বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
ইসলাম পরিপূর্ণ জীবন বিধান ও আল্লাহ পাকের পছন্দনীয় দ্বীন। লক্ষ্য করলে প্রতিভাত হয় যে, ইসলামী জিন্দেগির উন্নতী অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি অন্তরকে, মনকে, হৃদয়কে কেন্দ্র করেই ফুলে, ফলে সুশোভিত হয়ে উঠে। হৃদয় রাজ্যে সমৃদ্ধির বীজ রোপিত হলে, তা দেহ বল্লরীর সর্বত্র স্বীয় শাখা প্রশাখা বিস্তার করে গোটা দেহকে আলোচিত ও সৌন্দর্যে মণ্ডিত করে তোলে। এবং এতে করে দুনিয়া ও আখেরাতের জীবন হয় সফল, কৃতার্থ, সুন্দর ও মনোহর। তাই, অন্তরের সংশোধন, হৃদয়ের পবিত্রতা, মনের বিশুদ্ধতার প্রতি মনোযোগ দেয়ার প্রতি ইসলামে তাগিদ প্রদান করা হয়েছে।
কারণ, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বান্দাহর অন্তরকে দেখার স্থান ও দর্শনের আয়না বানিয়েছেন। এতদ প্রসঙ্গে পিয়ারা নবী মোহাম্মাদ মোস্তাফা আহমাদ মুজতাবা (সা.) সুস্পষ্টভাবে পথ নির্দেশনা প্রদান করেছেন। হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত তোমাদের বাহ্যিক আকার-আকৃতি ও দেহশৌষ্ঠবের দিকে দৃষ্টিপাত করেন না, বরং তিনি লক্ষ্য করে থাকেন তোমাদের অন্তরের দিকে এবং তিনি (রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বীয় আঙ্গুল দিয়ে বক্ষ্যদেশের বা অন্তরের দিকে ইশারা করলেন।’ (সহীহ মুসলিম : হাদীস নং ২৫৬৪)।
বস্তুত : ঈমান ও কুফুরী, হেদায়েত ও গোমরাহী, সততা ও পথভ্রষ্টতার মূল প্রথমে বান্দাহ্্র অন্তরেই শিকড় গাড়ে বিধায়, অন্তরের বিষয়ে অধিক মনোযোগ দেয়ার প্রতি তাগিদ করা হয়েছে। কারণ, মানুষের অন্তরই হলো তার দেহের বাদশাহ, এবং সম্মানিত রাষ্ট্রপ্রধান। এজন্য অন্তরের পরিচ্ছন্নতা যথার্থতা, সুস্থতা ও সঠিকতাই হলো সকল প্রকার কল্যাণ ও মঙ্গলের মূল এবং দুনিয়া ও আখেরাতের মুক্তি ও নিষ্কৃতির মাধ্যমে।
হযরত নো’মান ইবনে বাশীর (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন : ‘সাবধান! জেনে রেখো দেহে বা শরীরে একটি মাংস খণ্ড আছে। মাংস খণ্ডটি যখন সুস্থ ও ভালো থাকে তখন সমস্ত দেহেও শরীর সুস্থ ও ভালো থাকে। আর তা’ যখন নষ্ট ও বিকৃত হয়ে যায় তখন সমস্ত দেহ ও শরীর নষ্ট হয়ে যায়। আর জেনে রাখো, সেই মাংস খণ্ডটি হলো ক্বালব বা অন্তর।’ ( বুখারী : পৃ. ৫২; মুসলিম : পৃ. ১৫৯৯)।
সুতরাং একথা অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও পরিষ্কারভাবে বলা যায় যে, অন্তরের ইবাদত ও আনুগত্যই হলো মূল অধিষ্ঠান, যার ওপর ভর করে সমস্ত ইবাদত-বন্দেগি দণ্ডায়মান হয়। তাই, শারীরিক যথার্থতা ও সঠিকতা নির্ভর করে অন্তরের সঠিকতার ওপর। অন্তর যখন তাকওয়া, পরহেজগারী ঈমান ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে যথাযথ ও সঠিক হয়ে যাবে তখন সমস্ত শরীর ও তার আনুগত্য করবে এবং আজ্ঞানুবর্তী থাকবে। হযরত আনাস বিন মালেক (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন : ‘বান্দাহর অন্তর সঠিক, সোজা ও যথাযথ না হওয়া পর্যন্ত তার ঈমান খাঁটি ও যথার্থ হবে না।’ (মোসনাদে আহমাদ : হাদীস নং ১৩০৭৯)।
এতে বোঝা যায় যে, বান্দাহর ঈমান ততক্ষণ পর্যন্ত সঠিক, মুক্ত ও পরিচ্ছন্ন হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তার অন্তর সোজা ও সঠিক না হবে। একারণেই সর্বময় জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও শক্তির অধিকারী আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত ভয়াবহ কিয়ামতের দিনের মুক্তি ও নিষ্কৃতিকে অন্তরের সঠিকতা হৃদয়ের সততা ও মনের পরিচ্ছন্নতার সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে : ‘যে দিন ধন-সম্পদ ও সন্তান সন্ততি কোনো কাজে আসবে না, সেদিন উপকৃত হবে শুধু সে ব্যক্তি যে, আল্লাহর নিকট বিশুদ্ধ অন্তঃকরণ নিয়ে আসবে।’ (সূরা শুয়ারা : আয়াত-৮৮-৮৯)।
অন্তরের বিষয়ে অধিক মনোযোগ প্রদানের তাগিদের দ্বিতীয় কারণ হলো এই যে, অন্তরের (ক্বালবের) সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ও লক্ষণ হলো এই যে, তা সর্বদাই পরিবর্তনশীল। জনৈক মরমী কবি কত সুন্দরইনা বলেছেন : ‘মানুষকে তার বন্ধুত্ব ও ঘনিষ্ঠতার জন্যই ইনসান নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর অন্তরকে ক্বালব নামে বিভূষিত করা হয়েছে এজন্য যে, তা নিত্য পরিবর্তনশীল।’ তাই দেখা যায়, অন্তর হলো দ্রুত পরিবর্তনশীল এবং অত্যন্ত স্বাধীন ইচ্ছার অধিকারী।
হযরত মিকদাদ ইবনে আসওয়াদ (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন : ‘আদম সন্তানের অন্তর হাড়ি-পাতিলের উথলানো বা টগবগ করে ফোটা পানি থেকেও অধিক দ্রুত পরিবর্তনশীল।’ তারপর হযরত মিকদাদ (রা.) বলেন : ‘সেই ব্যক্তিই সৌভাগ্য বান যার থেকে ফিতনা বা অশান্তি দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। তিনি উক্ত বাক্যটি তিনবার পুনরাবৃত্তি করেন এবং এর দ্বারা তিনি অন্তরের ফিতনা, পরীক্ষা ও পরিবর্তনের কারণের দিকে ইঙ্গিত করেন।’ (মোসনাদে আহমাদ : পৃষ্ঠা : ২৪৩১৭)।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।