পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
বাংলাদেশে পাহাড়ি ভূমি কাটা-ছাঁটা নিষিদ্ধ। এই কথাটা আপ্ত আইনে সহজ ভাষায় লেখা থাকলেও আইনের প্রয়োগ কতটা দৃশ্যমান? চট্টগ্রাম অঞ্চলে চোখ বুলালে হতাশার প্রমাণ মিলবে সহজেই। চারদিকে পাহাড় কাটা-ছাঁটা-খোঁড়ার যেন মহোৎসব চলছে। বর্ষা আসার আগেভাগে শুষ্ক মৌসুমে বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রায় সর্বত্র ভূমিদস্যুরা পাহাড়-টিলা কেটে-ছেঁটে-খুঁড়ে ছিন্নভিন্ন অবস্থায় ফেলে রাখে। বৃষ্টিপাত যখন শুরু হয় সেসব কাটা-ভঙ্গুর পাহাড় টিলার ভেতরে বৃষ্টির পানি ঢোকে। তখন একেকটি পাহাড়-টিলা ও ঢালুতে ভয়াবহ ধস নামতে থাকে। এভাবে পাহাড়ের সর্বনাশ ঘটিয়ে সারি সারি বাড়িঘর, অবৈধ স্থাপনা গজিয়ে উঠছে ব্যাঙের ছাতার মতো। প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় পাহাড়খেকো ভূমিদস্যুরা সবসময় ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। পাহাড় কেটে ধ্বংস করে মানুষই তৈরি করছে ভয়ানক দুর্যোগের ফাঁদ।
পাহাড়ধস রোধে গঠিত সরকারি বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য ভূতত্ত্ব বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম ও প্রফেসর ড. শহিদুল ইসলাম অভিমত দিয়েছেন, ভূ-প্রাকৃতিকভাবে বৃহত্তর চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়গুলোর গঠন-গড়ন বালুমাটির। এক-দেড় ফুট নিচেই বালুর লেয়ার রয়েছে। সেগুলো অত্যন্ত নরম, শিথিল। এসব পাহাড়-টিলা কেটে-খুঁড়ে ক্ষতবিক্ষত করা হলে এর ফাটল বা ছিদ্রে বৃষ্টির পানি প্রবেশ করে ভারী হয়। তখনই পাহাড় ধসে যেতে থাকে। বৃষ্টির পানি ঢুকে ব্লক আকারে বিপজ্জনক পাহাড়ধস নেমে আসে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম নগরী, শহরতলী ও জেলায় অনেক স্থানে ভূমিদস্যুরা পাহাড়-টিলা কেটে-খুঁড়ে ছিন্ন ভিন্ন অবস্থায় ফেলে রেখেছে। কোথাও কোথাও সমতল করে ফেলা হচ্ছে। দিনেদুপুরে বুলডোজার, ট্রাক্টর, ট্রাক আর শ্রমিক লাগিয়ে কাটা হচ্ছে পাহাড়। আবার কোথাও কাঁচা বা আধাপাকা বাড়িঘর তৈরি হচ্ছে দিনে-রাতে। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা এসব দেখেও না দেখার ভান করছেন। আদৌ দৃশ্যমান নেই পাহাড়কাটার বিরুদ্ধে কোন অভিযান। প্রতিবছর বর্ষা এলেই পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাসরত দরিদ্রদের ‘আপাতত নিরাপদ স্থানে’ সরানোর তোড়জোড় চলে। বর্ষা চলে গেলে সেই আগের অবস্থায় পাহাড়ের পাদদেশে হাজারো বস্তি এবং পাহাড়খেকোদের রমরমা ব্যবসা। পাহাড়-টিলায় বস্তিগুলো পরিণত হয়েছে মাদক বেচাকেনা, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাইসহ হরেক অপরাধের আখড়া এবং অপরাধীদের অভয়ারণ্য।
ভূমিদস্যুরা পাহাড়ের বস্তিঘর ভাড়া দিচ্ছে গরীব দিনমজুরদের কাছে। নিরূপায় হয়ে গরীব জনগোষ্ঠি পাহাড়ের ঢালে মৃত্যুকূপে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই সপরিবারে করছে বসবাস। আবার সুযোগ বুঝে এক পর্যায়ে উঁচুনিচু জায়গা সমতল করে সেখানেই নির্মিত হচ্ছে পাকা ভবন এমনকি বহুতল ভবন। পাহাড়-কাটা বালুমাটির ব্যবসাও চলছে অবাধে। চট্টগ্রামের এখানে-সেখানে জলাভূমি রাতারাতি ভরাট করা হচ্ছে পাহাড়কাটা বালুমাটি দিয়ে। এভাবেই চট্টগ্রাম অঞ্চলে সুশোভিত পাহাড়-টিলা বন-জঙ্গল ধ্বংসলীলা অব্যাহত রয়েছে।
চট্টগ্রামের পাহাড় ধ্বংস প্রসঙ্গে ইউএসটিসি’র ভিসি, চুয়েটের সাবেক ভিসি ভূতত্ত্ব বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, পাহাড়ের ধস মানুষের সৃষ্ট দুর্যোগ। এই দুর্যোগ বা বিপর্যয় ক্রমাগত বাড়ছে। পাহাড়ধস ও এ কারণে সৃষ্ট বিপর্যয়, ক্ষয়ক্ষতি রোধে যার পাহাড় তাকে দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। যেমন- চট্টগ্রামে সিডিএ, সিটি কর্পোরেশন, রেলওয়ে, ওয়াসা, গণপূর্ত, জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা এবং বেসরকারি কিংবা ব্যক্তি মালিকানাধীন পাহাড়-টিলাসমূহ সুরক্ষার জন্য পরিকল্পিত পদক্ষেপ তাদেরই নিতে হবে। পাহাড় সুরক্ষা প্রশ্নের টেকসই সামাধানের জন্য ইতোপূর্বে বিশেষজ্ঞ কমিটির দেওয়া ২৭ দফা সুপারিশমালা বাস্তবায়ন করা জরুরি। বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে প্রকৌশল ও প্রযুক্তিগতভাবেই পাহাড় রক্ষা করতে হবে।
ভূ-তাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. মো. শহিদুল ইসলাম বলেছেন, পাহাড়ধস ক্রমবর্ধমান এক বিপর্যয়। এতে এ পর্যন্ত এত মানুষ মারা গেলেও দেশের দুর্যোগ আইন-বিধিতে ‘পাহাড়ধস’ নামে কোন শব্দ নেই। এর সুযোগ নিয়ে পাহাড় কেটে ধ্বংস ও মানুষের জীবন বিপন্ন করেও পাহাড় বেদখলকারীরা সহজেই পার পেয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া সরকারি নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রেও পাহাড় সুরক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে না। পাহাড়ধসের কারণে চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য, সৌন্দর্যহানি ছাড়াও প্রাকৃতিক ভারসাম্য, বন-জঙ্গল, জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। পাহাড় ধ্বংসের কারণে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
চট্টগ্রাম মহানগরী ও শহরতলীর অনেক এলাকায় পাহাড়-টিলা বেদখল ও ধ্বংসকাণ্ড চলছে ব্যাপক আকারে। এরমধ্যে নগরীর দক্ষিণ খুলশী, কৈবল্যধাম, আকবরশাহ, নাসিরাবাদ, সিআরবি পাহাড়ের পাদদেশ, টাইগারপাস-লালখান বাজার, মতিঝরণা পাহাড়, টাঙ্কির পাহাড়, মোজাফফর নগর পাহাড়, প্রবর্তক পাহাড়, গোলপাহাড়, ইস্পাহানি পাহাড়, বন গবেষণাগার সংলগ্ন পাহাড়, জয়পাহাড়, চট্টেশ্বরী হিল, বাটালি হিল, রেলওয়ের মালিকানাধীন বিভিন্ন পাহাড়, ফয়’স লেক আবাসিক এলাকা পাহাড়, জালালাবাদ হাউজিং সোসাইটি পাহাড়, গরিবউল্লাহ শাহ পাহাড়, ডিসি হিলের চেরাগী পাহাড়, এ কে খান কোম্পানির পাহাড়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মালিকানাধীন পাহাড়, জালালাবাদ পাহাড়, জঙ্গল সলিমপুর-বায়েজিদ পাহাড়।
জেলার হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, রাঙ্গুনিয়া, রাউজান, মিরসরাই, সীতাকুণ্ড, চন্দনাইশ, লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, বাঁশখালী এবং তিনটি পার্বত্য জেলা বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে অগণিত মানুষের পাহাড়ের ঢালে মৃত্যুকূপে বসবাস। সরকারি-বেসরকারি হিসাব মতে, বন্দর নগরীসহ সমগ্র চট্টগ্রাম অঞ্চলে বর্তমানে একশ’রও বেশি পাহাড়ে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ উচ্চ ঝুঁকিতে বসবাস করছে। এদের বেশিরভাগ ছিন্নমূল মানুষ।
২০১৭ সালের ১১, ১২ ও ১৩ জুন ভারী বর্ষণে পাহাড়-টিলা ধসে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে পৌনে ২শ’ মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। তখন সরকারের গঠিত উচ্চপর্যায়ের কমিটি ২৭ দফা সুপারিশ পেশ করে। ইতোপূর্বে ২০০৭ সালের ১১ জুন চট্টগ্রামে পাহাড়ধস ট্র্যাজেডির (নিহত ১৩৬ জন) ঘটনায় একটি টেকনিক্যাল কমিটি পাহাড়ধসের পেছনে ২৮টি কারণ চিহ্নিত এবং পাহাড়ধস রোধে সরকারের কাছে ৩৬ দফা সুপারিশ পেশ করেন। কিন্তু আজও তা হিমাগারে পড়ে আছে। ভূতত্ত্ব বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, পাহাড় কেটে তৈরি অপরিকল্পিত বসতঘর বর্ষায় ধসে গিয়ে প্রাণহানি ঘটে। পাহাড়ধোয়া বালিমাটি নগরীতে ছড়িয়ে পড়ে নালা-নর্দমা ভরাট ও ড্রেনেজ সিস্টেম অকেজো হয়ে যাচ্ছে।
অনেকক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, কোন পাহাড়ের নির্দিষ্ট বা সীমিত অংশ কাটা-ছাঁটার অনুমতি নিয়েই পুরো পাহাড় এমনকি আশপাশের পাহাড়গুলো ধ্বংস ও ভূমিস্যাৎ করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) উদ্যোগে বায়েজিদ-ফৌজদারহাট ছয় কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণকালে পরিবেশ অধিদফতরের শর্ত অমান্য করে ১৮টি পাহাড় কেটে গড়ে ওঠা সড়কটি মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। ‘হিল কাটিং ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান’ অনুযায়ী পাহাড়ের ঢালু ২৬ দশমিক ৬ ডিগ্রি কোণে কাটার বাধ্যবাধকতা ছিল। অথচ তা অগ্রাহ্য করে ১৮টি পাহাড়ের মধ্যে ১৫টি কেটে প্রায় ধ্বংস এবং প্রতিটি পাহাড় কাটা হয় ৯০ ডিগ্রি কোণে, খাড়াখাড়িভাবে। আরও অনেক শর্ত অমান্য করেই ১৮টি পাহাড় কেটে ৩২০ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করে সিডিএ। পাহাড় ধ্বংসের গুরুতর দায়ে সরকারি সংস্থা সিডিএকে ২০২০ সালের ২৯ জানুয়ারি ১০ কোটি ৩৮ লাখ টাকা জরিমানা করে পরিবেশ অধিদফতর।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।