হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
আফতাব চৌধুরী
পরিবর্তন কোথায় নেই? শুধ্ইু কি দুঃখ-সুখ চক্রবৎ পরিবর্তনশীল? কথাটা মনে পড়ল বাঙালি জাতটার কথা ভেবেই। আর্থিক জীবনে বাঙালির পরিবর্তন ঘটেছে। বিচ্ছিন্নতাবাদের চিন্তাধারার প্রকাশ ঘটেছে তার মধ্যে। অশন-বসনে বৈচিত্র্য এসেছে। বাঙালি আজ নিজভূমেই পরবাসী। তার বাসস্থানের অভাব ঘটছে। উদ্যম-উৎসাহে ভাটা পড়ছে। বাঙালির সংগ্রামী মন আজ বিপথগামী। ভিন্নমতাদর্শী দলের সঙ্গেই শুধু নয়, নিজ দলের মধ্যেই প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে মতানৈক্য, দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ।
আত্মকলহে লিপ্ত বাঙালি কাদের সুবিধে করে দিচ্ছে? উত্তরটা অতুল সুর অনেক আগেই দিয়েছেন, ‘বাঙালি আজ আত্মকলহে প্রমত্ত হয়ে অগ্রগতির সুযোগ ও সুবিধা করে দিচ্ছে অপরকে।’ এ আত্মকলহ আজ এমন একটা স্তরে গিয়ে পৌঁছেছে যে পরস্পর পরস্পরকে গালিগালাজ দেয়াটাই প্রতিভার একটা বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাঙালির এই পরিচয় কিন্তু সর্বযুগের নয়। একসময় বাঙালির আত্মপ্রত্যয়ের অভাব ছিল না। তার জীবনচর্যায় ও সংস্কৃতিতে স্বকীয়তা ছিল। বহুরূপীর মতো এই জাতটা ঘনঘন রূপ বদল করেনি। অতীতে গৌরবময় সংস্কৃতির অধিকারী হয়ে বাঙালি মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। কিন্তু আজ?
বড় বেদনাময় অভিজ্ঞতার কথা বলি। বছর কয়েক আগে সিলেটে এক পিসিও-র পাশের ঘরে বসে আছি। রাস্তার উপরেই ঘর। দেখি, সত্তরোর্ধ্ব এক ভদ্রলোক কাউকে ফোন করার জন্য পিসিও-র মালিকদের অনুরোধ করলেন, ‘ভাই, আমি কানে একটু খাটো, ফোনের সাউন্ডটা একটু বাড়িয়ে দিন।’ স্পষ্ট শুনলাম, বৃদ্ধ দুবাইতে কর্মরত তার একমাত্র ছেলেকে বলছেন, ‘বাবা, তোর মার অবস্থা এখন-তখন। একবার শেষ দেখা দেখে যা।’ উত্তরটা ওপার থেকে স্পষ্ট কানে এল, ‘বাবা, এটা তো প্রাকৃতিক ব্যাপার। মার বয়স হয়েছে। একদিন তাকে তো যেতেই হবে। আমি এখন ছুটি পাব না। কয়েকদিন পরে যাব।’ দিন কয়েক পর ভদ্রলোকের সাথে হঠাৎ একদিন এক ফার্মেসিতে দেখা। পরিচয় গোপন করে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনার ছেলে এখন কেমন আছে?’ ভদ্রলোক খানিকটা হকচকিয় গেলেন। তখন পিসিওর প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি বললেন, ‘আমি এখন একা। কয়েকদিন আগে আমার স্ত্রী-বিয়োগ হয়েছে। মায়ের মৃত্যুর খবরে ছেলেটি আসেনি। জানি না, আমার মৃত্যুর পর সে জানাজাতে শরীক হবে কিনা!’
আজকের বাঙালির সব কিছুই তবে খারাপ? লাখ টাকার এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে আসুন বর্তমান বাঙালি-জীবনের আরও গুটিকয়েক কথা জেনে নিই। গত শতাব্দীর তিন-চার দশকে ‘কফি প্রমোশন বোর্ড’ কফির প্রচারের জন্য বিনামূল্যে কফি খাওয়ালেও বাঙালি চায়ের নেশায় ডুবেছিল। কফি হাউসের আড্ডাটা ছিল মুষ্টিমেয় বাঙালির। আবার চা-এখন সর্বস্তরের বাঙালির পানীয় হলেও তার সনাতন পানীয় ছিল ঘোল, লেবুর শবরত ও বেলের পানা। তরমুজের শরবত, কাঁচা আম পোড়ার শরবতও এক সময় বাঙালির প্রিয় ছিল। এরপর এল চা। কোথাও গ্লাসে-এখন ‘ওয়ান টাইম-এ’। এরপর বাঙালি বোতল ধরল। সফট ড্রিংকস পান শুরু হল। কোকোকোলার বোতল, থামস-আপ-এর বোতল, স্প্রাইটের বোতল, মিরিন্ডার বোতল এবং বলা বাহুল্য, মিনারেল ওয়াটারের বোতল। মাঝে কিছুদিন চলেছিল সোডা-ওয়াটারের বোতল। আমার মতো বয়স্ক মানুষেরা সেই মুখখোরার ‘চুঁই শব্দটি আজও ভোলেননি হয়তো। এ পর্যন্ত সবই মোটামুটি ঠিক আছে। পরিবর্তনের রথের আসনে বসেই বাঙালি বিশ্বজগতে তার পরিচয়টি তুলে ধরেছিল। কিন্তু আজ বাঙালি তার রথের আসনে বসে সেই, রথের চাকায় পিষ্ট হচ্ছে। জাতটা এখনও মরেনি, তবে তার নাভিশ্বাস উঠেছে।
কালিমার্কা পাকি মদের বোতলটা তখনও ‘উচ্চ’ বাঙালি সমাজে কল্কে পায়নি। তবে হ্যাঁ, ইংরেজদের সংস্পর্শে এসে ‘উচ্চ সমাজাসীন’ বাঙালি রক্তিম বর্ণের সুরাপান শুরু করেছিল। এই লালপানি ও পাকি মদ পানে ধর্মীয় বা সামাজিক কোনো না-কোনো বাধা ছিল। কিন্তু আজ? ধন্য রতচক্র পিস্ট বাঙালি! বহু প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে বাঙালী আজ মদ্যপ অবস্থায় সমাজে প্রবেশ করছে! বিবাহ আসরে, রঙ্গমঞ্চে যাত্রা নাটকে গায়ক-কথক-বাদক সুরাকে অচল মনে করে না। সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত বাঙালিও আজ সুরের নেশার সাথে সুরার নেশাকে মেলাচ্ছে। অথচ এমন একটা সময় ছিল যখন এদেশে প্রস্তুত নানাবিধ মদের যথেষ্ট খ্যাতি ছিল, তখনও কিন্তু বাংলায় মদপানকে নিচু চোখে দেখা হত। আর আজ এ-বিষয়ে বাঙালি নির্লিপ্ত হয়ে গেছে। উচ্চ বাঙালি সমাজে এখন মদ্যপান আর দিনগত রীতিমাত্র নয়, ‘স্ট্যাটাস সিম্বল’।
এখন দিনকাল বদলেছে। বাঙালি সুন্দরীরা এখন আর তেল কাজল-আলতায় নিজেদের রূপসী করে তোলে না। এখন প্রয়োজন রোজ একবার করে এসে মেশিনে ওজন থেরাপি, তারপরে চুলে একটা টনিক ম্যাসাজ, আর চার দিন বাদে বাদে একটা করে প্যাক। ব্যাস, হয়ে গেল সৌন্দর্যের টোটাল এক্সপ্লোরেশন। শহর ঢাকায় আছে নামি-দামি পার্লার, যেখানে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রূপ নিয়ে মাজাঘষা করছে বাঙালি নারী-পুরুষ। মন্দ নয়। শুধু বলি, বাঙালি নারী-পুরুষ আজ রক্ষণশীলতার গ-িটুকু পার হোক। মেয়েরা সাজুক, রূপচর্চা করুক। কিন্তু এমনভাবে সাজটাই শ্রেয় যেন পুরুষ কখনও অশোভন দৃষ্টিতে নারীর দিকে তাকাতে না পারে। অনেক কট্টর নারীবাদীরাও কিন্তু এই বিশ্বাসে সুস্থির।
বাঙালি শুধু রূপসাগরে ডুব দেয়নি। নব্য মধ্যবিত্ত বাঙালির মধ্যে ঢুকছে গাড়ির নেশা। গেল বছর মাত্র মধ্যবিত্তের মাইনে বেড়েছে অনেক। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই কাজ করলে তখন দু’জনের ছ’মাসের মাইনেতে নতুন গাড়ি কেনা যেত। আজ গাড়ির দাম বেড়েছেÑবেতন বৃদ্ধিও ঘটেছে যথেষ্ট। সুতরাং আজ যদি মধ্যবিত্ত বাঙালি ছোট গাড়ি কেনেÑ এমনকি যাদের মাইনে ততটা বাড়েনি তারাও যদি গাড়ি কেনার কথা ভাবে তাহলে মাল্টি-ন্যাশনাল কার কোম্পানিগুলো অবশ্যই তাদের হিসাবের মধ্যে রাখবে।
বাড়ির কথাটাও এসে যায় এ প্রসঙ্গে। একসময় বলা হত সাহেবের গাড়ি বাঙালির বাড়ি তাদের আভিজাত্যের পরিচয়। বাঙালির বাড়ি যে কতখানি আভিজাত্যে ভরা তার প্রমাণ শুধু জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি বা সিমলের দত্তবাড়ি নয়, গুলশান বারিধার বাঙালি-বাড়ির ভেতর-বাহির দেখলেই বোঝা যায় এই শৌখিন জাতটার শুধু জন্ম হয়নি, রঙ বদলেছে। কিন্তু এ সবই তো বাইরের চাকচিক্য। ভদ্রলোক বাঙালিরা পুরানো মূল্যবোধ নিয়ে বসে নেই। না থাক কিন্তু বিকল্প মূল্যবোধের সুষ্ঠু কাঠামো কি তৈরি হয়েছে? বাঙালির নব প্রজন্ম নতুন সহস্রাব্দে তাদের অভিভাবকদের ছেড়েছে কিন্তু পেরেছে কি সাবালক হয়ে উঠতে? আসলে সেই ব্যবধান তো এখনও ঘোচেনিÑ বাঙালির ছেলে-মেয়েরা ডাক্তার-ব্যারিস্টার হয়, তারাই ক্রেতা, তারাই বিক্রেতা। নিম্নবর্গীয় বাঙালিরা আজও উৎপাদকদের কাছে কাঁচামালই রয়ে গেল। হ্যাঁ বাঙালি সাহেবরা নন্দনে যায়, নজরুল, অ্যাকাডেমিতে যায়, ফিল্মোৎসবে যায়Ñগিয়ে দেখে সেই দৃশ্যÑযেখানে জীবনযন্ত্রণায় কাতর, না পাওয়ার হতাশায় ক্লিষ্ট বাঙালি জাতির সিংহভাগই কোণঠাসা। এরাই কিন্তু এখন বাবু বাঙালিকে মানতে চাইছে না। এই হাওয়া ক্রমশ জোরদার হচ্ছে।
পিতামাতার ব্যাপারে ইসলামে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে- ‘তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন তিনি ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত না করতে ও পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। তাদের একজন বা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদের ‘উফ’ বলো না এবং তাদের ধমক দিবে না, তাদের সাথে সম্মানসূচক কথা বলবে। (সূরা বনী ইসরাঈল, ১৭ঃ২৩)।’ এ আয়াতে প্রথম তাওহীদ আল্লাহকে সর্বতোভাবে এক ও লা-শরীক বলে স্বীকার করার নির্দেশ এবং এক আল্লাহ ছাড়া আর কারোরই ইবাদত করতে স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করা হয়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে, পিতামাতার সাথে ভাল ব্যবহার করার। এ দু’টো নির্দেশ একসঙ্গে ও পর পর দেয়ার মানে এই যে, প্রতিপালনের ক্ষেত্রে আল্লাহ্ ও পিতামাতা দু’জনেরই বিশেষ ক্ষেত্রের মধ্যে বিশেষ অনুগ্রহ রয়েছে। প্রকৃত প্রতিপালক আল্লাহ্। তাই বান্দার উপর সর্বপ্রথম হক তাঁরই ধার্য হবে। কিন্তু আল্লাহ যেহেতু এ কাজ সরাসরি নিজে করেন না, করেন পিতামাতার মাধ্যমে, কাজেই বান্দার উপর আল্লাহর হকের পরেই পিতামাতার হক ধার্য হবে।
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘মাতাপিতার সাথে সদ্ব্যবহারকারী পুত্র যখন রহমতের দৃষ্টিতে তার পিতামাতার দিকে তাকায়, তখন আল্লাহ্ তার প্রতিটি দৃষ্টির বিনিময়ে একটি করে কবুল হজ্জের সাওয়াব লিখে দেন।’ সাহাবাগণ আরয করেন, যদি সে প্রতিদিন একশতবার তাকায়? বললেন ঃ যদি সে ইচ্ছা করে একশতবার তাকাতে পারে। আল্লাহ্ সর্বপেক্ষা বড় এবং পূতপবিত্র। হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন ঃ ধুলায় অবলুণ্ঠিত হোক তার নাক, ধুলায় অবলুণ্ঠিত হোক তার নাক, ধুলায় অবলুণ্ঠিত হোক তার নাক। জিজ্ঞেস করা হলো, কার হে আল্লাহ্র রাসূল? বললেন, সেই ব্যক্তির যে তার পিতামাতার একজনকে কিংবা উভয়কে বার্ধক্যে উপনীত অবস্থায় পেয়েও খিদমত করেনি অতঃপর সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। (মুসলিম)
রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন, ‘যে লোক পিতামাতার ব্যাপারে আল্লাহ্র অনুগত হয় তার জন্যে জান্নাতের দু’টি দরজা উন্মুক্ত হয়ে যাবে, একজন হলে একটি দরজা উন্মুক্ত হয়ে যাবে। আর কেউ যদি পিতামাতার ব্যাপারে আল্লাহ্র নাফরমান হয়ে যায়, তবে তার জন্যে জামান্নামের দু’টি দরজা খুলে যাবে, আর একজন হলে একটি দরজা খুলে যাবে।’ অতঃপর এক সাহাবী আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! পিতামাতা যদি সন্তানের উপর জুলুম করে আর তার ফলে সন্তান যদি তাদের নাফরমানী করে বা তাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে, তবুও কি সন্তানকে জাহান্নমে যেতে হবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। পিতামাতা যদি সন্তানের উপর জুলুমও করে, তবুও তাদের নাফরমানী করলে জাহান্নামে যেতে হবে।
পিতামাতার অধিকার সন্তানের উপর এত বেশি যে, তাদের অনুমতি ছাড়া জিহাদের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে যোগদান করা জায়িয নয়। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবন উমর (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কাছে এসে জিহাদে যোগদানের অনুমতি চাইল। তিনি বললেন : তোমার পিতামাতা জীবিত আছে কি? লোকটি বলল, জি হ্যাঁ, তারা দু’জনই জীবিত আছেন। তখন তিনি বলেন, তাদের দু’জনের খিদমতে নিযুক্ত থাক। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবন আমর (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কাছে এসে বলল, আমি আপনার নিকট বায়’আত হওয়ার জন্য এসেছি। আমি আমার পিতামাতাকে ক্রন্দনরত অবস্থায় রেখে এসেছি। এ কথা শুনে তিনি বলেন : তুমি তাদের কাছে চলে যাও এবং তুমি যেভাবে তাদের কাঁদিয়ে এসেছ, তেমনি গিয়ে থামাও। আর তিনি তাকে বায়’আত করাতে অস্বীকার করেন।
পিতামাতার সাথে দুর্ব্যবহার করা, তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা, তাদের মনে কষ্ট দেয়া ও তাদের নাফরমানী করা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত বড় গুনাহ। শুধু তাই নয়, যারা তা করে তাদের উপর আল্লাহ্র লা’নত বর্ষিত হতে থাকে। হযরত আবু বকর (রা.) বলেন, নবী করীম (সা.) বলেছেন : আল্লাহ তা’আলা চাইলে যত গুনাহ এবং যে কোন গুনাহ্ই ক্ষমা করে দিবেন, তবে পিতামাতার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ ও তাদের নাফরমানী করলে তিনি তার কখনও ক্ষমা করবেন না। কেননা এর শাস্তি মৃত্যুর পূর্বেই এ দুনিয়ায়ই সত্বর দেয়া হবে। সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে পিতামাতা উভয়েই কষ্ট করেন। তথাপি পিতার তুলনায় মাতার হক অনেক বেশি। (মুসলিম) হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি নবী করীম (সা.)-এর কাছে এসে বলল, মানুষের মধ্যে কোন ব্যক্তি আমার সর্বাধিক সদাচরণ পাওয়ার অধিকারী? তিনি বলেন: তোমার মা। লোকটি বলল, তারপর কে? তিনি বলেন : তোমার মা। লোকটি বলল, তারপর কে? তিনি বলেন : তোমার মা। লোকটি বলল, তারপর কে? তিনি বলেন : তোমার পিতা।(মুসলিম)। হযরত আবদুল্লাহ ইব্ন আমর (রা.) বলেন, নবী করীম (সা.) বলেছেন, ‘পিতার সন্তুষ্টিতেই আল্লাহ্র সন্তুষ্টি এবং পিতার অসন্তুষ্টিতেই আল্লাহর অসন্তুষ্টি নিহিত।
এক ব্যক্তি নবী করীম (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বলল, হে আল্লাহ্র রাসূল! আমার ধন-সম্পদও আছে এবং আছে সন্তান-সন্তুতিও। কিন্তু এমতাবস্থায় আমার পিতা আমার সম্পদ নিতে চায়। এসম্পর্কে আপনার অভিমত কী? নবী করীম (সা.) বললেন, ‘তুমি আর তোমার ধন-সম্পদ সবই তোমার পিতার। আল্লামা শাওকানী (রা.) বলেছেন, দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত পিতামাতার জন্যে অর্থ ব্যয় করা সচ্ছল সন্তানের উপর ওয়াজিব হওয়ার বিষয়ে আলিমগণের ইজমা-ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পিতামাতার জন্য দু’আ করা সন্তানের অন্যতম কর্তব্য। আল্লাহ্ এবং তার রাসূলের পরেই পিতামাতার হক আদায় করা সন্তানের জন্য অপরিহার্য। এমনকি অমুসলিম পিতামাতার সাথেও সদাচরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
পিতা বাঙালী পরিবারের বটবৃক্ষ। সেই বটবৃক্ষের ছায়াতলে পুরো পরিবারটা গড়ে উঠে। সেই ছায়া না থাকলে গোটা পরিবার ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। যে সন্তান মাতার অপত্য ¯েœহ ছাড়াও পিতার দোয়া পায়, সেই সন্তান জীবনে অবশ্যই সফল হবে ও বিপদমুক্ত থাকবে। একটি কথা আছে ‘পিতৃ ভক্তি অটুট যত, সেই ছেলে হয় কৃতী তত।’ বিখ্যাত ইংরেজ কবি ডড়ৎফংড়িৎঃয ও লিখেছেন, ঋধঃযবৎ: ঃড় মড় যরসংবষভ. বি পধহহড়ঃ মরাব. অ যড়ষরবৎ ঘধসব. হযরত সোলায়মান (আ.) বলেছেন : ‘জ্ঞানী পুত্র পিতার আনন্দ বর্ধন করে কিন্তু নির্বোধ পুত্র মাতার কষ্টের কারণ হয়।” একজন পিতা জ্ঞানী পুত্র কামনা করে, ধনবান পুত্র নয়। আমাদের বাঙালি সমাজেরও পরিবারের বন্ধন পশ্চিমাদের দৃষ্টিতে অনন্য। এটা তাদের স্বপ্নেরও অতীত।
আমাদের পিতামাতা সর্বদাই আমাদের পরম শ্রদ্ধার। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তারা সন্তান ও নাতি-নাতনিদের সাহচর্যে থাকেন। এটা পশ্চিমা বিশ্বে কল্পনাও করা যায় না। বুড়ো হলেই তাদের স্থান হয় ‘ঙষফ ঐড়সব’ এ। তাই পিতামাতার কথা স্মরণ করার জন্য তাদের একটা আনুষ্ঠানিক দিবসের প্রয়োজন হয়। নির্দিষ্ট দিনে একটা কার্ড বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে তারা পিতামাতাকে স্মরণ করে। আমাদের বাঙালি সমাজে প্রতিটা দিন ‘গড়ঃযবৎ’ং উধু বা ‘ঋধঃযবৎ’ং উধু। কোন আনুষ্ঠানিক দিবসের প্রয়োজন নেই।
বিশ্বায়ন বা পণ্যায়নের যুগে বিনিময় মূল্যের দাপট সব বাঙালি দেখাতে পারছে না, পারছে কয়েকজন। তারাই চেনা গৃহকোণ থেকে ছিটকে গেছে অথচ নতুন একটা ঘর খুঁজে পায়নি, পথ খুঁজে পাওয়া তো দূরের কথা। আসল কথা, এই বিশ্বায়ন তো নিতান্তই খ-িত, অসম্পূর্ণ, বিকৃত, তাই শতপুষ্প বাঙালির মধ্যে বিকশিত হতে পারেনি। আজকের বাঙালি দরজাÑজানালা মাঝে-মাঝে খুলে দেয় বটে, খোলা বাতাস বুক ভরে নিতে চায় বটে, কিন্তু বাতাসে আর কী কী ভেসে আসছে তার কিছুুমাত্র বিচার করে না।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।