Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

২৫ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্জন শূন্য

জামানতবিহীন ক্ষুদ্র ঋণে অনীহা

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:০৩ এএম

ছোট ছোট ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের পরিকল্পনা ও সম্ভাবনা আছে কিন্তু অর্থ নেই। আবার ব্যাংকের কাছে ঋণ নিতে গেলেও গ্যারান্টি না থাকার কারণে ব্যাংকও টাকা দেয় না। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্ভাবনা থাকার পরও তা কাজে লাগাতে পারছে না। অবশ্য এ বাধা কাটাতে কুটির শিল্প, ছোট ও ক্ষুদ্রশিল্প খাতের উদ্যোক্তাদের জামানত না থাকে বা অপর্যাপ্ত জামানত থাকে এমন উদ্যোক্তার ঋণের গ্যারান্টি দেবে সরকার। বিশ্ব ব্যাংক গ্রুপের ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) সহযোগিতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম বিভাগ এমন কার্যক্রম শুরু করেছে। স্কিমের আওতায় গ্রাহকরা ২৫ হাজার থেকে ১ কোটি পর্যন্ত ঋণ নিতে পারবেন। স্কিমের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের ২ হাজার কোটি টাকা ঋণ প্রদানের লক্ষ্য ছিল। দীর্ঘদিন পর হলেও এ ধরনের ব্যাতিক্রমী উদ্যোগ আর্থিকখাতসহ সর্বমহলে প্রশংসা পেয়েছে। এমনকি ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে ৩৭টি ব্যাংক গ্রাহকদের ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম সার্ভিস প্রদান করবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করে। প্রতিটি ব্যাংক এই সেবার জন্য ৩ জন কর্মকর্তাকেও নির্দিষ্ট করে দায়িত্ব দেয়। যারা শুধুমাত্র এই কার্যক্রমের জন্য নির্ধারিত। অথচ চুক্তি করেও ২৫টি ব্যাংক একজন গ্রাহককেও ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম সুবিধা প্রদান করতে পারেনি। এ ২৫টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্জন শূন্য। অবশ্য ব্যাংকগুলো বলছে, এই ধরনের গ্যারান্টি স্কিম বাংলাদেশে নতুন। করোনার কারণে প্রচার-প্রচারণা না থাকায় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা এই স্কিমের বিষয়ে খুব একটা জানেন না। তাই উদ্যোক্তাদের আগ্রহ কম।

বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ছোট উদ্যোক্তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবেই ব্যাংকগুলোর পাশে দাঁড়ানোর কথা। ব্যাংকগুলোর ঊর্ধ্বতনরা বিভিন্ন সময়ে নিজেদেরকে সেবাধর্মী ও মানবিক ব্যাংকিংয়ের বুলি আওড়ান। শুধু মুনাফার জন্যই ব্যাংক সেবা দেন না। সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলেন। আবার অনেক ব্যাংক মালিক এ ধরনের কার্যকম প্রদান করবেন বলেই ব্যাংকের লাইসেন্স নেন। অথচ যখন সুযোগ এসেছে কাজ করার তখন ব্যাংকের মুনাফা নেই বা বড় ঋণের মতো কমিশন পাওয়া যাবে না বলে গ্রাহকদের ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম সার্ভিস প্রদানে অনীহা। তাদের মতে, ব্যাংকগুলো এ ধরনের কার্যক্রমে সাড়া না দিলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। একই সঙ্গে নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন না করলে তাদেরকে জরিমানাসহ নুতন ব্র্যাঞ্চ খুলতে না দেয়ার মতো কঠোর সিদ্ধান্তের আওতায় আনতে হবে।

সূত্র মতে, ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের পরিকল্পনা ও সম্ভাবনা আছে কিন্তু অর্থ নেই। আবার ব্যাংকের কাছে ঋণ নিতে গেলেও গ্যারান্টি না থাকার কারণে ব্যাংকও টাকা দেয় না। কুটির, ছোট ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের এ ধরনের ঋণের বিপরীতে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত গ্যারান্টি দেবে সরকার। বাণিজ্যিক ব্যাংক এসব কুটির, ছোট ও ক্ষুদ্র গ্রাহকের আবেদন পাওয়ার পর গ্রাহকদের ব্যবসা পরিকল্পনা ও বাস্তবতা যাচাই করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগে পাঠাবে। এসব উদ্যোক্তার নাম বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকায় সন্নিবেশিত করে ঋণ বিতরণের অনুমতি দেবে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের নিজের তহবিল থেকে ঋণ বিতরণ করবে। ওই ঋণের টাকা কোনো কারণে ফেরত না এলে বাংলাদেশ ব্যাংক ওই টাকার ৮০ ভাগ ফেরত দেবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, এ ঋণ বিতরণের জন্য ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে ৩৭টি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তি করেও ২০২১ সালে ১২টি প্রতিষ্ঠান ৩১৮টি গ্যারান্টি আবেদনের মাধ্যমে মাত্র ৩৪ দশমিক ৬১৫ কোটি টাকা ঋণ প্রদান করে। ১২টি প্রতিষ্ঠান হলোÑ আইডিএলসি ফাইন্যান্স সর্বোচ্চ ২৫৫টি গ্যারান্টি প্রদান করে। এরপর ৩৪টি গ্যারান্টি প্রদান করে অগ্রণী ব্যাংক। এছাড়া বাংলাদেশ ফাইন্যান্স ৬টি, ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ ৫টি, ট্রাস্ট ব্যাংক ৪টি, যমুনা ব্যাংক ৩টি, ওয়ান ব্যাংক ৩টি, ইস্টার্ণ ব্যাংক ২টি, শাহজালাল ইসলামি ব্যাংক ২টি, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ২টি, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ১টি এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ১টি গ্যারান্টি প্রদান করে।

চুক্তিবদ্ধ বাকি ২৫টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্জন শূন্য। এসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে কোন ধরনের গ্যারান্টির আবেদন পাঠানো হয়নি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। অর্জনশূন্য প্রতিষ্ঠানগুলো হলোÑ জনতা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার এন্ড কমার্স ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, ডাচ বাংলা লিমিটেড, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া, সাউথইস্ট ব্যাংক, আইপিডিসি ফাইনান্স লিমিটেড, অগ্রণী এসএমই ফাইন্যান্সিং কোম্পানি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, মধুমতি ব্যাংক, মেঘনা ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক এবং এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক।

তহবিল পরিচালনার জন্য গঠিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম (সিজিএস) ইউনিটের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, জামানত না থাকার অজুহাতে সম্ভাবনাময় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা যেন ঋণ বঞ্চিত না হন সে লক্ষ্যে ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম চালু করা হয়েছে। এ বিষয়ে ব্যাংকারদের প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছে। তারপরও স্কিমের আওতায় ঋণ প্রদানে ব্যাংকগুলোর আগ্রহ কেন কম বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখা হচ্ছে। এমনকি ব্যাংকগুলো নির্ধারিত লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে না পারলে শাস্তির আওতায় আনার বিষয়েও ভাবা হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন।
ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরফান আলী বলেন, ছোট ঋণ দেয়া এবং এগুলো দেখভাল করার দক্ষতা ও সক্ষমতা ব্যাংকগুলোর কম। এছাড়া ক্ষুদ্র পর্যায়ে উদ্যোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাতেই ব্যাংকগুলোর যে ধরনের নেটওয়ার্ক থাকার কথা সেটা নেই। আবার ঝুঁকিও থাকে বেশি। এসব কারণে এই স্কিমের নিয়ে ব্যাংকগুলো অতটা আগ্রহ দেখাচ্ছে না।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান এসএমই ফাউন্ডেশন এর মহাব্যবস্থাপক নাজিম হাসান সাত্তার বলেন, স্কিমটিকে জনপ্রিয় করতে হলে ব্যাংকগুলোকে দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এটি বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও কঠোর হতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, অনেক ছোট উদ্যোক্তার ইচ্ছা ও ব্যবসার ক্ষেত্র থাকলেও টাকার অভাবে তা শুরু করতে পারে না। ঋণের জন্য ব্যাংকে গেলেও জামানত না থাকার কারণে ব্যাংক ঋণ দেয় না। ফলে অনেক সম্ভাবনা আঁতুর ঘরেই মৃত্যু হয়। আবার অনেকে ঝুঁকি নিয়ে এনজিও বা মহাজনী ঋণ নিয়ে কার্যক্রম শুরু করলেও বাড়তি সুদের চাপে সম্ভাবনার উদ্যোগ চিঁড়ে-চ্যাপটা হয়ে যায়। এসব ব্যবসায়ীর পাশে দাঁড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম সার্ভিস উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তিনি ব্যাতিক্রমী এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে দেশের স্বার্থে, কর্মসংস্থানের স্বার্থে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার আহবান জানান।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত যেসব ছোট উদ্যোক্তার ঋণের বিপরীতে জামানত দেয়ার সক্ষমতা নেই, তাদের জন্য জামানতের ব্যবস্থা একটি সময়োপযোগী উদ্যোগ। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর ক্ষুদ্র গ্রাহক পর্যায়ে যাওয়ার কাজটি সহজ হবে। ছোট ছোট উদ্যোক্তা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাও তৈরি হবে।

উল্লেখ্য, কুটির, মাইক্রো ও ক্ষুদ্র (সিএমএস) উদ্যোগ খাতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিতরণ করা জামানতবিহীন ঋণের ঝুঁকি বহনের জন্য ২০২০ সালের ২৭ জুলাই দুই হাজার কোটি টাকার একটি স্কিম গঠন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই তহবিলের আওতায় ৮ হাজার ৩২০ কোটি টাকার ঋণের বিপরীতে গ্যারান্টি দেয়া হবে। বিতরণ করা কোনো ঋণ খেলাপি হলে তার ৮০ শতাংশ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক। এর আওতায় একজন উদ্যোক্তাকে ২৫ হাজার থেকে থেকে ১ কোটি টাকা ঋণ দেয়া যাবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ব্যাংক ও আর্থিক


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ