যেভাবে ৫০০
ক্লাব ফুটবলে গোলের প্রায় সব রেকর্ডই তার দখলে। এবার সেই লিওনেল মেসি উঠে গেলেন আরেক উচ্চতায়। বার্সেলোনার জার্সি গায়ে ৫০০ গোলের মাইলফলক স্পর্শ করেছেন মেসি।
তাপস বড়ুয়া রুমু
চট্টগ্রাম তথা দেশের ক্রীড়াঙ্গণে ডেরিক রেন্ডলফ একটি উজ্জ্বল নাম। ফুটবল, বাস্কেটবল ও অ্যাথলেটিকসে একাধারে অনেকদিন মাঠ কাঁপিয়েছেন এই কৃতী ক্রীড়াবিদ। মানুষকে খেলাধুলার মাধ্যমে আনন্দ দিয়ে পরবর্তীতে ক্রীড়া সংগঠক হিসেবেও ক্রীড়াঙ্গণের সেবায় নিজেকে এখনও নিয়োজিত রেখেছেন আপাদমস্তক এ ক্রীড়া পাগল মানুষটি। খেলাধুলার সাথে সাথে সংগঠক হিসেবেও অত্যন্ত সফল এ ব্যক্তিটি সিজেকেএস’র কাউন্সিলর হিসেবে হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ করেছেন। চট্টগ্রামের সর্বজন শ্রদ্ধেয় এ ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব ডেরিক রেন্ডলফকে ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সংবর্ধনা দিয়েছে সাউথ এন্ড ক্লাব। এ ক্রীড়া পাগল মানুষটি এখনো যে ক্রীড়াঙ্গণের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন তার ৫০ বছর পূর্তিতে প্রধান অতিথি ছিলেন মাঠ থেকে সিটি মেয়র নির্বাচিত আ জ ম নাছির উদ্দীন। বিসিবির সহ-সভাপতি, সিজেকেএস’র সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন যে সংস্থার নেতৃত্ব দিচ্ছেন সেই সংস্থার কাউন্সিলর হিসেবে শ্রদ্ধাভাজন ক্রীড়া সংগঠক ডেরিক রেন্ডলফের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে যারা এ সংবর্ধনার আয়োজন করেছেন তাদেরকে তিনি অভিনন্দন জানিয়েছেন। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সহ-সভাপতি আলী আব্বাস।
উল্লেখ্য, সংবর্ধনার নেপথ্যে ছিলেন সাউথ এন্ড ক্লাবের উপদেষ্টা ও সিজেকেএস যুগ্ম সম্পাদক মোঃ আমিনুল ইসলাম, এককালের কৃতী খেলোয়াড় ও ক্রীড়া সংগঠক মোঃ সরওয়ার হোসেন ও সাংবাদিক-সাউথ ক্লাবের কাউন্সিলর সাইফুল্লাহ চৌধুরী। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্যে ডেরিক রেন্ডলফকে সংবর্ধনা দিয়ে যে কাজটি শুরু করেছেন তা চট্টগ্রাম ক্রীড়াঙ্গণে পথিকৃৎ হিসেবে ভবিষ্যতে এ ধরনের সংগঠকদের সম্মাননা অনুষ্ঠান আয়োজনে উৎসাহিত করবে বলে চট্টগ্রামের ক্রীড়ামোদীরা মনে করেন। অনাড়ম্বর এই অনুষ্ঠানে বর্ষীয়ান ক্রীড়া সংগঠক সেলিম আবেদীন চৌধুরী, ইঞ্জি. আলী আহমেদ, সিজেকেএস সহ-সভাপতি সাহেদ আজগর চৌধুরী, অ্যাড. শাহীন আফতাবুর রেজা চৌধুরী, মোজাম্মেল হক ও হাফিজুর রহমান, যুগ্ম-সম্পাদক আমিনুল ইসলাম ও শাহজাদা আলম, কোষাধ্যক্ষ শাহাবুদ্দীন মো: জাহাঙ্গীর, নির্বাহী সদস্য আলহাজ আবুল হাশেম, খ্যাতনামা ফুটবল প্রশিক্ষক নজরুল ইসলাম লেদু, জাতীয় ফুটবলার এজাহারুল হক টিপুসহ অনেক ক্রীড়া সংগঠক উপস্থিত ছিলেন।
চট্টগ্রামের এ কৃতী খেলোয়াড় ও সংগঠক ডেরিক রেন্ডলফের জন্ম ১৯৪৬ সালে পাথরঘাটায়। শৈশব থেকে খেলাধুলায় জড়িয়ে পড়ে ফুটবল, অ্যাথলেটিকস ও বাস্কেটবলে হাতেখড়ি হয় স্কুলে পড়তে পড়তেই। ক্লাস সেভেনের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লীগে খেলা শুরু করেন ১৯৬০ সালে। বেটে খাটো শক্তপোক্ত শরীর ডেরিক খেলতেন রাইট আউট, রাইটিং পজিশনে। ভালো খেলার সুবাদে ১৯৬৭ সালে চাকরি নেন রেলওয়েতে। রেলওয়ে তখন খেলাধুলার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করত। পাকিস্তান আমলে রেলওয়ে শীর্ষস্থানীয় দল থাকায় চট্টগ্রাম একবার লীগ চ্যাম্পিয়ন হয় ডেরিক রেন্ডলফের রেলওয়ে। এ দলটি ১৯৭৩ সালে এম এ আজিজ শিল্ডে রানার্স আপও হয়েছিল। তখনকার সময়ে শংকর, প্রতাপ, ম্যাকওয়া, রশিদউল্লাহর মতো জাতীয় পর্যায়ের খেলোয়াড়দের সাথে খেলেছেন ডেরিক রেন্ডলফ।
এর আগে ঢাকা ফুটবল লীগেও পদচারণা ঘটে ডেরিকের। ১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত ঢাকা লীগে ইস্ট এন্ড ক্লাবের হয়ে কৃতিত্বের সাথে খেলেন। তখন আজকের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ছিলেন ইস্ট এন্ড ক্লাবের গোলরক্ষক। ডেরিক রেন্ডলফ ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তার খেলোয়াড়ী জীবন চালিয়ে যাওয়ার পর ইনজুরিতে পড়লে পরবর্তীতে তিনি খেলা ছেড়ে দেন। খেলা ছাড়ার পর ’৭৬ সালে রেলওয়ে ফুটবল দলের কোচের দায়িত্ব পেয়ে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ঐ দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তার সুদক্ষ প্রশিক্ষণে সাবেক জাতীয় ফুটবলার গোলরক্ষক মহসিন, মোশাররফ বাদল, নাজমুল হাফিজ জামরুল এখন স্ব স্ব অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত। এরপর রেলওয়ের সিনিয়র টি টি হিসেবে অবসরে যান।
স্ত্রী ও এক মেয়ে নিয়ে পৈতৃক বাসভবন ফিরিঙ্গিবাজারে বসবাস ডেরিক রেন্ডলফ শুধু ফুটবল নন অ্যাথলেটিকস ও বাস্কেটবলেও আলো ছড়িয়েছিলেন। ৪ গুনীতক ৪০০ মিটার রিলে দৌঁড় এবং ৪০০ মিটার হার্ডরস ইভেন্টে অংশ নিতেন তিনি। ১৯৬৭ সালে ইস্ট পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাথলেটিকস মিটে ওয়ান্ডারার্সের পক্ষে অংশ নিয়ে ৪ গুনীতক ৪০০ মিটার রিলে দৌড়ে তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন। এছাড়া ডেরিক ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান গেমসে রেলওয়ের পক্ষে অংশ নেন। তার হাত ধরে দেশবরেণ্য অ্যাথলেট আবুল হাসনাত (হিরু), এস এম রশিদ, এ কাদের, পুলিনা চৌধুরী, আবদুল সালাম জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অ্যাথলেটিক্স অঙ্গণে বেশ দাপট দেখিয়েছিলেন।
পাথরঘাটা সেন্ট প্লাসিড স্কুল থেকে শুরু করেন লেখাপড়া। এ স্কুলে বাস্কেটবল খেলার অনুকূল পরিবেশ থাকার সুবাদে স্কুল জীবন থেকে খেলেছেন বাস্কেটবল ডেরিক। ১৯৬২ সালে ফাস্ট ওপেন বাস্কেটবল টুর্নামেন্টে তিনি সেন্ট প্লাসিড স্কুলের পক্ষে খেলেন এবং অধিনায়কের দায়িত্বও পালন করেছিলেন। সে টুর্নামেন্টে তিনি ছিলেন সর্বোচ্চ গোলদাতা। সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল এরশাদও সে টুর্নামেন্টে খেলতে এসেছিলেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পক্ষে। দু’দলের খেলায় ডেরিক রেন্ডলফের দল পরাজিত হয়েছিল। ১৯৬৪ সালে ইস্ট পাকিস্তান বাস্কেটবল ফেডারেশন আয়োজিত বাস্কেটবল টুর্নামেন্টে চট্টগ্রাম জেলা দলের পক্ষে অংশ নেন তিনি। সে টুর্নামেন্টে তার দল সেমিফাইনাল পর্যন্ত উন্নীত হয়েছিল। তখনকার সময়ে ইস্ট পাকিস্তান বাস্কেটবল ফেডারেশন যে ক্যাম্পের আয়োজন করেছিল সে ক্যাম্পে চট্টগ্রাম থেকে যে দু’জন নির্বাচিত করা হয়েছিল তাদের একজন ছিলেন ডেরিক রেন্ডলফ এবং অন্যজন নন্দ দুলাল এখন ভারতের অধিবাসী। তার প্রশিক্ষণে চট্টগ্রাম জেলা যুবদল ১৯৮৫ সালে জাতীয় আসরে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল। জাতীয় আসরে এটাই চট্টগ্রাম বাস্কেটবলে সেরা সাফল্য। তার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাস্কেটবল খেলোয়াড় ফজল রহিম, ফজল রেহান, অশোক চৌধুরী, জেমস রয়, নাদিম, ইয়েন রিবেরো জাতীয় দলে ডাক পেয়েছিলেন। খেলোয়াড়ী জীবন থেকে অবসর নিয়ে কোচ ও সংগঠক হিসেবেই তিনি এখনও ক্রীড়াঙ্গণে সময় দিয়ে যাচ্ছেন।
বৈষয়িক জীবনে লোভ-লালসাকে দূরে রেখে নির্মল বিনোদনের খোরাক হিসেবে ক্রীড়াঙ্গণকেই বেছে নিয়ে শত কষ্টের মাঝেও ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে চট্টগ্রাম ক্রীড়াঙ্গণের সেবায় অর্ধশত বছর কাটিয়ে দিয়েছেন। তিনি ক্যাথলিক ক্লাব, রেলওয়ে এবং সাউথ এন্ড ক্লাবের কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর তিনি সাউথ এন্ড ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে এ ক্লাব থেকে দু’জন ক্রীড়া সংগঠক কাউন্সিলর শিপ পেয়ে চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরা হলেন মরহুম দস্তগীর চৌধুরী ও হাফিজুর রহমান। এছাড়া এ ক্লাব থেকে সিজেকেএস’র ফুটবল সেক্রেটারী হয়েছিলেন সাবেক ফুটবলার ও ক্রীড়া সংগঠক সরওয়ার হোসেন। ফুটবলার সরওয়ার হোসেনের খেলোয়াড়ী জীবন ১৯৭৭ সাল থেকে শুরু হওয়ার পর ১৯৮৪ সালে সাউথ এন্ড ক্লাবের কাউন্সিলর শিপ পান। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে সহকারী কমিশনার কর্মরত আছেন। সত্তরোর্ধ বয়সী ডেরিককে এখনো দেখা যায় ক্রীড়াঙ্গণের যে কোন কর্মসূচিতে সবার আগে উপস্থিত হতে। তার সরব উপস্থিতি চোখে পড়ে যা আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস। তার সময়ের অনেক সংগঠক মারা গেছেন, কেউ কেউ বয়সের ভারে বা অন্য কারণে ক্রীড়াঙ্গণ থেকে দূরে রয়েছেন। কিন্তু ডেরিক আছেন এখনো সক্রিয়ভাবে। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ডেরিক রেন্ডলফ আপাদমস্তক একটি খাঁটি ক্রীড়াবিদ। খেলাধুলাকে ভালোবেসে ক্রীড়াঙ্গণে ৫০ বছর পার করে ৫১ বছরে পা দিয়েছেন। এ বয়সেও তাকে দেখা যায় নিয়মিত স্টেডিয়াম পাড়ায়। সততার সাথে ক্রীড়াঙ্গণে বিচরণ করা এ খেলোয়াড়Ñসংগঠক ডেরিক রেন্ডলফকে সবাই শ্রদ্ধার পাত্র হিসেবে বিবেচনা করে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।