বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
আলেমদের উচিত শুধু হারাম ও নাজায়েজ বলে দায়িত্ব শেষ না করা। মানুষকে হালাল পদ্ধতি শিক্ষা দেওয়া। ব্যবসা, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, ঋণ, ব্যাংক, বীমা, আমদানি-রফতানি, শিল্পস্থাপন ইত্যাদির সুদবিহিন, প্রতারণাবিহিন নিরাপদ পদ্ধতি নির্দেশ করা। হারাম উপার্জনের পাশাপাশি প্রতারণা থেকেও মানুষকে রক্ষা করা। হাদিস শরিফে এসেছে, নবী করিম (সা.) বলেন, আল মু’মিনু লা ইউলদাগু মিন জুহরিন ওয়াহিদিন মাররাতাইন’। (সহীহ বুখারী : ৬১৩৩)।
অর্থাৎ, একজন ঈমানদার এক গর্ত থেকে দুইবার দংশিত হয় না। কিন্তু আমাদের দেশে মুসলমানরা একই ধরনের আর্থিক প্রতারণায় বার বার শিকার হয়। এমনকি অনেক সচেতন মানুষও লোভের বশবর্তী হয়ে এমএলএম কোম্পানি, প্রতারক সমবায় সমিতি, নিয়ম না মানা ই-কমার্স ইত্যাদিতে টাকা বিনিয়োগ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোম্পানির মূল সম্পদ, দায়, পুঁজি ও পারিচালনা, ভালো করে চেক না করে ধোঁকার শিকার হয়। শেয়ার বাজারে অবৈজ্ঞানিক বিনিয়োগ করে সর্বস্ব হারায়। এক্ষেত্রে প্রত্যেকের সচেতন থাকা কর্তব্য। সন্দেহজনক, অনিরাপদ ও সুদের মিশ্রণ থাকা বাণিজ্য ও বিনিয়োগ থেকে সকলেরই সতর্ক থাকা উচিত।
এদিকে লাভের নামে প্রদত্ত শরীয়তে নিষিদ্ধ ব্যাংকের সুদের অবস্থাও তেমন ভালো নেই। বর্তমানকালে ব্যাংকের সুদহার এই পর্যায়ে নেমে এসেছে যে, জমা টাকায় যে সুদ আসছে, তা দিয়ে মূল্যস্ফীতির ঘাটতিই মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বর্তমানে আমানতের সুদহার সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ বেঁধে দিয়েছে। এর ওপর বিভিন্ন মাশুল কাটার পর ব্যাংক খাতে আমানতের গড় সুদহার বা মুনাফা মিলছে ৪ শতাংশ বা তার কিছু বেশি। কোনো কোনো ব্যাংকে এর চেয়ে কিছু বেশিও পাওয়া যায়। তবে তা শরিয়তে স্পষ্ট নিষিদ্ধ। গত ডিসেম্বরের শেষদিকে মূল্যস্ফীতি এসে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। যা নভেম্বরে ছিল ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ। তার মানে, দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে ব্যাংকে রাখা টাকা বছর শেষে কমে যাচ্ছে। এদিকে হালালভাবে ‘সুকুক’ বিনিয়োগে মুনাফা মিলছে ৯ শতাংশ। এটি আরো বাড়তে পারে।
উদাহরণস্বরূপ কেউ ব্যাংকে ১০০ টাকা জমা রাখলেন। সুদের হার যদি ছয় ভাগ ধরা হয়, তাহলে বছর শেষে তিনি পাবেন ১০৬ টাকা। এদিকে মূল্যস্ফীতির হারও ছয় ভাগ বা তার চেয়ে বেশি, এখন ১০০ টাকায় যে পণ্য বা সেবা পাওয়া যায়, বছর শেষে তার জন্য খরচ করতে হবে ১০৬ বা তার চেয়েও বেশি টাকা। এক্ষেত্রে আমানতকারীরা ব্যাংকে টাকা জমা রেখে আসলে সেই টাকার কোনো আয় পাচ্ছে না।
মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখে অথবা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে কিছু মুনাফার আশায়। কিন্তু কম সুদহার আর ঊর্দ্ধ মূল্যস্ফীতির কারণে বছর শেষে যে টাকা পাওয়া যাবে তাতে প্রকৃত আয় কমে যায়। সুদ ছাড়া মুদারাবা লাভের পরিমাণ সন্তোষজনক। অনেকের জাকাত দেয়ার পর টাকার কিছু আয় হাতে থাকে। সবকিছু বিবেচনায় দেশের মানুষের ইসলামি ব্যাংকিংয়ের প্রতি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। সেজন্য প্রতিদিনই ইসলামি ব্যাংকিং কার্যক্রমের পরিধি বাড়ছে। বর্তমানে দেশে ইসলামি ধারার ব্যাংকের সংখ্যা ১০। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ব্যাংক খাতের মোট আমানত ও ঋণের ২৭ শতাংশ হচ্ছে ইসলামি ব্যাংকগুলোর, যা প্রতিদিনই বাড়ছে। মানুষ বাস্তব কারণেই সুদী ব্যাংক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
কাতার ও মালয়েশিয়াসহ বেশ কিছু দেশে মানুষের নিরাপদ ও হালাল বিনিয়োগের জন্য শরিয়াসম্মত সুকুক পদ্ধতি ওলামায়ে কেরাম ও ইসলামী অর্থনীতিবিদগণ প্রস্তাব করেছেন যাতে পুঁজি সংগ্রহের বিপরীতে স্থায়ী সম্পত্তি রয়েছে। কাল্পনিক ক্যাপিটেলের কাগুজে শেয়ার ও ডিবেঞ্চার নয়। যে সুকুকটির গায়ের মূল্য এক ডলার এর দাম কখনোই এক ডলারের নিচে নামবে না। কারণ এর বিপরীতে এক ডলার পরিমাণ স্থায়ী সম্পত্তি আছে। যদি দাম বাড়ে বা লভ্যাংশ দেয়া হয় তাহলে সুকুকধারীর লাভ হবে। তিনি ইচ্ছা করলে সুকুক যখন তখন বিক্রি করতে পারবেন। উদ্যোগ বন্ধ হয়ে গেলেও সুকুকের বিনিময়ে তিনি মূল সম্পদের ভাগ পাবেন।
সুকুকের ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ হওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের মানুষ আগে থেকেই সুদকে এড়িয়ে চলতে চায়। এ জন্য ইসলামি ব্যাংকিং খুবই জনপ্রিয়। আর তাই দেশে আরো আগেই সুকুক ছাড়ার দরকার ছিল। তবে দেরিতে হলেও সুকুক চালু করা হয়েছে। এটাকে ভালো উদ্যোগ উল্লেখ করে প্রফেসর আবু আহমেদ বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও সুকুক চালু করা হয়েছে, যা খুবই জনপ্রিয় হবে। যদিও এটি এমনিতেই আমাদের দেশে জনপ্রিয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।