Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

হুন্ডিতে আসছে রেমিট্যান্স

ইরাকের সম্ভাবনাময় শ্রমবাজার স্থায়ী কনস্যুলেট স্থাপনের প্রস্তাব ফাইল চাপা সাড়া মিলছে না ব্যাংকের শাখা স্থাপনে

শামসুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ১১ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:০০ এএম

মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাকে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত হয়ে আসছে। বৈশ্বিক করোনা মহামারি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসায় দেশটিতে পুনর্বাসনের কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হয়েছে। উচ্চ পর্যায়ের কূটনৈতিক তৎপরতার অভাবে ভ্রাতৃ-প্রতীম ইরাকের সম্ভাবনাময় শ্রমবাজার পুনরুদ্ধার সম্ভব হচ্ছে না। ২০১৮ সালের দেশটিতে ১৯ হাজার ৫৬৭ জন বাংলাদেশি কর্মী চাকরি লাভ করে। ২০১৯ সালে দেশটিতে ৯ হাজার ২৬৬জন বাংলাদেশি দেশটিতে কর্মসংস্থান লাভ করে। ২০১৮ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা জারি করে ইরাক সরকার। ফলে বৈধ পথে দেশটিতে জনশক্তি রফতানি বন্ধ রয়েছে। দেশটিতে কোনো ব্যাংকের শাখা না থাকায় হাজার হাজার প্রবাসী কর্মীরা হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছে। এতে দেশ বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

বিএমইটির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত দেশটিতে ৭৫ হাজার ৭৫৩ জন বাংলাদেশি কর্মী কর্মসংস্থান লাভ করেছে। ইরাকের মোট ১৮টি প্রদেশ ও ৪ লাখ ৩৪ হাজার ১২৮ বর্গ কিলোমিটার আয়তন রয়েছে। গোটা ইরাকে বাংলাদেশি কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখা না থাকায় দেশটিতে কর্মরত হাজার হাজার প্রবাসী কর্মী নিরুপায় হয়ে হুন্ডির মাধ্যমে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাতে বাধ্য হচ্ছে। দেশটির বিভিন্ন মার্কেটে হুন্ডি ব্যবসায়ীদের কাছে ধরনা দিতে প্রবাসী কর্মীদের চরম বিড়ম্বনার শিকার হতে হচ্ছে।

বৃহত্তর ইরাকের উত্তর অঞ্চলের আরবিল, সোলাইমানিয়া ও দুহুক এ ৩ টি প্রদেশ নিয়ে স্বায়ত্ত্বশাসিত কুর্দিস্তানে প্রচুর বাংলাদেশি কর্মীর চাহিদা রয়েছে। শান্তিপূর্ণ কুর্দিস্তানে বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার বাংলাদেশি কর্মী কঠোর পরিশ্রম করে প্রতি মাসে হুন্ডির মাধ্যমে প্রচুর রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছেন। কুর্দিস্তানে প্রবাসী কর্মীরা ৫শ’ মার্কিন ডলার থেকে ৭শ’ মার্কিন ডলার বেতন পাচ্ছেন। গোটা ইরাকের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ৬০ হাজার বাংলাদেশি কর্মী কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। বৈধ পন্থায় রেমিট্যান্স দেশে পাঠাতে না পেরে প্রবাসী কর্মীরা নিরুপায় হয়েই হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। গতকাল সোমবার ইরাকের রাজধানী বাগদাদ থেকে নির্ভরযোগ্য সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। ইরাক প্রবাসীরা ঢাকা-বাগদাদ সরাসরি ফ্লাইট চালুরও জোর দাবি জানিয়েছেন।

কুর্দিস্তানে বাংলাদেশের স্থায়ী কনস্যুলেট না থাকায় বাংলাদেশি কর্মীদের নিয়মিত বিভিন্ন কনস্যুলার সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কুর্দিস্তানে কর্মরত মৃত বাংলাদেশিদের লাশ দেশে প্রেরণ, পাসপোর্ট নবায়ন, জেলখানা ও থানায় আটকদের আইনি সহায়তা প্রদান, হাসপাতালে অসুস্থদের সেবা কর্মীদের আবাসস্থল ও কর্মস্থল পরিদর্শন স্থানীয় সরকার, মালিক ও বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের সাথে লিয়াজো রক্ষা করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতাসহ নানা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। নিরাপত্তা জনিত নানা সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে বাগদাদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে কুর্দিস্তানে গিয়ে উল্লিখিত সেবাসমূহ সীমিত আকারে নিশ্চিত করা হচ্ছে। বাগদাদ হতে কুর্দিস্তানের দূরত্ব ৩৯১ কিলোমিটার এবং গাড়িতে যেতে প্রায় ৮ ঘণ্টা সময় লাগে এবং আকাশপথে ৪৫ মিনিট সময় লাগে। প্রায়ই বাগদাদে অস্থিরতা দূরত্ব বিদ্যমান থাকায় কুর্দিস্তান গিয়ে নিয়মিত সেবা প্রদান করা দূরূহ হয়ে পড়ে। কুর্দিস্তানে কর্মরত প্রবাসীদের বাগদাদসহ ইরাকের অন্যান্য প্রদেশে যাতায়াত করতে পারে না বিধায় তাদের বাগদাদ মিশনে এসে সেবা গ্রহণ করা সম্ভব হয় না।

কুর্দিস্তান তাদের নিজস্ব আঞ্চলিক সরকার দ্বারা পরিচালিত। এ অঞ্চলে আলাদা সরকার কেবিনেট এবং প্রেসিডেন্ট রয়েছেন। কুর্দিস্তানের মোট আয়তন ৪০ হাজার ৬৪৩ বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ যাদের অধিকাংশই (প্রায় ৯৭%) মুসলিম। কুর্দিস্তান অঞ্চল পাহাড়, নদী ও হ্রদ নিয়ে গঠিত হওয়ায় বছরের বেশিরভাগ সময় অনুকূল আবহাওয়া বিরাজমান থাকে। এরই মধ্যে এ অঞ্চল আরব দেশসমূহের পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। বর্তমানে ব্যবসা বাণিজ্যের স¤প্রসারণসহ বিভিন্ন ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে কুর্দিস্তানে। আবাসন শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটছে। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও উন্নত হাসপাতাল গড়ে ওঠায় আরবিল, সোলাইমানিয়া ও দুহুক ইরাকের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় আধুনিক ও নিরাপদ শহরে পরিণত হয়েছে। গতকাল সোমবার ইরাকের রাজধানী বাগদাদে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত মো. ফজলুল বারী এ তথ্য জানিয়েছেন। রাষ্ট্রদূত মো. ফজলুল বারী এক প্রশ্নের জবাবে ইনকিলাবকে বলেন, এক লাখেরও কম বাংলাদেশি কর্মী কঠোর পরিশ্রম করে অবৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে। দেশটিতে বাংলাদেশি ব্যাংকের কোনো শাখা না থাকায় তারা অবৈধ পথে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। রাষ্ট্রদূত বলেন, ইরাকে কর্মরত বাংলাদেশিদের রেমিট্যান্স বৈধ চ্যানেলে পাঠানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বাগদাদে শাখা খোলার অনুরোধ জানানো হয়েছে। সোনালী ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংক ইরাকে তাদের শাখা খোলার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

উল্লেখ্য, কুর্দিস্তান অঞ্চলের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ কুর্দিস্তান চেম্বার্স অব কমার্সের নেতৃবৃন্দ ও প্রদেশের গভর্নরগণের সাথে বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাতের সময় কুর্দিস্তানের রাজধানী আরবিলে বাংলাদেশের স্থায়ী কনস্যুলেট খোলার জন্য অনুরোধ করেন এবং তারা সার্বিক সহাযোগিতা প্রদান করবেন মর্মে আশ্বাস প্রদান করেন।

গত সেপ্টেম্বর মাসে রাষ্ট্রদূত ফজলুল বারী ইরাকের কুর্দিস্তান আঞ্চলিক সরকারের রাজধানী আরবিলে প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রেসিডেন্ট নেসিরাভান বারজানির সাথে এক সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হন। রাষ্ট্রদূত কুর্দিস্তানে কর্মরত বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশিদের বিভিন্ন সময়ে ইকামা প্রদানসহ উপযুক্ত পরিবেশে কাজ করার সুযোগ দেয়ায় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানান। কুর্দিস্তানের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশি কর্মীদের দেখাশুনা এবং কুর্দিস্তান ও বাংলাদেশের সাথে ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নয়নে একটি স্থায়ী কনস্যুলেট অফিস খোলার আহ্বান জানান। রাষ্ট্রদূত কুর্দিস্তানের আঞ্চলিক সরকারের প্রধানমন্ত্রী ভবনে প্রধানমন্ত্রী মাসরুর বারজানির সাথে দ্বি-পাক্ষিক বৈঠকে মিলিত হন। রাষ্ট্রদূত কুর্দিস্তানে বসবাসরত বাংলাদেশিদের ইকামার জরিমান মওকুফসহ বৈধতা দেয়ার অনুরোধ জানান। দেশটির প্রধানমন্ত্রী তাৎক্ষণিকভাবে বৈঠকে উপস্থিত পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে জরিমান মওকুফসহ বাংলাদেশি কর্মীদের বৈধতা দেয়ার জন্য নির্দেশনা প্রদান করেন। কুর্দিস্তানে বাংলাদেশি পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য উন্নয়নে সবরকম সহযোগিতার আশ্বাস দেন। রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশ থেকে দক্ষ কর্মী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক নিয়োগের অনুরোধ জানান। তার সরকার বিষয়টি বিবেচনা করবেন বলে তিনি রাষ্ট্রদূতকে আশ্বাস্ত করেন। রাষ্ট্রদূত জানান, কুর্দিস্তানে কর্মরত হাজার হাজার বাংলাদেশি কর্মীদের সেবা নিশ্চিতকরণে স্থায়ী কনস্যুলেট স্থাপনের উদ্যোগ নেয়ার জন্য গত নভেম্বর মাসে পররাষ্ট্র সচিবের কাছে লিখিত প্রস্তাব প্রেরণ করা হয়েছে। এ ব্যাপরে এখনো কোনো অগ্রগতি হয়নি।

বর্তমানে কুর্দিস্তান অঞ্চলে প্রায় ২০ বাংলাদেশি কর্মী কর্মরত রয়েছেন যাদের মধ্যে অধিকাংশই বৈধ। এরা প্রতি মাসে প্রায় ৫০০-৭০০ মার্কিন ডলার আয় করে থাকেন। তারা বাংলাদেশে নিয়মিত যাতায়াত করতে পারেন। এ সকল প্রবাসীরা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। এখানে অবস্থানরত প্রবাসীরা বাংলাদেশি পণ্য দুবাই হতে সংগ্রহ করা বাজারজাত করে আসছেন যার ফলে এ অঞ্চলের জনগণের কাছে বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলছে। আবাসিক হোটেল রেস্টুরেন্ট ও পর্যটন শপিং মল, আবাসন ব্যবসার ব্যাপক প্রসার ঘটছে। এছাড়াও মুসলিম হওয়ায় খাবার সংস্কৃতি ধর্মীয় আচার আচরণের মিল থাকায় বাংলাদেশি কর্মীর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কুর্দিস্তান আঞ্চলিক সরকার এবং নিয়োগকর্তাদের বাংলাদেশি কর্মীদের অগ্রাধিকার দেয়ার অভিপ্রায় রয়েছে। কুর্দিস্তানে অনারারি কনস্যুলেটের পরিবর্তে বাংলাদেশের স্থায়ী কনস্যুলেট স্থাপনের জন্য তাঁরা অনুরোধ জানিয়েছেন। কুর্দিস্তানকে বাংলাদেশি পণ্য শ্রমিক পেশাজীবী ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার নার্স এবং শিক্ষকদের জন্য সম্ভাবনাময় হিসেবে বিবেচনা করা যায়। আগামী দিনে কুর্দিস্তানে কমপক্ষে আরো ৩০ বাংলাদেশি কর্মী এর কর্মসংস্থান সৃষ্টির ব্যাপক সম্ভবনা রয়েছে। এছাড়াও, বাংলাদেশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের ব্যবসা করার ব্যাপক সুযোগ রয়েছে।

উল্লেখ্য, এ অঞ্চলের সম্ভাবনা কাজে লাগানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশ এরই মধ্যে তাদের স্থায়ী কনস্যুলেট স্থাপনপূর্বক পণ্যের বাজার দখল ও অভিবাসী কর্মীর কর্মসংস্থানে সম্ভবনা কাজে লাগাচ্ছে। ২০০৭ সালে এ অঞ্চলে সর্বপ্রথম ইরান ও রাশিয়া স্থায়ী কনস্যুলেট স্থাপন করেছে। বর্তমানে ভারত, চায়না, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, তুরস্ক, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্যসহ ২৬ টি দেশের স্থায়ী কনস্যুলেট, ৫টি দেশের প্রতিনিধি অফিস ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার দফতর রয়েছে। ইরাক প্রবাসী বাংলাদেশিরা সর্তকতার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন।



 

Show all comments
  • Kamrul Mia Kamrulmia ১১ জানুয়ারি, ২০২২, ১:০১ এএম says : 0
    ইরাক প্রবাসীরা ব্যাংকে টাকা ছারতে গেলে বলে আকামা দে আকামা তো নাই কি করবে
    Total Reply(0) Reply
  • Muhammad Nur Nobi ১১ জানুয়ারি, ২০২২, ১:০১ এএম says : 0
    পুরা ইরাকে আমরা বৈধতা চাই বাংলাদেশীদের
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রেমিট্যান্স

১১ জানুয়ারি, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ