Inqilab Logo

রোববার ১৩ অক্টােবর ২০২৪, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১, ০৯ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

বেঁচে থাকুক গ্রামীণ খেলাধূলা

| প্রকাশের সময় : ২২ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

জাহেদ খোকন : হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ খেলাধূলা। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এলাকাভিত্তিক প্রাচীন খেলাগুলো এক সময় খুবই জনপ্রিয় ছিল। এসব খেলাতেই শৈশবের দুরন্তপনায় মেতে থাকতো ছেলে-মেয়েরা। আধুনিকতার ছোঁয়ায় ঐতিহ্যগত লোকজ খেলাগুলো আজ বিলুপ্তির পথে। ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠির মধ্যে আনন্দ উদ্দীপনা ও পারস্পরিক সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক দিন দিন কমে যাচ্ছে। প্রজন্মকে ক্রমেই ঠেলে দিচ্ছে মাদকের দিকে। দেশের ভবিষ্যত প্রজন্ম হচ্ছে মেধাশূন্য। গ্রামীণ এসব খেলাধূলাকে রক্ষায় এবার এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশ কান্ট্রি গেমস অ্যাসোসিয়েশন। এক বছর আগে আত্মপ্রকাশ করা এ ক্রীড়া সংগঠনটি গ্রামীণ খেলাধূলার রক্ষায় ইতোমধ্যে সেমিনার, কোর্স ও বাংলা বর্ষবরণ দেশজ ক্রীড়া উৎসবের আয়োজন করেছে।

বাংলাদেশে রয়েছে স্বভাব সুলভ এবং মৌসুমী ক্রীড়া চর্চা। এ কারণে ষড়ঋতুর প্রভাবে রয়েছে ঋতু ভিত্তিক খেলাধুলার প্রচলনও। যেমন- বর্ষাকালে নৌকা বাইচ, গ্রীষ্মকালে ঘোড়দৌড়, গরুর গাড়ির দৌড়, শীতকালে গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবাধা খেলার জমজমাট আড্ডা। এছাড়া প্রাচীন যুগ থেকে প্রচলিত খেলাগুলির মধ্যে রয়েছে- হাডুডু, বৌ-চি, দড়িলাফ, পাঁচগুটি, কানামাছি, এক্কাদোক্কা, সাতচাড়া, ডাংগুলি, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগ লড়াই, লুডু, মার্বেল, টোক্কাটুক্কি, হাড়িভাঙ্গা, কাঠিছোঁয়া, চোর ডাকাত, দড়ি টানাটানি, চেয়ার সিটিং, রুমাল চুরি, তৈলাক্ত বাঁশেউঠা, গুলতিছোড়া, ইচিংবিচিং, মাংসচোর, ওপেন্টি বাইস্কোপ, বস্তাদৌড়, বলিখেলা, বালিশ যুদ্ধ, কুতকুত, লাটিম খেলা ইত্যাদি। এ খেলাগুলি দেশের স্থানভেদে ও ঋতুভেদে চর্চা হয়ে থাকত নিয়মিত। প্রজন্মের মাঝে বিষয়টি ধরে রাখতে বাংলার সমৃদ্ধ সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা সংরক্ষণ, অনুশীলন, গবেষণা ও উন্নয়নের ব্যবস্থা করতেই এগিয়ে এসেছে কান্ট্রি গেমস অ্যাসোসিয়েশন।
গ্রাম-গঞ্জ, শহর-বন্দরসহ দেশের সকল অঞ্চলের জনগোষ্ঠির মধ্যে বিলুপ্তপ্রায় ঐতিহ্যগত ও লোকজ খেলাধুলাকে পুনরায় জনপ্রিয় করে তোলার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে এই সংগঠনটি। দু’বছর আগে বাংলাদেশ রুরাল গেমস ফেডারেশন নামে একটি ব্যানারের মাধ্যমে গ্রামীন খেলাধূলা রক্ষার উদ্যোগ নিয়েছিলেন বেশক’জন সংগঠক। তবে তা পূর্ণতা পায়নি। এবার সেই কাজটিই শুরু করেছে নতুন এই ক্রীড়া সংগঠনটি।
সংগঠনটির লক্ষ্য দেশের প্রতিটি বিদ্যাপিঠে লোকজ খেলাধূলাকে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় নিয়মিত করা। কারিগরি জটিলতা খুবই কম বিধায় গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন করবে তারা। দেশীয় লোকজ ক্রীড়া চর্চার মাধ্যমে অন্য যে কোন আধুনিক খেলাধুলার ক্রীড়াবিদ সৃষ্টিতে অবদান রাখা সম্ভব বলে মনে করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ফয়েজ আহমদ। তার কথা, ‘হাডুডু খেলার পারদর্শীদের যেমন কাবাডি খেলায় সহজভাবে বাছাই করা যায়। তেমনি ফুটবল, ভলিবল, ক্রিকেট, হ্যান্ডবলের ওয়ার্ম আপ গেম হিসেবে গোল্লাছুটকে কাজে লাগানো যেতে পারে। দাঁড়িয়াবাধা, শারীরিক ফিটনেস তৈরিতেও বিশেষ ভ‚মিকা রাখে। আমাদের মনে হয়, গ্রামীণ খেলাধূলা দেশের সকল আধুনিক খেলার পূর্বশর্ত হতে পারে।’
ফয়েজ আরো বলেন, ‘বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা রক্ষায় স্থানীয় পর্যায়ে বেসরকারিভাবে, সরকারিভাবে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে ব্যক্তি বিশেষ ও সংগঠনের মাধ্যমে গ্রামীণ ও লোকজ ক্রীড়া চর্চা করা হয়ে থাকে। যেমন, চট্টগ্রামে মেট্রোপলিটন ক্রীড়াসংস্থার মাধ্যমে নিয়মিত জব্বারের বলিখেলা, নড়াইল ক্রীড়া সংস্থার উদ্যোগে সুলতান মেলায় লোকজ ক্রীড়ার উৎসব, মানিকগঞ্জের পদ্মাপাড়ে স্থানীয় উদ্যোগে ঘোড়দৌড়, পাবনা সাথিয়া-আতাইকুলায় ঘোড়দৌড়, ষাঁড়ের লড়াই ও গরুর গাড়ির দৌড়, কুষ্টিয়ার লাঠি খেলা, পঞ্চগড়ের ঘোড়দৌড়, দাঁড়িয়াবান্ধা ইত্যাদি খেলা হয়ে থাকে। তাছাড়াও প্রত্যেক গ্রামে, স্কুলে, ক্লাব পর্যায়ে গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা, বৌ-চি, হাডুডু, কানামাছি, নৌকা বাইচ ইত্যাদি খেলাধুলা কম বেশী চর্চা হয়ে থাকে।’
বাংলাদেশ রুর‌্যাল গেমস্ অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে ২০১১ সাল থেকে স্থানীয় পর্যায়ে প্রশিক্ষক ও রেফারি কোর্স আয়োজনসহ লোকজ খেলার বিকাশে দেশের ৩৩ জেলায় কার্যক্রম পরিচালনা করানো হয়েছিল। এবার ঐতিহ্যবাহী বাংলা লোকজ সংস্কৃতির খেলাধুলাকে সংগঠিত করে নিয়মিত অনুশীলন এবং প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা, গবেষণার মাধ্যমে উন্নত বিশ^মানের ক্রীড়াশৈলী ও নিয়মনীতি তৈরী করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ কান্ট্রি গেমস্ অ্যাসোসিয়েশন গঠন করা হয়েছে।
দ্বিবার্ষিক পরিকল্পনার অধীনে দু’বছরের মধ্যে ২০০ প্রশিক্ষক ও ১০০ জন রেফারিকে প্রশিক্ষণ দেবে এই সংগঠনটি। এছাড়া নিয়মিতভাবে প্রতিটি জেলা, বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ে ১টি প্রতিযোগিতা আয়োজন, জাতীয় ক্রীড়া জাগরণের লক্ষ্যে পাঁচদিনের একটি লোকজ ক্রীড়া উৎসবের উদ্যোগ, প্রতি বছর বাংলার ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণ লোকজ ক্রীড়া উৎসব আয়োজন, দু’টি সেমিনার ও ওয়াকর্শপ আয়োজন এবং পাঁচশ’জন দক্ষ ক্রীড়াবিদ তৈরি করবে তারা।
এ ধারাবাহিকতায় ঐতিহ্যবাহী বিলুপ্ত প্রায় খেলাগুলো নিয়ে গত ১৩ এপ্রিল রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয় ‘বাংলা বর্ষবরণ দেশজ ক্রীড়া উৎসব’। এ উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বীরেন শিকদার এমপি বলেন,‘গ্রামীণ খেলাগুলোকে তুলে আনার চেষ্টা করেছি আমরা। ইতোমধ্যে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের মাধ্যমে উপজেলা পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত তা এনেছিলাম। গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলোকে ফের আলোর মুখ দেখানোর এমন উদ্যোগ নেয়ায় কান্ট্রি গেমস অ্যাসোসিয়েশনকেও সাধুাদ জানাই। ঐতিহ্যকে লালন করার জন্য তারা চেষ্টা করছে।’ উৎসবে হাডুডু, দাড়িয়াবান্দা, গোল্লাছুট, বৌচি, দড়িলাফ, মোরগলড়াইয়ের মতো ঐতিহ্যবাহী ১২টি ডিসিপ্লিনের খেলা হয়। ঢাকা কমার্স কলেজ, বান্দরবান লামার কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, কসমো স্কুল, ক্যামব্রিয়ান কলেজ, নারায়ণগঞ্জ কলেজসহ বেশ ক’টি স্কুল ও কলেজ এতে অংশ নেয়। খেলা শেষে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন বাংলাদেশ কান্ট্রি গেমস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি গণমাধ্যম ও কৃষিব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সাধারণ সম্পাদক ফয়েজ আহমদ। দিনব্যাপী এ উৎসবে সেরার খেতাব জিতে নেয় ঢাকা কমার্স কলেজ ও লামার কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন