Inqilab Logo

মঙ্গলবার ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১, ০২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ঈদগাহ দখল করে কাঁচাবাজার

ডিএনসিসি ওয়ার্ড নম্বর-৬

ইয়াছিন রানা | প্রকাশের সময় : ২৫ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:০৬ এএম

বাইরে দেখে দেখলে যে কেউ বলবে ঈদগাহ। বাওয়ান্ডারি করা মাঠের গেটেও লেখা রয়েছে ঈদগাহ ময়দান। ঈদগাহে ইমামের দাড়ানোর জন্য রয়েছে মিম্বর। অথচ ঈদগাহে ঈদের নামাজ হয় না দুই দশক ধরে। ঈদগাহ দখল করে বানানো হয়েছে কাঁচা বাজার, মাছের আড়ত। ঈদগাহের সাথেই মসজিদ ও মাদরাসা। রাজধানীর মিরপুর ৬ নম্বর মসজিদ ও মাদরাসা কমপ্লেক্সের সাথেই এই ঈদগাহ বেদখল হওয়া নিয়ে স্থানীয় কারো মাথা ব্যাথা নেই। বরং স্থানীয় কাউন্সিলর, মসজিদ-মাদরাসা কমিটির নেতৃবৃন্দ ঈদগাহ দখল করে কাঁচাবাজার বানানোর সাথে জড়িত।
নামে ঈদগাহ হলেও এটি মূলত জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের (জাগৃক) একটি খালি প্লট। জাগৃক ঢাকা ডিভিশন-১ এর কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ৬ নং মসজিদের পাশের প্লটটি কাউকে বরাদ্ধ দেয়া হয়নি। এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খেলার মাঠ হিসেবে এক সময় এলাকাবাসী জোর করেই দখলে রেখেছিল এই প্লটটি। বানানো হয় ঈদগাহ। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে দখল হয়ে গেছে ঈদগাহ মাঠটিও। প্রভাবশালীরা ঈদগাহকে মাঠকে বানিয়েছে কাঁচাবাজার। উসিলা হিসেবে দেখানো হচ্ছে, পাশের মসজিদ ও মাদরাসা কমপ্লেক্সে দারুল উলুম মাদরাসার এতিম ছাত্রদের ব্যয় নির্বাহ করা। কিন্তু সেখানোও ঠকানো হচ্ছে মাদরাসা ছাত্রদের। পেট পুরছে মাদরাসা কমিটি ও ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় কিছু দুবৃত্তপরায়ন নেতাকর্মী। ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা ভাড়া উঠলেও মাদরাসার হিসেবে তা দেখানো হয় মাত্র ১ লাখ বিশ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা। এলাকাবাসীর অভিযোগ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৬ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর তাইজুল ইসলাম বাপ্পীর আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে চলছে এসব। দারুল উলুম মাদরাসা কমিটির সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন ইনকিলাবকে জানান, সবকিছুই কাউন্সিলর সাহেব দেখেন। কোন কিছু জানতে হলে তার কাছে জিজ্ঞেস করেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, মাদরাসার ব্যয় নির্বাহের জন্য পাশেই একটি প্লটে রয়েছে কাচাবাজার। বাজারের দোকান ভাড়া থেকে মাদরাসার সকল ব্যয় নির্বাহ করা হয়। ঈদগাহে ইমামের দাড়ানোর জন্য এখনো রয়েছে মিম্বর কিন্তু হয় না কোন ঈদের নামাজ। মাঠের অর্ধেকের বেশি জায়গায় রয়েছে টিন শেডের কাচাবাজার। বাকি খালি অংশে সকালে বসে মাছের আড়ত। সবমিলিয়ে দোকানের সংখ্যা ৩ শত। এরমধ্যে মাছের আড়ত ৩৫টি, মুরগির আড়ত ১০টি, বরফ কল একটি। এই সব দোকানের ভাড়া থেকে পরিচালিত হয় মাদরাসায় পড়ুয়া ছাত্রদের খরচ, শিক্ষকদের বেতন।
কিন্তু এখানেই যত ঘাপলা। প্রতি মাসে প্রায় ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা ভাড়া উঠলেও মাদরাসায় খাতায় তা দেখানো হয় মাত্র এক থেকে দেড় লাখ টাকা। অভিযোগ রয়েছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের-ডিএনসিসি ৬ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তাইজুল ইসলাম বাপ্পী তার লোকজন দিয়ে পুরো বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন এবং ভাড়া তোলেন। তার সাথে আরো জড়িত মাদরাসা কমিটির সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন, দোকান মালিক সমিতির সভাপতি আবুল হোসেন, ৬ নং ওয়ার্ড যুবলীগের আহবায়ক শেখ মোহাম্মদ সেলিম ওরফে গরু সেলিম।
মাদারাসা কমিটির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দোকান থেকে দৈনিক ভাড়া আদায় করেন তারা। তিনশোটি দোকান থেকে প্রতিদিন ২ থেকে ৫ পাঁচ হাজার টাকা তোলায়। সব মিলিয়ে মাসে ১ লাখ থেকে দেড়লাখ রাখা ভাড়া পান তারা। মাদরাসার হিসেবে প্রতিটি দোকানের ভাড়া মাসে গড়ে মাত্র তিন শত টাকা।
এদিকে দোকানদের সাথে কথা বলে জানা যায়, দোকানের আকার অনুযায়ী দেড়শত থেকে চারশত টাকা তোলা হয় দৈনিক। সে হিসেবে প্রতিটি দোকান থেকে মাসে সাড়ে চার থেকে ৮ হাজার টাকা ভাড়া আদায় করা হয়। সে হিসেবে মাসে ভাড়া উঠে প্রায় ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার বেশি। বাজারে কেউ নতুন দোকান নিতে চাইলে কাউন্সিলর সাহেবের কাছ থেকে দোকান ভাড়া নিতে হয়।
দোকানদারদের সাথে কথা বলে আরো জানা যায়, দোকান নিতে হলে কাউন্সিলর তাইজুল ইসলাম বাপ্পীকে অগ্রিম হিসেবে অফেরতযোগ্য একটি অংকের টাকা দিতে হয়। মাছের আড়তের জন্য দেড় লাখ টাকা। মুরগির আড়তের জন্য একলাখ বিশ হাজার টাকা। ফলের দোকানের জন্য ৫০ হাজার টাকা। সবজির দোকানের জন্য ৬০ হাজার টাকা দিতে হয়।
মাদরাসা কমিটি জানায়, অগ্রিম হিসেবে কোন টাকা মাদরাসার ফান্ডে জমা হয় না। কমিটির সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন ইনকিলাবকে বলেন, বাজারের পুরো বিষয়টি কাউন্সিলর তাইজুল ইসলাম বাপ্পী দেখেন। মাদরাসার ফান্ডে দৈনিক ২ থেকে ৫ হাজার টাকা জমা দেয়া হয় বলে জানান তিনি। তিনি আরো জানান, মসজিদ কমপ্লেক্সের ১২০টি দোকানের পজিশন বিক্রি করা। এর থেকে কোন টাকা মাদরাসায় আসে না। বাজারের টাকা দিয়ে মাদরাসা পরিচালনা করা হয়। প্রকৃত ভাড়া উঠে অনেক কিন্তু আপনারা টাকা কম উত্তোলন দেখান এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, যে টাকা উঠে তার রশিদ রয়েছে। আর মার্কেটের দোকান ও ভাড়ার বিষয়টি সরাসরি কাউন্সিলর বাপ্পী সাহেব দেখে। এটা এমপি ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ সাহেবও জানেন। তাদের সাথে কথা বলেন।
দোকান মালিক সমিতির সভাপতি আবুল হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, বাজারের প্রতিটি দোকানের ভাড়া দৈনিক ১০ টাকা করে মাসে ৩০০ টাকা। এতা কম টাকা ভাড়া কোথাও আছে কিনা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এই ভাড়া ঠিক আছে।
৬ নং ঈদগাহ মাঠ উদ্ধারে এই এলাকায় আন্দোলন হয়েছে বিভিন্ন সময়। মাঠ উদ্ধার করে শিশুদের জন্য খেলার মাঠ বানানো জন্য মানববন্ধন হয়েছে। এছাড়া জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের স্মারক লিপি দেয়া হয়েছে।
ঈদগাহ মাঠ উদ্ধারের আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ফকির কামাল হোসেন রিপন ইনকিলাবকে বলেন, এই এলাকায় খেলার জন্য কোন মাঠ নেই। ঈদগাহকে বানানো হয়েছে বাজার। এমপি ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ বিভিন্ন সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েও মাঠ উদ্ধার করেননি। বাজার থেকে প্রতি মাসে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা আয় হলেও মাদরাসার ফান্ডে সামান্য কিছু টাকা জমা দিয়ে বাদবাকি টাকা মেরে দেয়া হয়। এর সাথে কাউন্সিলর তাইজুল ইসলাম বাপ্পী, মাদরাসা কমিটির সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন, যুবলীগের সেলিম জড়িত।
এ বিষয়ে ডিএনসিসির ৬ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর তাইজুল ইসলাম বাপ্পী ইনকিলাবকে বলেন, ঈদগাহ মাঠের বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আমি কাউন্সিলর হয়েছি ২ বছর কিন্তু এখানে প্রায় ২০ বছর আগে থেকে বাজার চলছে। আমার বা আমার আত্মীয়-স্বজন কেউ এটার সাথে জড়িত না। মাদরাসা কমিটি সাধারণ সম্পাদক আপনার কথা বলেছেন বিষয়টি জানালে বাপ্পী বলেন, গিয়াস সাহেব কেন বলেছেন জানি না।
বাপ্পী আরো জানান, আমার ওয়ার্ডে মাঠ, কাঁচাবাজার, কমিউনিটি সেন্টার নেই। সেজন্য এই প্লটটি জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বরাদ্ধ নিয়ে সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কমপ্লেক্স বানানোর জন্য ইতোমধ্যে আমি গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ ও ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে চিঠিও দিয়েছি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক ইনকিলাবকে বলেন, এই ওয়ার্ডে ডিএনসিসির মাঠ নেই, গৃহায়ক কর্তৃপক্ষ যদি ওই প্লটটি মাঠ হিসেবে আমাদের বরাদ্ধ দেয়, আমরা দ্রুত উচ্ছেদ করবো।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ