাটতে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে, লাভ দূরে থাক তাদের আসলই থাকছে না। ফলে বাধ্য হয়েই আমানতকারীরা এখন ব্যাংক থেকে মুখ ফিরিয়ে জাতীয় সঞ্চয়পত্র ও বিভিন্ন বন্ডের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। কারণ এসব সঞ্চয়পত্র ও বন্ডে সুদের হার ব্যাংকগুলোর বর্তমান প্রদেয় সুদের হারের চেয়ে প্রায় দেড়গুণ বেশি। স্বাভাবিকভাবেই যেখানে আমানতকারীরা লাভ বেশি পাবে সেখানেই ছুটে যাবে। শুধু আমানতকারীরাই নয়, ব্যাংকগুলোও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ শুরু করেছে। ব্যাংকের এ চিত্র কি অর্থনীতির উন্নতির সূচক নির্দেশ করে? আবার ব্যাংকগুলোতেই বিপুল অংকের টাকা অলস পড়ে আছে। বিনিয়োগ ও উন্নয়ন কার্যক্রম যদি গতিশীলই থাকত, তবে এই বিশাল অংকের (প্রায় এক লাখ কোটি টাকা) অর্থ অলস পড়ে থাকত না। এই অলস টাকা পুষতে এখন ব্যাংকগুলোকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কারণ এগুলো আমানতকারীদের টাকা। তাদের নির্দিষ্ট হারে সুদ বা লাভ দিতেই হবে। অন্যদিকে ব্যাংকের যে মূল কাজ, বিভিন্ন খাতে ঋণ দিয়ে লাভ করা, সেই ঋণ এতটাই শ্লথ যে, সুদের হার প্রায় অর্ধেক কমিয়েও বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারছে না। তাহলে সরকারের কথা মতো অর্থনীতি ভালো আছে কীভাবে? বাংলাদেশের বিনিয়োগের এই করুণ চিত্র গত ২৭ অক্টোবর বিশ্বব্যাংকের ‘ডুয়িং বিজনেস ২০১৭’ প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ব্যবসা পরিবেশের সূচকে বাংলাদেশ সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। প্রতিবেদনটি দশটি মাপকাঠিতে তৈরি করা হয়। মাপকাঠিগুলো হলোÑ নতুন ব্যবসা শুরু করা, অবকাঠামো নির্মাণের অনুমতি পাওয়া, বিদ্যুৎ সুবিধা, সম্পত্তির নিবন্ধন, ঋণ পাওয়ার সুযোগ, সংখ্যালঘু বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা, কর পরিশোধ, বৈদেশিক বাণিজ্য, চুক্তি বাস্তবায়ন ও দেউলিয়া হওয়া ব্যবসার উন্নয়ন সহজিকরণ। এসব মাপকাঠিতে যে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে, তা-ই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারের কথামতো বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে কীভাবে? বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইং কিমও সম্প্রতি বাংলাদেশে সফরে এসে বিনিয়োগ খরার কথা বলেছেন। বলেছেন, উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) খুব কম। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে আছে। এখানে বিদেশি বিনিয়োগ জিডিপির মাত্র ১.৭ শতাংশ। অথচ ভিয়েতনামের জিডিপিতে বিদেশি বিনিয়োগের অবদান ৬ শতাংশ। সম্প্রতি সরকারের ঘোষিত জিডিপির হার ৭.১১ শতাংশকে যুক্তিযুক্ত নয় বলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, এ প্রবৃদ্ধি কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। এমনকি ৭.০৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির সাময়িক হিসাব যখন দেয়া হয়েছিল, তখনও বলেছিলাম এ হিসাব যৌক্তিক নয়। তিনি বলেছেন, বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ অনেকটা স্থবির হয়ে আছে। জিডিপিতে এ খাতের বিনিয়োগ কমেছে। সরকারি বিনিয়োগ বাড়লেও এটা জিডিপির আকারের তুলনায় খুবই কম। এসব বিবেচনায় আমার প্রাক্কলন ছিল, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬.৭ শতাংশ। তিনি বলেন, বিভিন্ন দাতা সংস্থা জিডিপি সম্পর্কে পূর্বাভাস দিলেও শেষ পর্যন্ত সরকারি হিসাবটি মেনে নেয়। এটি একটি সমস্যা। অর্থনীতির এ হিসাবটি থেকে পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, সরকারের উন্নয়নের চিত্র আর অর্থনীতিবিদদের নির্মোহ বিশ্লেষণে আকাশ-পাতাল ফারাক রয়েছে। বলাবাহুল্য, সরকারের মধ্যে এ প্রবণতা প্রবল ভেতর ফাঁপা রেখে বা ক্ষত লুকিয়ে তা কথার ফুলঝুরি বা আলোকসজ্জা দিয়ে ঢেকে দেয়া। অনেকটা এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষায় ‘ছেলের হাতে মোয়া’ ধরিয়ে দেয়ার মতো শিক্ষার্থীদের বেসুমার জিপিএ-৫ দিয়ে খুশি করা। অথচ এদের অধিকাংশই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল ও বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে ন্যূনতম পাস মার্ক পায় না।
চার.
সরকারের উন্নয়নের কথা এবং দেশ নি¤œমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার ঘোষণার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ইতোমধ্যে দেখা দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক আগে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে আমাদের অত্যন্ত স্বল্প সুদে (০.৭৫ শতাংশ) ঋণ দিত। এখন যেহেতু আমরা নি¤œমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি, তাই এ সুবিধা আমরা পাব না। বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হলে এখন উচ্চ সুদ হারে (৩ শতাংশের উপরে) নিতে হবে। আর ঋণ আমাদের নিতেই হবে। এ ছাড়া চলার উপায় নেই। এই যেমন সম্প্রতি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং-এর সফরের সময় চীন থেকে যে বিপুল অংকের ঋণ সহায়তা নিয়ে এসেছিলেন, তাতেও শতকরা ২ ভাগ হারে সুদ দিতে হবে। এর আগে ভারত থেকেও উচ্চ সুদ হারে ঋণ নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ আমরা অনেকটা ঋণে ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েছি। এক হিসাবে দেখা গেছে, এ পর্যন্ত বাংলাদেশ যে পরিমাণ ঋণ নিয়েছে, তাতে মাথাপিছু পাঁচ হাজার টাকা করে ঋণের বোঝা চেপেছে। অর্থাৎ একজন ভিক্ষুককেও এই পরিমাণ ঋণ বহন করতে হচ্ছে। এই ঋণের বোঝা নিয়েই আমরা নি¤œমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি! তরতর করে উন্নতি করছি! কী বিস্ময়কর ব্যাপার! শুধু তাই নয়, বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, হতদরিদ্র লোকের সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশ রয়েছে। বাংলাদেশে হতদরিদ্রের সংখ্যা এখনো দুই কোটির মতো। এই মানুষগুলো প্রতি মাসে ১২৯৭ টাকা আয় করতে পারে না। এর সাথে যদি লাখ লাখ বেকারের সংখ্যা যুক্ত হয়, যারা কোনো আয়ই করে না, তাহলে প্রকৃত সংখ্যাটি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা অনুমাণ করতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। যেখানে আমরা এখনো দরিদ্র দূরে থাক হতদিরদ্র তালিকা থেকে বের হয়ে আসতে পারিনি, সেখানে উন্নয়নের মহাসড়কে উঠে গেছি বলে ঢোল বাজানো কতটা যৌক্তিক? সরকারের কথামতো আমরা যদি এতই উন্নতি করে থাকি, তবে অর্থনীতির এসব দুরবস্থার হিসাব-নিকাশ আসে কোত্থেকে? এসব পরিসংখ্যান ও হিসাব থেকে কি সরকারের কথা অনেকটা অসার প্রমাণ করে না? এটা বলছি না, আমরা উন্নতি করছি না। কোনো দেশই উন্নতি ছাড়া থাকে না। তবে দেখতে হবে প্রকৃত ও টেকসই উন্নতি কতটা হচ্ছে। কচ্ছপগতির উন্নতিকেও উন্নতি বলা যায়। সরকারকে বিষয়টি বুঝতে হবে। উন্নয়নের কথামালা দিয়ে ক্ষমতা প্রলম্বিত করার চেষ্টা সমীচীন নয়। বড় বড় মেগা প্রকল্পকে উন্নয়নের ‘লকেট’ বানানো যায়, সুষম উন্নয়নের মালা গাথা যায় না। সরকারকে বিষয়টি উপলব্ধি করে এবং মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতির প্রকৃত চিত্র অনুধাবন করে উন্নয়ন পরিকল্পনা এগিয়ে নিতে হবে। বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। ব্যাংকের অলস টাকা কাজে লাগাতে হবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।