বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী, গত এক বছরে সারা দেশে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন নারী-পুরুষ আত্মহত্যা করেছেন বলে জানা গেছে। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে আত্মহত্যা ৪৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেড়েছে। তাঁদের মধ্যে নারীরাই বেশি।
আত্মহত্যার ঘটনা পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সী রয়েছেন ৪৯ শতাংশ। অর্থাৎ অর্ধেকই তরুণ। ৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী ৩৫ ও ৩৬ থেকে ৪৫ বছর বয়সী ১১ শতাংশ। সবচেয়ে কম আত্মহননকারী হচ্ছেন ৪৬ থেকে ৮০ বছর বয়সী ব্যক্তিরা, ৫ শতাংশ। হিসাব বলে, ৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সী ব্যক্তিরাই বেশি ঝুঁকিতে।
এক তথ্যমতে আমেরিকায় প্রতিদিন গড়ে ১২৩ জন মানুষ আত্মহত্যা করে। আর বাংলাদেশ ৩৯ জন। আমেরিকা বিশ্বের রোল মডেল। আর বাংলাদেশ আগের চেয়ে উন্নয়নশীল রাষ্ট্র বলে মঞ্চ থেকে মিডিয়ায় আওয়াজ শোনা যায়। কথা সেটা না। কথা হলো প্রতিদিন এতসংখ্যক মানুষ কেন আত্মহুতি দেয়। তাও অধিকাংশ উচ্চ বংশীয়। টাকা-পয়সা, অর্থ-কাড়ি, ব্যাংক-ব্যালেন্স, বন্ধু-বান্ধব সব থাকার পরেও কেন এই ঘৃণিত ও কষ্টের পথে তারা মুক্তি খোঁজে? এই প্রশ্নের উত্তর কেউই সঠিকভাবে বলতে পারবে না!
অনলাইনে জনাব হাবীব আনওয়ারের বিশ্লেষণ নিম্নরূপ, একজন মানুষ পৃথিবীতে সবথেকে বেশি ভালোবাসে নিজেকে। মানুষ আত্মপূজারী নামে প্রসিদ্ধ। সবার আগে আমার ফিকিরে আত্মমগ্ন হয়ে যায়। শরীরের স্বাস্থ্য, চেহারার কোমলতা, চোখের জ্যোতি ইত্যাদি ঠিক রাখতে হাজার হাজার টাকা খরচ করা মানুষটিও যখন এই ঘৃণিত পথ অবলম্বনের মাধ্যমে মুক্তি পেতে চায় তখন কারো বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয় যে, চারপাশের সমৃদ্ধশালী এত কিছু থাকার পরেও সে প্রকৃত সুখ, শান্তি খুঁজে পায়নি! জীবন-যৌবনের সর্বস্ব দিয়ে অর্জিত সম্পদ থাকার পরেও তারা এক গভীর অপূর্ণতায় দিশেহারা হয়ে যায়। বোধ-বুদ্ধি অকেজো হয়ে যায়, অনেক চেষ্টা প্রচেষ্টার পরেও যখন পূর্ণতা আনতে ব্যর্থ হয়, তখন সে মুক্তির আশায় আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়!
কিন্তু সে একটি বারও চিন্তা করে না যে, এই অপূর্ণতা হচ্ছে আল্লাহ ভালোবাসা থেকে দূরে থাকার। অস্থির ও ভঙ্গুর জীবনে পূর্ণতা ও স্বস্তির হিমেল হাওয়া বুলাতে হলে ফিরে যেতে হবে আল্লাহর কাছে। ইমাম ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন, প্রত্যেক মানুষের অন্তরে রয়েছে অস্থিরতা, যা কেবল আল্লাহর কাছে ফিরে গেলেই ঠিক করা সম্ভব। প্রত্যেক মানুষের অন্তরে এক শূন্যতা আছে, সেটা কেবল আল্লাহর কাছে ফিরে গেলেই পূরণ করা সম্ভব। প্রত্যেক মানুষের অন্তরে রয়েছে ভয় আর উৎকণ্ঠা, যা কেবল আল্লাহর আশ্রয় নিলেই দূর করা সম্ভব। প্রত্যেক মানুষের অন্তরেই রয়েছে হতাশা, যেটা কেবল আল্লাহর ওপরে সন্তুষ্ট হলেই দূর করা সম্ভব।
চারপাশে চোখ খুলে তাঁকালে দেখা যায় যে, যাদের হৃদয় আল্লাতে পূর্ণ তারা কখনো হতাশাগ্রস্ত হয় না। তাদের চেহারায় থাকে না কোনো পেরেশানির ছাপ। তাঁরা কিছু পেলে শোকর আদায় করে আর না পেলে ধৈর্য ধারণ করে। কারণ, তাদের হৃদয়ে প্রোথিত রয়েছে যে, সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ একমাত্র আল্লাহর হাতে।
আত্মহত্যা সম্পর্কে আমাদের সমাজে কিছু ভুল ধারণা আছে যা সঠিক নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মহত্যা করা হারাম ও কবিরা গুনাহ। ইমাম আবু হানিফা (রহ.)সহ অধিকাংশ ফিকাহবিদ বলেন, আত্মহত্যাকারীর জানাজা পড়তে হবে। পাশাপাশি দোয়া-দরুদ বা দান-সাদাকার সওয়াব প্রত্যেক ইমানদারের প্রতি প্রেরণ করা যায়-সে যত বড়ই পাপী হোক না কেন।
আত্মহত্যা মহাপাপ এবং এর শাস্তিও খুব ভয়াবহ- একথা সর্বজনবিদিত। কিন্তু তার জানাযা পড়া যাবে না এ ধারণা ঠিক নয়। বরং তার জানাযা পড়া যাবে। তবে এমন ব্যক্তির জানাযায় শীর্ষস্থানীয় দ্বীনী ব্যক্তিত্ব না গিয়ে সাধারণ লোক দিয়ে জানাযার নামাজ পড়িয়ে নেয়াই উত্তম হবে। যাতে অন্যান্য লোকেরা শিক্ষা নিতে পারে যে, আত্মহত্যা করলে তো ভালো মানুষ জানাযায় অংশগ্রহণ করবে না, তখন অন্যান্য লোকেরা এই ঘৃণিত পথ পরিহার করতে সচেষ্ট হবে।
অনেকে মনে করেন যে আত্মহত্যা করার কারণে তার ঈমান চলে গেছে, তার জন্য মাগফিরাতের দোয়া করা যাবে না, তার জানাযায় অংশগ্রহণ করা যাবে না। কথাগুলো ঠিক নয়। আত্মহত্যাকারীর জন্য ইস্তেগফার ও ইসালে সাওয়াব করা বৈধ; কারণ আত্মহত্যা করার কারণে তার ঈমান চলে যায়নি। যদিও এটার জন্য সে গোনাহগার হবে। (মুসলিম শরিফ : ৯৭৮; তিরমিজি ১০৬১)।
আত্মহত্যাপ্রবণ হতাশাগ্রস্ত মানুষ কোরআন-সুন্নাহর অমিয় বাণীগুলো আত্মোপলব্ধি করতে পারলে নতুনভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতে পারবে। আল্লাহ আমাদের হতাশামুক্ত ও পরিশুদ্ধ জীবন যাপনের তাওফিক দান করুন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।