বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
আদিকাল থেকেই পৃথিবীর মানুষ দুনিয়ার মহব্বতে বিভোর ছিল। পৃথিবীতে মানব জাতির উত্থান পতনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এ সত্যটি অতি সহজেই অনুধাবন করা যায়। আল কোরআনে উল্লিখিত বিষয়টিকে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে : ‘মানবকুলকে মোহগ্রস্ত করেছে রমনী, সন্তান-সন্ততি, রাশিকৃত স্বর্ণ-রৌপ্য, চিহ্নিত অশ্ব, গবাদি পশুরাজি, এবং ক্ষেত খামারের মতো আকর্ষণীয় দ্রব্যসামগ্রী। এ সকল হচ্ছে পার্থিব জীবনের ভোগ্য বস্তু। অবশ্যই আল্লাহ পাকের নিকট রয়েছে উত্তম আশ্রয়। বলুন আমি কি তোমাদেরকে এসবের চাইতেও উত্তম বিষয়ের সন্ধান দেব? যারা পরহেজগার, আল্লাহর নিকট তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত, যার তলদেশে রয়েছে স্রোতস্বিনী প্রশ্রবন, তারা সেখানে অনন্তকাল থাকবে। আর রয়েছে পুতঃপবিত্র সঙ্গিনীগণ এবং আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি। আর আল্লাহপাক স্বীয় বান্দাহদের প্রতি সুদৃষ্টি রাখেন।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৪-১৫)।
উল্লিখিত দুটি আয়াতের প্রথমটিতে দুনিয়ার ছয়টি প্রধান নেয়ামতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যথা : (১) রমনীকুল, (২) সন্তান-সন্ততী, (৩) স্বর্ণ ও রৌপ্যের ভাণ্ডার, (৪) উৎকৃষ্ট অশ্ব বা ঘোড়া, (৫) গৃহ পালিত জন্তু, (৬) ক্ষেত-খামার ও শস্য ক্ষেত্র। পরম কৌশুলী ও মহাবিজ্ঞানী আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত মানুষের দৃষ্টিতে এ সকল বস্তুরাজিকে সুশোভিত করে দিয়েছেন। কেননা, মানব জীবন ধন-ধান্যে পুষ্প পল্লবে সুষমা মণ্ডিত ও কৃতার্থ হতে হলে এ সকল বস্তুরাজির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না।
ইসলামী শরীয়তের নীতি ও আদর্শ অনুসারে সেগুলো পরিমিত পরিসরে উপার্জন করলে এবং জীবন ও জগতের প্রয়োজন অনুপাতে তা সঞ্চয় করলে এবং ন্যায়ানুগ পন্থায় খরচ করলে ইহকাল ও পরকালের কামিয়াবী হাসিল হবে, এতে কোনোই সন্দেহ নেই। কিন্তু এগুলোকে অবৈধ-পন্থায় উপার্জন ও ব্যবহার করলে, এমন কি বৈধ পন্থায় মাত্রাতিরিক্ত যথেচ্ছভাবে অপচয় করলে এবং পরকালের কথা বিস্মৃত হয়ে দুনিয়ার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লে ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পড়বে। এহেন ধ্বংসের হাত হতে উদ্বার লাভ করা একান্তই অনিশ্চিত, তা’বলাই বাহুল্য। এ জন্যই আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত বিবেকবান বান্দাহগণকে সতর্ক করে উল্লেখ করেছেন : ‘এসবই হচ্ছে পার্থিব জীবনের শোভা বা ভোগ্য বস্তু। আর আল্লাহর নিকটই হলো উত্তম আশ্রয়।’
বস্তুত : যা পার্থিব জীবনের ভোগ্য বস্তু তা’ সবই ধ্বংসশীল। সময় ও কালের স্রোতের টানে এসবগুলো একদিন বিলয় প্রাপ্ত হবে। অতীতের স্মৃতিপটে হারিয়ে যাবে। এগুলোর বিপরীতে পরকালীন নেয়ামত রাজি হবে অবিনশ্বর ও চিরস্থায়ী। এগুলোর লয়, ক্ষয় ও বিলুপ্তি ঘটবে না। আল কোরআন স্পষ্টভাবে একথাই ঘোষণা করেছে।
ইরশাদ হয়েছে : ‘হে প্রিয় রাসূল (সা.)! আপনি বলে দিন, আমি কি তোমাদেরকে এগুলোর চাইতে ও উত্তম বিষয়ের সন্ধান বলে দেব? (তা’ হলো এই) যারা পরহেজগার, সৎকর্ম পরায়ন, আল্লাহর নিকট তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। যার তলদেশে প্রস্রবন প্রবাহিত। তারা সেখানে থাকবে অনন্তকাল। আর রয়েছে পুতঃপবিত্র সঙ্গিনীগণ! এবং আল্লাহর রেজামন্দি ও সন্তুষ্টি। অবশ্যই আল্লাহপাক তাঁর বান্দাহদের প্রতি সুদৃষ্টি রাখেন।’
এই আয়াতাংশে পরকালের নেয়ামত রাজির মধ্যে প্রধান তিনটির কথা তুলে ধরা হয়েছে। যথা. (১) জান্নাতের সবুজকানন, (২) পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র সঙ্গিনীগণ, (৩) আল্লাহর সন্তুষ্টি ও রেজামন্দি। আর এসবগুলোই হচ্ছে অবিনশ্বর ও চিরস্থায়ী। সুতরাং যে বা যারা দুনিয়ার ধ্বংসশীল ও অসম্পূর্ণ নেয়ামতের প্রতি আসক্ত হয়ে পরকালের চিরস্থায়ী ও অক্ষয় নেয়ামতের কথা বেমালুম ভুলে গেছে, তাদের মুক্তিলাভের কোনো পথই খোলা থাকবে না। এতদপ্রসঙ্গে পিয়ারা নবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : ‘হুব্বুদ্ দুনইয়া রা’ছু কুল্লি খাত্বিআতিন্’- অর্থাৎ দুনিয়ার মহব্বত সমস্ত আনিষ্টের মূল। (মোসনাদে আহমাদ)।
তাই দেখা যায়, দুনিয়ার লোভে প্রলুব্ধ হয়েই মানুষ দিনের পর দিন জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং দুনিয়া জোড়া নতুন নতুন সভ্যতা ও সংস্কৃতির জন্ম দিচ্ছে এবং এসবের পরিচালনা সংরক্ষণ ও উৎকর্ষ-সাধনের জন্য মজবুত ও সুদৃঢ় নীতিমালা প্রণয়ন করে চলেছে। যার পনের আনাই আখেরাতের জিন্দেগির কথা ভুলিয়ে দেয়ার কলা-কৌশল ছাড়া কিছুই নয়। যা একান্তই ঘৃণ্য ও অভিশপ্ত। যার ফলশ্রুতিতে একথা বলা অবশ্যই সঙ্গত যে, বর্তমান দুনিয়াভী সভ্যতা অভিশপ্ত এবং যা কিছু এতে রয়েছে, তাও অভিশপ্ত। কিন্তু ঐ সকল বস্তু নয়, যদ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায় এবং আখেরাতের কামিয়াবী লাভ সহজতর হয়। ওয়ামা আলাইনা ইল্লাল বালাগ (আমাদের কাজ হলো (সংবাদ) পৌঁছে দেয়া মাত্র)।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।